মানবপাচার রোধে বিচারপ্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা দূর করা উপায়

প্রকাশ | ২২ মার্চ ২০২০, ২০:০৮

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

এখনো থানায় যেতে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাচার ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বিশেষ করে নারীরা সমাজে জানাজানির ভয়ে থানায় যেতে চান না বলে মানব পাচারের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

রবিবার বিকালে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থায় আয়োজিত এক কর্মশালায় এসব কথা বলা হয়। এখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকার জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ মো. আলমগীর হোসেন। উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএসএইড কর্মশালাটিতে সহযোগিতা করে।

কর্মশালায় নির্বাহী পরিচালক জালাল উদ্দিন স্বাগত বক্তব্যে মানব পাচার প্রতিরোধে বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়সমূহ বর্ণনা করেন।

কর্মশালায় বলা হয়, থানা আদালত, হাসপাতাল ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিরা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন।  

থানায়:

থানায় যেতে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাচার ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বিশেষ করে নারীরা সমাজে জানাজানির ভয়ে থানায় যেতে চান না।

প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে মামলার আলামত সংরক্ষণ করা হয় না। কিছুক্ষেত্রে সঠিক ধারায় মামলা লিপিবদ্ধ করা হয় না।

মানব পাচার প্রতিরোধ আইন সম্পর্কে অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তার সুষ্পষ্ট ধারাণা নেই।

মামলার দীর্ঘসূত্রিতা।

আদালতে:

আদালতে ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আদালতে পাচারের শিকার হয়ে ধর্ষিত হয়েছে এমন মামলায় মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্ট করানোর স্বেচ্ছায় নির্দেশ দেওয়া খুবই সীমিত দেখা যায়।

কিছু আইনজীবী বাদী বা ভিকটিমের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসদারচরণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মানব পাচার ট্রাইব্যুনাল না থানার কারণে নারী শিশু ট্রাইব্যুনালে মামলার পরিচালিত হওয়ায় পাচারের মামলার কাজ সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময় লাগে।

কোনো কোনো জেলায় নারী শিশু ট্রাইব্যুনালে বিচারক না থাকায় মামলার জট দিন দিন বেড়ে চলেছে। 

অধিকাংশ  মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসক এবং স্বাক্ষী ইত্যাদি বিষয়ে প্রক্রিয়াগত জটিলতা দেখা যায়।

হাসপাতালে:

ময়না তদন্ত বিশেষজ্ঞ বা ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকের অভাব।

অভিজ্ঞ প্যাথিলজিষ্ট না থাকা।

কখনও ভিসেরা রিপোর্ট দিতে কালক্ষেপণ করা।

বাস্তবে দেখা যায়, ভিকটিমের হাতে মেডিকেল রিপোর্ট দেওয়া হয় না।

প্রভাবশালীদের চাপে প্রকৃত রিােপর্ট না দেওয়া বা অসত্য রিপোর্ট দেওয়া।

পাচারের পর ধর্ষণের শিকার নারীর আলামত সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে সংরক্ষণ না করা।

প্রকাশ্য আদালতে পাচারের পর ধর্ষণের শিকার নারী বাদি ও স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য দেওয়ায় বিব্রত করা।

অন্যান্য:

সহিংসতার শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচারণের ঘাটতি।

মামলার তারিখ দীর্ঘদিন পর ধার্য হওয়া।

মামলার বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বাদিপক্ষের মামলা পরিচালনা করতে অনীহা প্রকাশ করা।

হাসপাতাল ও থানার মধ্যে সহিংসতার শিকার মামলার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমম্মনয়ের ঘাটতি।

অনেক ক্ষেত্রে চলমান মামলার বাদি বা ভিকটিম অভিযুক্তদের সাথে আপোষ করে। 

স্বাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের অযাচিত হস্তক্ষেপ।

স্বাক্ষীদের কাছে আদালত থেকে সমন যথাসময়ে না পৌছানো।

কর্মশালায় ”মানবপাচার প্রতিরোধে বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়” সম্পর্কে বলা হয়।

বাংলাদেশে মানবপাচার প্রতিরোধ করার  জন্য বেশ কিছু আইন পাস করা হয়। এদেরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ (সংশোধনী ২০০৩ এই আইনের ৫ ও ৬ ধারায় নারী ও শিশু পাচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অন্তভুক্ত করা হয়। এর বাইরেও পাচার প্রতিরোধে অনৈতিক পাচার প্রতিরোধ অ্যাক্ট, ১৯৩৩ নামে একটি আইনও পাস করা হয়। কিন্তু পরে দেখাযায় এসব আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই প্রয়োজনীয়তা থেকে ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটির সৃষ্টি। মানব পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেশন, ২০০০ এবং সার্ক কনভেনশন অনুসরণ করে সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত আন্তঃদেশীয় অপরাধগুলো প্রতিরোধ ও দমনের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে এই আইনকে সংঙ্গতিপূর্ণ করা হয়।

এই আইনের ফলে ২০০০ সালে পাশকৃত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৫ ও ৬ ধারা এবং একই সাথে অনৈতিক পাচার প্রতিরোধ অ্যাক্ট, ১৯৩৩ নামে আইনটি অকার্যকর করা হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ২১ (২) ধারা অনুযায়ী, অপরাধসমূহ বিচারের জন্য দায়রা জজ কিংবা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদ মর্যদার বিচারকের সমম্ময়ে ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। ফলে এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এই মামলার বিচার চলছে। এ ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রিতা, ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আইনটির পরিপূর্ণ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ও উইএসএইডের আর্থিক সহায়তায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা জেলায় পুলিশ প্রসিকিউটর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মশালায় জেলা আদালতে মানব পাচার আইনে হওয়া মামলার তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল।  সেসব তথ্য পূনরয় অনুসন্ধান ও কর্মশালার সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও বর্তমান অবস্থা এ কর্মশালায় উপস্থাপন করা হচ্ছে।

ঢাকা জেলায়  ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোট কতগুলো মামলা হয়েছে তা সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে জেলার মোট ৬২৪টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মামলাগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখাযায়, তদন্তকারী কর্মকর্তা ১১২ টি মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন ও ৩৮২ টি মামলার অভিযোগ পত্র (চার্জশিট) দিয়েছেন আদালতে। ৫৪ টি মামলা এখনও তদন্তাধীন ও ৭৬ টি মামলা থেকে আসামিদের অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।  অভিযোগপত্র দেওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ৩২১ টি মামলা চার্জ শুনানি গঠন, ও স্বাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

বর্তমানে মামলাগুলির ধারা প্রকৃতি বিশ্লেষণ, বিভিন্ন কর্মশালা থেকে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের সুপারিশ পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা মানব পাচার প্রতিরোধে ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার কারণ উপস্থাপন করেছেন।

কর্মশালায় ঢাকা মানব পাচারের আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আলী আজগর স্বপন, ঢাকা জজ  আদালত ও হাইকোর্টের বিভিন্ন আইনজীবী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের শিক্ষার্থীগণ উপস্থিত ছিলেন। 

ঢাকাটাইমস/২২ মার্চ/এএ/ইএস