কাব্যগল্প

মেঘের মঞ্জিল

পিয়াস মজিদ
 | প্রকাশিত : ০৮ মার্চ ২০২০, ১০:৫৮

একগামী আকাশে আমি বহুর জন্য

উড়িয়েছি গান;

বিরহের বারমাস্যা, মিলনমধুর।

তবু স্নায়ুর ভেতর কোনো এক চক্রনৃত্য

শোনাল সেদিন

আমার আমির কাছে

কতটা অচেনা, সঙ্গহারা

নেহায়েত এই আমি।

পরাক্রম ভাঙচুর, নিদ্রা নিহতপ্রায়,

জাগরণ ক্রমশ বিভাবরী যায়।

কার তনুর তরী ভেসে আসে

সোনার জলে

রুপার নৌকায় করে

হীরাভ দুঃস্বপ্ন বয়ে?

শবেবরাতের রাতে

কবরগাহে হেঁটে হেঁটে দেখা

জীবনের দরবারে

সমাধির বিন্যাস কতটা কেমন!

মৃতদের বাতাসে জীবিত বুঝে নেয়

বেঁচে থাকার অথৈ কতটা আনন্দময়

মৃতদের ঠেলে আজিমপুর থেকে

আমি জোরপূর্বক ঢুকে পড়ি

জীবনের দিকে।

ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির

সেই কুটিরে আমার নির্জন কান্নার স্নানঘর

স্নানের আরামে ভুলে থাকি তোমার পুষ্পকুঠি

যে কুঠিতে সবার স্থান হয় ব্যতীত আমি

আমি কি আমিই?

বুদ্ধের হৃদয় বলে তুমি হও আমিহীন

তবে তুমি পাবে রাগ-আনন্দী

আনন্দী নাকি বিষাদভৈরবী?

যা-ই পাই তোমাকে ভুলতে গিয়ে

আমি আমার আমিকে ছেড়ে যাই

ছেড়ে যেতে যেতে ফিরে ফিরে আসি

ফের তোমারই পরিখার ভেতর

তুমি কঙ্কালের কালো কান্না খুঁড়েও

বের করে এনেছ সহস্র শ্বাসের সবুজ মেহফিল

তাই আজ সূর্য পাথর আর রঙিন প্রজাপতিতে

ভরে গেছে এই চরাচর।

ঝরনার ভাষায় কান পেতে থাকি

ওদিকে পাথরও রুদ্ধজীবন ছেড়ে কথা কয়ে ওঠে

জলের মধুমিঠে আর নোনা স্বরে

পৃথিবীতে ফকিরের বাদশাহি রীতি হয়ে গেলে

এই রকম হয়ে থাকে।

তোমার ভাষার শরীর থেকে খুলে নিতে হবে সব

অলঙ্কার, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষামালা

তারপর এই রিক্তের গহনায় সাজাব তোমাকে

নতুন নন্দনে।

যে তুমি কুৎসিত আমার সাজঘর বেছে নেবে

সে আমি তোমার মনোনীত মৃত্যু মেনে নেব

যখন জীবন অস্তমিত দশদিক থেকে

আর এই বিবসন সময়ে

শুধু এক রক্তস্কার্টে ঘনীভূত সমুদ্র

তার নোনা নাচে ডাকে সুরহারা আমাকে;

নৃত্যলুপ্ত বালকের স্থগিত তরঙ্গ

ফের কবে গাবে গান

ঘুমভাঙা মনোহর, জাগরণময়ী!

গ্রীষ্ম ডানাব্যাকুল

আষাঢ়েও আছড়ে পড়ে তোর

ঘামের দু কূল।

নিপুণ নৌকোয় করে

জীবনের জটিল জলাশয়

পার হতে হবে এই বেলা,

ওই পাড়ের আছে কোনো পরমার্থ-পাহাড়।

সমস্ত নৌবিদ্যায় মরচে ধরে গেছে

পুরাতন পারাপারের স্মৃতিও ডুবে আছে পঙ্কে।

পূর্ণিমা তার প্রভায় প্রলুব্ধ করে

জল থেকে টেনে চলে আসমানি আভায়।

বছরের দীর্ঘতম দিনে বসে ভাবছি, ভাবছি

কত ক্ষুদ্রতম খেয়ায় চড়ে যেতে পারি

তোমার তনুর তীরে!

উপহার হিসেবে জীবন বড় সামান্যই

তুমি বরং আমাকে দিও

মোহন মধুর মৃত্যুচুম্বন।

মনে পড়ে,

মন পোড়ে

ছাইগুলো ভাসিয়ে দিই

প্রাণগঙ্গাতে।

তুমি দূর ভবিষ্যৎ-সায়রের ঘাটে বসে

দগ্ধগানের গহন থেকে শুষে নিও

সুরলাগা ভস্মসব।

এই পথে পুড়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ

জয় বাবা ভূতনাথ বলে তবু

ভয় দেখায় কে রে?

আত্মা-ঝরা আমাকে তুমি আর কতটা

অক্ষত দেখতে চাও শ্মশানপৃথিবীর বুকে?

জিন্দেগি এখন বিলয়ের বন্দেগি

ধুলোবালির সারগামে আমার গানের খাতা

উড়ে উড়ে চলে

দোজখের দীপ্ত আঙ্গিকের দিকে।

ডার্ক চকোলেটের প্যাকেট এসে

তার নিকষ সুস্বাদে গ্রাস করে ফেলছে

আমার গোপন কৌটোয় গচ্ছিত

আলোক অবশিষ্ট।

আঁধারের এই ঝরনাধারা...

সার্বভৌম কালো ক্বাসিদায়

ছেয়ে আছে গানঘর।

আর যারা গুম হয়ে গেছে

স্বপ্নেরও অগোচরে,

খরার মৌসুমের চোরা সব স্রোতে

তারা শুধু অবলুপ্ত আমার নাম ধরে ডাকে।

আমি ভয় পেয়ে গর্তে লুকোই

আবার সাড়া দেই গুমের আনন্দে।

তুমি আজ কত দূরে আমার প্রেম থেকে

তোমার ঘৃণা থেকে কত দূরে আমি আজ!

প্রশ্নপাহাড় জেগে থাকুক

নিখিল এই ঘুমের বিতানে।

রৌদের আলপনায় প্রলম্বিত গরমের কাল

উত্তর দিক বা না দিক

আমি বিনাশের কমলা কুঠারে

ছিন্নভিন্ন করে রেখেছি

অন্তর্গত আত্মার অন্ধকার আমাকে।

তোমার প্রেমও আজ সারাতে পারবে না

আমার আহূত আনন্দ অসুখেরে।

ভিনদেশি শহরের বুকে তবু কেন

তোমার নামে ফেলে আসা

আমার গ্রাম জেগে ওঠে!

সেই গ্রামের চায়ের দোকানে

আলগোছে তোমাকে দেখে

বলে ফেলি ‘তোমারও কি

বসতি এই গ্রামদেশে?’

তোমার উত্তর আমি চাইনি

নিরুত্তর তোমাকে ভেবেছি

হৃদয়গাঁয়ের হঠাৎ পাওয়া

প্রতিবেশীরূপে।

লোডশেডিংয়ের কালে

অন্ধকার ও নক্ষত্রের

যুগলবন্দি মোকামে

ভেসে গেছি উড্ডীন ব্যথার দিঘিতে।

দিঘির জলে আমার ছায়া তুমি

ফিরে ফিরে চাও, দেখিতে না পাও।

দেখবার চোখই তো দায়ী

তোমাকে আমার ক্যানভাসে আঁকার

নিঠুর নেপথ্যে।

তোমার চোখে তুমি

না দ্যাখো আমাকে,

ইজেলে উধাও করো

আছি অবশিষ্ট

যতটুকু আমি।

তারপর আমার স্বপ্নের সমাধি

তোমার বাস্তবের গায়ে যেন

ধুলোও না ফেলে।

শুধু কারো হেজেমজে যাওয়া

শ্বাসের বাত্যায় তুমি একটু দাঁড়িও কোথাও

দেখবে সব ছাই সোনা হয়ে গেছে

আমার দগ্ধতার দামে।

আর ক্রুশের কাজলে সেজে ওঠা

আমার আঁখি ডাকতে পারে তোমাকে

মায়া-ইশারাতে।

তুমি দৃশ্য ও আড়ালের ভাষা উভয় এড়িয়ে

পালাতে থেকো জীবনের জঙ্গলে।

জঙ্গল ভয়ংকর তবু তাকে কেটেকুটে

তুমি গড়ে তুলবে এক কুঁড়ে তাজঘর।

সেই ঘরের জানালা দিয়ে ফেলে দেবে

নিত্যকার যা কিছু মালিন্যময়লা

আর দেখবে দূরের কবরে

গ্রীষ্মেও ঢল নামে

বসন্তবাহারের।

জানবে-

মৃত আমার নিজের মুক্তিতে নয়

বরং তোমাকে

আমার কবল থেকে

মুক্তি দেবার আনন্দ-অপারে

ধূসর আমার সমাধিদেশ

এক জীবনে মরতে মরতে

আজ মৃত্যু পেয়েও এমন অনন্য জীবনাভ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :