দিল্লিতে সহিংসতার মাঝেই সাবিত্রীকে বিয়ে দিল মুসলিমরা

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:৩২ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:২৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
সাবিত্রী প্রসাদ ও তার বর গুলশান।

দিল্লির উত্তর–পূর্ব মুসলিম এলাকায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সহিংস হামলায় মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় মানবতা যেমন ভূলুণ্ঠিত তেমনি কিছু মানবিক উদাহরণও দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। যার ফলে সপ্তাহজুড়ে চলা বাইরের হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিমদের মধ্যেকার এই সহিংসতার সময় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্য দেখা গেছে। চান্দবাগ এলাকায় মুসলিমরা দায়িত্ব নিয়ে তাদের হিন্দু প্রতিবেশী সাবিত্রীকে বিয়ে দেয়ার ঘটনা এর একটি উদাহরণ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে।

গত সপ্তাহজুড়ে চলমান ওই সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাজার ও অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তবে, এ সময় স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম প্রতিবেশীদের একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। মুসলিমরা মন্দির পাহারা দিয়েছেন। মুসলিমদের আগুন থেকে বাঁচিয়েছেন হিন্দুরা।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, গত বুধবার সাবিত্রীর বিয়ে দেন তার মুসলিম প্রতিবেশী ভাইরা। ২৩ বছরের সাবিত্রী প্রসাদের গত মঙ্গলবার ছিল বিয়ের দিন। কিন্তু বিয়ের পোশাকে, হাতে মেহেদি পরে আর হলুদ মেখে কেঁদেই যাচ্ছিলেন সাবিত্রী। কারণ, বাড়ির বাইরে তখন চলছিল সহিংসতা। ওই পরিস্থিতিতে বিয়ে ছিল অসম্ভব। সাবিত্রীর বাবা তাই পরদিন বিয়ের অনুষ্ঠান হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন। আর এ ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করেন সাবিত্রীর মুসলিম প্রতিবেশীরা। তাঁরা নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে সাবিত্রীর বিয়ে দেন, যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সাবিত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠানে কোনো বিঘ্ন না ঘটে।

গত বুধবার বিয়ের ওই অনুষ্ঠানস্থল থেকে সাবিত্রী রয়টার্সকে বলেন, ‘আজ আমার মুসলিম ভাইয়েরা আমাকে রক্ষা করছেন।’

সাবিত্রীর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই প্রধান সড়কটি তখন ছিল রণক্ষেত্র। যানবাহন ও দোকানপাটে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। পুরো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল ইট।

এ সপ্তাহে চান্দবাগ ও এর কাছাকাছি এলাকাগুলোতে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কমপক্ষে ৩৮ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক।

সাবিত্রীর বাবা বোধি প্রসাদ বলেন, ‘সোম ও মঙ্গলবার আমরা ঘরে কেবল ধোঁয়া দেখেছি। পরিস্থিতি ছিল ভয়ংকর। আমরা কেবল শান্তি চাই।’

বোধি প্রসাদ বলেন, ‘আমরা জানি না এই সহিংসতার পেছনে কারা রয়েছে। তবে তারা আমার প্রতিবেশী নয়। বছরের পর বছর মুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনো সমস্যা ছাড়াই আমরা বসবাস করে আসছি। এখানে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে কোনো শত্রুতা নেই।’

সোমবার সন্ধ্যায় বিয়ের আগের আনুষ্ঠানিকতা ছিল সাবিত্রীর। সেদিন হাতে মেহেদি পরেন সাবিত্রী। আর সেদিনই সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সাবিত্রী বলেন, ‘বাইরে আমি অনেক হইচই শুনছিলাম। তবে আমি মেহেদি পরা শেষ করি। আশা করেছিলাম, পরের দিন (মঙ্গলবার) পরিস্থিতি ভালো হবে। কিন্তু সেদিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেল।’

সাবিত্রীর বাবা বাধ্য হয়ে হবু জামাইকে বললেন, তাদের বাড়িতে আসা বিপজ্জনক।

সাবিত্রীর প্রতিবেশী সামিনা বেগম বলেন, ‘আমরা ওর জন্য খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। বিয়ের কনে বিয়ের দিন বাড়িতে বসে কাঁদবে, এমনটা কোন মা-বাবা চান?’

বুধবার সহিংসতা কিছুটা কমে যায়। তবে সেদিনও বাজারগুলো বন্ধ ছিল। দাঙ্গা আর সহিংসতার ভয়ে বাসিন্দারা ঘরের ভেতরেই ছিল। সাবিত্রীর বাবা বলেন, তিনি ছোট করে বিয়ের অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন।

সাবিত্রীর স্বজন পূজা বলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম আমরা সবাই মানুষ। আমরা সবাই দাঙ্গার ভয়ে ভীত। এই দাঙ্গা ধর্মের জন্য নয়। কিন্তু পরিস্থিতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে।’

সাবিত্রীর বাবার বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যখন পুরোহিত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছিলেন, সাবিত্রী আর তার বর যখন সাত পাকে বাঁধা পড়ছিলেন, তখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন সাবিত্রীর প্রতিবেশী মুসলিম ভাইয়েরা। তাঁদের মধ্যে একজন আমির মালিক বলেন, ‘আমরা আমাদের হিন্দু ভাইদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করি।’

বোধি প্রসাদ বলেন, ‘মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাদের কোনো স্বজন আসেননি। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী মুসলিম ভাইয়েরা এখানে আছেন। তাঁরাই আমার পরিবার।’

ঢাকাটআইমস/২৮ফেব্রুয়ারি/ইএস