বিদেশি গল্প

এশক ও আয়না

মূল: ফরহাদ হাসানজাদে 0 ফারসি থেকে অনুবাদ: শাকির সবুর
 | প্রকাশিত : ১০ মার্চ ২০২০, ১০:৪৭

[ফরহাদ হাসানজাদে সাম্প্রতিক ইরানের আলোচিত তরুণ কথাকার এবং ইরানের শিশু-কিশোর লেখক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আবাদানে জন্ম। এখানেই কৈশোর ও যৌবনের প্রথম দিগকার দিনগুলো কাটান। তারুণ্যের প্রারম্ভ থেকেই লেখালেখি, অভিনয় এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ইসলামি বিপ্লবের পর পরই আবাদান ছেড়ে চলে আসেন তেহরানে। তারপর প্রায় ১০ বছর লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে কোনো যোগাযোগই ছিল না তার। দশ বছর পর ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে আবারও লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম শিশু-কিশোর গল্পসংকলন ‘মাজেরায়ে রুবা ভা জাম্বুর’ (শেয়াল ও মৌমাছির কাহিনি) প্রকাশিত হয় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে। এ যাবত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক। বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছেন হাসানজাদে। তার ‘এশক ও আয়না’ গল্পটি প্রথম ছাপা হয় ২০০১ সালের ৩ মে ‘দৈনিক হামশাহরী’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ‘দো চারখে’ শিরোনামে। এ বছরই তার এশক ও আয়না শিরোনামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এশক ও আয়না ছয়টি ভিন্ন ধারার গল্পের সংকলন। মূলত সমাজে বিরাজমান উৎকণ্ঠাই চিত্রিত হয়েছে তার এসব গল্পে।]

আয়নাটা ছিল তার জান।

আর আয়নাটা ছিল ভারী এবং উচ্চতায় তার সমান। বহন করাও ছিল খুবই কষ্টকর। আয়নাটার জায়গায় যদি পলিথিন ব্যাগের এক ব্যাগ চালও হতো সেটাও এমন সুন্দর করে কাটা ডিম্বাকৃতির আয়নাটার চেয়ে বহন করা একশ গুণ সহজ হতো। লোকদের তার দিকে তাকিয়ে থাকাটা ছিল সবচেয়ে অসহনীয়। যেন আয়নাটা তাদের ছবি এবং কঠিন দৃষ্টিসহ সে হাতে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

মনুচেহের কখন দোকানে এসে আয়নাটার অর্ডার দিয়ে গেছে সেটাও ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না সে। শুধু করিম ওস্তাদকে তার এক বন্ধুর দোকান থেকে গ্লাসশীটটা এনে নকশামতো সেটাকে সুন্দর করে কাটতে দেখেছে। ধারগুলো পাথরে ঘষায় আয়নাটা মাছের পেটের মতো মসৃণ হয়েছে।

করিম ওস্তাদ বলেছিলেন, দেখুম কী করস! খুব সাবধান থাকিস কইলাম!

হিম্মত নিজেকে আয়নার ভেতর দেখেছিল আর বলেছিল, ওস্তাদ! আমার কাছে এইডা কিছুই না।

করিম ওস্তাদ পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন, এর চাইতে ভারটাও নিতে পারবি হিম্মত! তাইলে সেন ব্যাটা অইবি। মর্দ অইবি।

মর্দ! ব্যাটা! ভালো করে নিজের ছবিটা আয়নার ভেতর লক্ষ করে হিম্মত। সবে তারুণ্যে পৌঁছার আভাস গোঁফ গজিয়েছে তার। আর দৃষ্টিতে চমকাচ্ছে এক ধরনের দীপ্তি। যৌবনে পা দেয়া ভাঙ্গা স্বর, মুখ ভর্তি ব্রণ আর দীর্ঘ অলীক স্বপ্নে তার দু চোখ ভরা। কাঁধ দুটা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয় সে। মনে-প্রাণে খুঁজে পাওয়া সাহসের সাথে একটা হাত আয়নার নিচে রেখেছিল আরেক হাত ওপরে। প্রথমে এদিক-ওদিক একটু ভালো করে দেখে নিলো; তারপর নিজেকে দ্রুত প্রস্তুত করে নিয়ে করিম ওস্তাদের সামনে এসে দাঁড়াল সে। করিম ওস্তাদ দু পাশের পাকানো গোঁফে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, না, মুনে অইতাছে পারবি না। ভার আছে। থাওক। পইড়া যাইয়া ভাঙবো। রাইখ্যা দে। সন্ধ্যায় সৈয়দ মেহেদীরে কইমুনে, হাত-ঠেলা দিয়া নিয়া যাইবোনি। জাগা মতন রাইখা দে।

হিম্মত কম্পিত স্বরে বলেছিল, না ওস্তাদ! এইডা কোনো ব্যাপারই না। এর চাইতে ভারটাও নিবার পারুম। আমারে পোলাপান ভাবতাছেন!

হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিল সে, ধীরে ও সতর্কতার সাথে।

পথচারী আর হকারদের পাশ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিল। একটা বাড়ির সিঁড়ির সামনে ক্ষণিক থামলো, নতুন করে দম নিতে। দম ফুরিয়ে এসেছিল তার। চেহারাটা আয়নার ভেতর ক্লান্ত আর ঘামে ভেজা দেখতে পেলো। সামান্য হেসে জিহ্বা বের করে নিজেকে নিজেই ভ্যাঙ্গালো। আস্তে করে বললো, শ্যাষের এই দিন কয়ডায় অবশ্যই ভালো কইরা কাম-কাজ করবি। জিনের ক্ষমতা দ্যাখাইয়া দিবি হিম্মত!

করিম ওস্তাদের মুনডা কইলাম পাইতে অইবো!

ক্লান্তি কেটে গেলে আবারো হাঁটতে শুরু করে সে। রাস্তার ওপাশের বইয়ের দোকানের হেদায়েত ওকে দেখে বলে, কিরে হিম্মত! ওস্তাদের কাছে মনিজার প্রস্তাব দিতাছস না ক্যান? হিম্মত লজ্জায় লাল হয়ে বলে, কী কইত্যাছস ছ্যাড়া!

হেদায়েত বলে, সুম্ভাব তার ম্যায়ারে আরেক জনের কাছে দিতাছে। তুইতো ল্যাখাপড়া করলি না... সুম্ভাব...।

হিম্মত তার কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ডিস্টাব করতাছস পাগলা। আমার তো অহনতরি বিয়ার বয়সই অয় নাই। তার বাদে মায় আর বাজানে অবশ্যই প্রস্তাব নিয়া যাইবো, আমি না। তিন নম্বর কতা অইলো আমার তো ট্যাকা-পয়সা কিছুই নাই। কেমনে পড়ালেখা শ্যাষ কইরা ভালা একটা কাম পাইমু।

আবারো ক্লান্ত হয়ে পড়ে হিম্মত। কাচের ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দুর মতো তার উষ্ণ মুখে ঘামের বড় বড় বিন্দু জমা হয়েছে। তৃষ্ণাও পেয়েছে তার। আইসক্রিমের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় এক টুকরো হিমেল বাতাস তার মুখে এসে ঝাপটা দেয়, গতি সঞ্চার হয় তাতে। মন চায় একটু দাঁড়ায়; কিন্তু তা আর হয় না। অনেক কষ্টে সামনের পথ দেখতে হচ্ছে তাকে। দোকানগুলোকে আয়নার ভেতর তেরছা দেখাচ্ছে। দু হাতের তালু গরম হতে শুরু করেছে। ফুটপাতে চলার সময় পায়ের সাথে একটা ইটের গুতো লেগে হুচোট খায় হিম্মত। তবে নিজেকে শামলে নেয় সে। নিজেকে এবং আয়নাটাকেও। আয়নাটাই যে তার প্রাণ। আয়নাটাই তো মনিজা।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, যদি ওস্তাদ আমার কামে খুশি হয় তাইলে পবলেম শ্যাষ। অবশ্যই করিম ওস্তাদের মন খুশি করতে অইবো। মনিজার মন পাইতে অইবো; যদিও ও কিছুই কয়নাই, না আমিই কিছু কইছি তারে; কিন্তু আমার কাছে দিনের ন্যাহাল পরিষ্কার। আমি তো আর গাধা না। তার চাওন দেইখাই বুঝন যায় ব্যাবাক।

সেই দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে তার, যখন মনিজা বরফ নেয়ার ছুতোয় গ্লাসের দোকানে আসতো অথবা কয়েক দিন পার হয়ে গেলে যখন কোনো বাহানা পেতো না তখন মনুচেহেরের সেলুনে এসে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতো।

আয়নাটাই ছিল তার প্রাণ। ওখান থেকে মনুচেহেরের সেলুন খুব একটা পথ ছিল না।

মনুচেহেরকে খুব ভালো করেই চেনে হিম্মত। কিছুদিন প্রতিবেশী ছিল ওরা। একবার ওদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছিল...।

যে কবুতরটা তার পছন্দ হতো সেটা কিনতে না পারলে যে কোনো ছলচাতুরীতে সেটা হাত করতো। মিলিটারি ট্রেনিং থেকে ফিরতেই ওর বাবা আর করিম ওস্তাদ মিলে ওর জন্য ছোট একটা দোকান কিনেছে, যাতে কাজকর্ম একটা কিছু করলে ছেলের বিয়ে দিতে পারে। মিলিটারি ক্যাম্পেই নাকি মনুচেহের চুল কাটার কাজটা শিখেছে এবং পথে এসেছে। হিম্মতও গতরাতে ছাদে শুয়ে শুয়ে ভেবেছে, আমিও আয়নার কাম জানি। দুই বছর বাদেই আমার পড়া শ্যাষ অইবো। তার বাদে মিলিটারি টেরনিঙে যামু, তার পরে মনিজার বাপের সাথে শিয়ার হইমু, এর পর...।

বাজারের নাটমন্দিরের ঘুলগুলি দিয়ে আসা ঝকমকে আলোর হলকার নিচে থেমে নিজের স্থির সংকল্প চেহারার দিকে তাকায় হিম্মত। আকদের অনুষ্ঠানের দৃশ্যটা আয়নায় দেখতে পায়, মনিজার পাশে।

এই ছ্যামড়া সর!

খোদা বালা মসিবত না দেইক! ইনশা আল্লাহ্ শুভ হইবো মনিজা খানম!

শব্দ ক’টা শোনা মাত্রই গতি মন্থর হয় হিম্মতের। শব্দের মালিকেরা একটা দোকান থেকে বের হয়ে আসছে। আয়নার ভেতর তাদের দেখে দাঁড়িয়ে যায় সে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়। মনুচেহের তার মা আর বোন, মনিজা, তার মা আর খালা ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। মনুচেহেরের গলার স্বর ওর মাথার ভেতর ঘণ্টার মতো বাজে।

এইডা আমার সেলুনের আয়না। করিম ওস্তাদরে ধন্যবাদ। ওস্তাদই বটে।

হিম্মতের দৃষ্টি মনিজার মুখের ওপর আটকে গিয়েছিল। এই অবস্থায়ই মনিজার মার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে।

অডার মতনই কাটছে। আল্লায় তোমাগো মুঙ্গল করুক!

হিম্মতের পা দুটো কাঁপতে থাকে। মনিজার দৃষ্টি তার দিকে ছিল না, ছিল তার আয়নার দিকে। তার দৃষ্টি আয়না থেকে সরে গিয়ে কোহিনুর জুয়েলার্সের আলোঝলমল শোকেসে গিয়ে পৌঁছে...।

হিম্মত দেখতে পায় মনিজা হাস্যোজ্জ্বল স্বরে বলছে, এই স্বর্ণগুলা মনে হচ্ছে নতুন।

মনুচেহেরের গলার আওয়াজ হিম্মতকে ধাতস্থ করে, টাশকি মাইরা গেলি ক্যান হিম্মত? দোকানে লইয়া যা, বাবা বইয়া রইছে... যা তাড়াতাড়ি। সুময় মতন মিষ্টিও পাইবি... সাবধানে যাইস ভাঙ্গে না য্যান!

হিম্মতের শুষ্ক কণ্ঠনালী বেয়ে তার স্বর বেরিয়ে আসে, কী ভাঙ্গে না য্যান?

মনুচেহের বলে, আয়নাডা। অন্য সবার দিকে ইশারা করে বলে, চলেন! ম্যালা কাম বাকি আছে।

তারপর চলে যায়। হিম্মত মনুচেহেরের গলার স্বর শুনতে পায়, ব্যাক্কল পোলা! ঘামাইছে!... আজব রকমের ঘামাইছে!

হিম্মত স্বর্ণের গলির মাঝখানে। না তার পা দু’টা তার নিজের ভার রাখতে পারছে, না তার হাত দু’টা ডিম্বাকৃতির আয়নাটার ভর। সবার দৃষ্টি ফিরে আসছে তার দিকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :