ফতোয়ার বলি

লালমনিরহাটে দুই বছর ধরে একঘরে দম্পতি

মাজহারুল ইসলাম বিপু, লালমনিরহাট
 | প্রকাশিত : ১৪ মার্চ ২০২০, ০৮:০৮

রাগ করে স্ত্রীকে মুখে তালাক দিয়েছিলেন তিনি। এরপর ফের সংসার। জহুরুল ইসলামের এই ঘর-সংসারে বাধ সাধল সমাজপতিরা। তাদের ফতোয়ায় দ্ইু বছর ধরে একঘরে জহুরুল দম্পতি।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে শ্রীখাতা বালাপাড়া গ্রামের ঘটনা। সমাজকল্যাণমন্ত্রীর বাড়ির পাশের গ্রাম শ্রীখাতা। তিনিও ঘটনা শুনেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু এখনো একঘরে হয়ে আছেন জহুরুল।

গ্রামের কারও সঙ্গে কারও সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। কারও বাড়ি যাওয়া বন্ধ। বেচাকেনা বন্ধ দোকানপাটে। এক দুঃসহ কষ্টের জীবন কাটছে ওই পরিবারের। একঘরে পরিবারটির সদস্যদের মসজিদে নামাজ পড়তেও দেওয়া হচ্ছে না। তারা এলাকায় কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান করতে পারেন না।

একটি পরিবারের ওপর দিয়ে দুই বছর ধরে এত সব অন্যায় চলে এলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ প্রশাসন। মানবিক বিপর্যয়ের শিকার পরিবারটি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পুলিশে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল পায়নি। কেউ কেউ সহমর্মিতা প্রকাশ করলেও এ সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানা গেছে সরেজমিনে গিয়ে।

জানা যায়, জহুরুল ইসলামের (৬৫) প্রথম স্ত্রী মারা গেলে ২০০৩ সালে তিনি পাশের মদাতী ইউনিয়নের মনজিলা বেগমকে (৩৫) বিয়ে করেন। এরপর স্বামী-সন্তান নিয়ে তাদের দিন ভালোই কাটছিল। বছর দুয়েক আগে পারিবারিক ঝগড়ার একপর্যায়ে জহুরুল মৌখিকভাবে তালাক দেন স্ত্রী মনজিলাকে।

এতে মনজিলা রাগ করে তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে যান। সেখানে তিনি এক মাস অবস্থান করেন। পরে আপোষ-মীমাংসা হলে বাড়ি ফিরে আসেন।

কিন্তু এতে বাধ সাধেন স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ গ্রামের কয়েকজন। এই ‘সমাজপতি’দের ভাষ্য, তালাক কার্যকর হয়ে গেছে। নতুন করে সংসার করা যাবে না। কিন্তু তারা তা অমান্য করে সংসার অব্যাহত রাখায় বালাপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য নুর আমিনসহ কয়েকজন ওই পরিবারকে একঘরে করার ঘোষণা দেন।

তাদের সম্পর্ককে অবৈধ ঘোষণা করে জহুরুলকে মসজিদে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যের জমির ওপর চলাচল কিংবা গ্রামের দোকান থেকে কেনাকাটা করতে দেওয়া হচ্ছে না।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সম্প্রতি জহুরুল তার নাতনির মুখে ভাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এলাকার অনেককে দাওয়াত দেন তারা। গরু ও ছাগল জবাই দেওয়ার জন্য স্থানীয় মসজিদের ইমাম আইয়ুব আলীকে ডাকা হলে তিনি আসেননি। পরে কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মওলানা ডেকে এনে পশু জবাইসহ অন্যান্য ধর্মীয় কাজ করানো হয়। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাদের দাওয়াতে আসেনি।

একঘরে করার বিষয়ে গ্রামের মফিজুল ইসলাম, নুর আমিন, শাহজাহান আলী, আইয়ুব আলী ও মনির মিয়ার বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় অভিযোগ করেছেন মনজিলা।

প্রতিবেশী রেবা, রহিমা, দুলালী ও এরশাদসহ অনেকে বলেন, ঠেক (একঘরে) করার বিষয়ে লিখিত সম্মতিপত্রে গ্রামের ১০০ জন বাসিন্দা স্বাক্ষর করেছেন। তাদের ভাষ্য, এটা আইনের বিষয় নয়, শরিয়ত অনুযায়ী তালাক হয়েছে। তাই তাদের ‘ঠেক’ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে মনজিলা বলেন, ‘বাহে, হামার স্বামী রাগ করি তালাক দিছে। এলাকার লোকজন এটাকে তালাক মনে করে হামাক ঠেক (একঘরে) করেছে। হামার বাড়িত কাও (কেউ) আসে না। হামাকো অন্যের বাড়িতে যাবার দেয় না। এলাকার দোকান থেকে খরচও বন্ধ করে দিছে দেওয়ানিরঘর (সমাজপতিরা)। থানায় অভিযোগ দিলে ওসি সাহেব বলেছেন তার করার কিছু নেই।’

মনজিলা বলেন, ‘বাহে, দুনিয়াত কি ভালো মানুষ নাই? এমন লজ্জা নিয়া কি বাঁচা যায়?’

মনজিলার স্বামী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘হামার মতো গরিব মানুষের সমাজে একা থাকা অনেক কষ্টকর। হামার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। রাগের মাথায় তালাক দিয়েছিলাম। পরে ভুল বুঝতে পেরে ওকে ঘরে উঠিয়েছি। অথচ সমাজপতিরা ধর্মের কথা বলে আমার সাথে অধর্মের কাজ করছেন। মসজিদে নামাজ পড়তে দেয় না ওরা। আল্লাহর ঘর হামার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সমাজপতিরা।’

মসজিদের ইমাম আইয়ুব আলী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘ভয়ে অনুষ্ঠানের গরু-ছাগল জবাই করতে যাইনি।’ নামাজ পড়তে না দেওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

কালীগঞ্জ উপজেলার করিমপুর নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট আবু জাফর বলেন, ‘সালিশ বৈঠকে সবার উপস্থিতিতে বলেছিলাম, শরিয়ত অনুযায়ী এটা তালাক হয়নি। এলাকার লোকজনের কোরআন-হাদিস সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় ওই পরিবারকে তারা একঘরে করে রেখেছেন।’

মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য নুর আমিন বলেন, ‘আমি এককভাবে একঘরে করেনি। সমাজের দশজন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের একঘরে করেছেন।’

মসজিদে নামাজ পড়তে না দেওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মসজিদ সবারই। জহুরুল নামাজ পড়তে পারে, তবে জামাতে নয়, দশজনের সঙ্গে নয়। তাকে আলাদা নামাজ পড়তে হবে। এটা সবার সিদ্ধান্ত। তাকে গ্রামবাসীর সামনে ভুল স্বীকার করতে হবে।’

মুসলিম পারিবারিক আইনে তালাক দিতে হলে লিখিত নোটিশ পাঠাতে হয় স্বামী বা স্ত্রীকে। একই নোটিশ স্বামী বা স্ত্রীর এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছেও পাঠতে হবে। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাদের দুপক্ষকে ডেকে মীমাংসার উদ্যোগ নেবেন। তিনি কোনো উদ্যোগ না নিলে কিংবা দুপক্ষ অথবা যেকোনো একপক্ষ তার ডাকে সাড়া না দিলে তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিনের মধ্যে কার্যকর হয়ে যাবে।

দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খ ম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মনজিলা ও তার স্বামীকে একঘরে করে রাখাটা চরম ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।’

লালমনিরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সফুরা বেগম রুমি বলেন, একঘরে করে রাখার ঘটনাটি সংবিধান ও প্রচলিত আইনকে চ্যালেঞ্জের শামিল। এর সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত। বিষয়টি সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ওসির সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৪মার্চ/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :