মন্ত্রীবাহাদুর, পিপিই এবং একজন চিকিৎসক

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২০, ১৪:১৯ | প্রকাশিত : ২৪ মার্চ ২০২০, ১৪:০৮
পিপিই এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী

আমার এক ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। মুঠোফোনে। বলছিলেন, কতটা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। হাসপাতালে গিয়ে তো আর বসে থাকতে পারেন না। রোগী আসে, দেখতে হবে। কার শরীর কভিড-১৯ ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে, মুখ দেখে তো বলা যায় না।

নানান সমস্যা নিয়ে মানুষ হাসপাতালে আসেন। কেউ আসছেন জ্বর নিয়ে। ওষুধ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কেউ আসছেন কেবল সর্দি নিয়ে। জ্বর নেই, কাশিও নেই। আবারও কারো শুধু কাশি। এই ধরনের রোগীদের তারা পরামর্শ দিচ্ছেন অন্তত ১৪ দিন বাসায় থাকতে। বাসা থেকে বের হওয়া বারণ।

এভাবে আরও অনেক ধরনের রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, হাসপাতাল থেকে খুব বেশি হ্যান্ড গ্লাভস বা মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে কিনতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রিও (পিপিই) পর্যাপ্ত নেই। অন্য সময় সার্জারির সময় যেগুলো ব্যবহার করা হয়, সেইগুলোই ব্যবহার করতে হচ্ছে।

আলাপের এক পর্যায়ে বললেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দিয়ে একদিন হাসপাতালে ডিউটি দেওয়াতে পারলে হতো।’

বললাম, ‘কেন? তিনি তো চিকিৎসক নন।’

‘এজন্যই তো দরকার। বুঝতে পারতেন, আমরা কী ঝুঁকিতে আছি। অথচ ভদ্রলোক বলে বেড়াচ্ছেন, এখনো নাকি পিপিইর এতো প্রয়োজন নেই। তাহলে কবে প্রয়োজন হবে?’

বললাম, ‘বাদ দেন মন্ত্রীদের অতিকথন এ আর নতুন কী?’

তিনি এবার খানিক উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘আপনারা এগুলো লেখেন না কেন? অতিকথনে কি মহামারী বন্ধ করা যায়? তারা কি কিছু টের পাচ্ছেন? নিজেরা চড়ছেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। যারা গণপরিবহনে চড়েন, তাদের কী অবস্থা, খবর রাখছেন?’

তাকে শান্ত করার জন্য বললাম, ‘চীনে যখন করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল, তখন তাদের কাছেও পিপিই ছিল না।’

চিকিৎসক বন্ধু এবার হো হো করে হেসে উঠলেন। ‘আপনিও দেখি তোতা পাখি হয়ে গেছেন!’

‘তোতা পাখি হতে যাবো কেন? কী বলছেন!’

‘ওই যে মন্ত্রী যা বলেছেন, তাই শুনে উগড়ে দিলেন। আপনি কি চীনে গিয়েছিলেন ওই সময়? নাকি মন্ত্রী গিয়েছিলেন?’

‘যেতে হবে কেন? মিডিয়ায় খবর আসে না।’

‘কোথায়, একটা খবর দেখাতে পারবেন এই রিলেটেড? চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কি মন্ত্রীকে ফোন করে এ কথা বলেছেন? তাছাড়া চীনের আগে তো অন্য কোথাও এই ভাইরাস ছড়ায়নি। তাও তো তারা খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পেরেছে। আর আপনার দেশের মন্ত্রী সেই তিন মাস আগে থেকে বলে আসছে, তারা প্রস্তুত আছে, প্রস্তুত আছে। কোথায় প্রস্তুতি? কোয়ারেন্টিনের জন্য এখন কেন দিয়াবাড়ি আর ইজতেমার মাঠে নেওয়া লাগছে লোকজনকে? আগে এই ব্যবস্থা করা যায়নি?’

বললাম, ‘কেন হজ ক্যাম্পে তো ব্যবস্থা ছিল। সেখানে তো...’

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তিনি বললেন, ‘ব্যবস্থা না ছাই ছিল। দেখেন নাই, কীভাবে রাখা হয়েছিল তাদের? একটা ওয়াশরুম একশ জন ব্যবহার করছে। কী নোংরা! সবাই গাদাগাদি করে বসে আছে। এটাকে কোয়ারেন্টিন বলে? প্রবাসীরা যে মারধর করেনি কাউকে এটাই ভাগ্য, কেবল পালিয়েছে এই যা।’

বুঝলাম চিকিৎসক বন্ধুর ভাবগতি ভালো নয়। প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘আর যাই বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা কিন্তু আমেরিকা ইতালির চেয়েও বেশি সফল।’

এবার তিনি যেন আরও বেশি ক্ষ্যাপে গেলেন। বললেন, ‘ওই তো মন্ত্রীর কথাই বললেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীই তো কদিন আগে বললেন এই কথা। কী হাস্যকর! ভাবতে কষ্ট হয়, এরা আমাদের মন্ত্রী! এরা দেশ চালায়। এদের হাতে স্বাস্থ্যখাত!’

বললাম, ‘বাদ দেন তো। করোনা নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই। এটা মারাত্মক কিছু নয়, ছোঁয়াচে। শুধু করোনা করোনা শুনতে শুনতে ঘুমের মধ্যেও করোনা বলে আঁতকে উঠি। আপনি চিকিৎসক মানুষ। একটু আশার কথা বলেন।’

তিনি এবার হাসতে লাগলেন। তবে আগের মতো হো হো করে নয়। হাসি থামিয়ে বললেন, ‘এই কথাটাও মন্ত্রী।’

বললাম, ‘কোনটা?’

‘এই যে মারাত্মক কিছু নয়, ছোঁয়াচে।’

‘তো, তিনি ভুল কিছু বলেননি। এত কী আর মারাত্মক! জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্ট। এই যা। এগুলো তো আমাদের দেশের মানুষের কমন রোগ।’

‘ভাই আপনার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলাই ভুল হয়েছে। সময় অপচয়। কোথায় মনে করলাম করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিক হিসেবে আপনাদের কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা, জানতে চাইবো, আপনি সেই মন্ত্রীবচন উগড়ে দিলেন। করোনা যদি এতই মামুলি রোগ হবে, তাহলে সারা পৃথিবীতে সাড়ে ১৬ হাজার লোক কী করে মরলো? ইতালিতে প্রতিদিন পাঁচশজন করে মারা যাচ্ছে। তারপরও বলবেন, মারাত্মক কিছু নয়! ছোঁয়াচে রোগ! জানেন তো, নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না’।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, ‘আচ্ছা নিরাপদে থেকে দয়িত্বপালন করেন। কে কী বললো, এসব নিয়ে পড়ে না থেকে মানুষের জন্য কাজ করেন। মন্ত্রীরা কথা পর্যন্তই সাড়। কাজের কাজ কিছুই করতে পারবেন না। এটা আপনিও জানেন, আমিও জানি। কাজ করতে হবে আপনার-আমার মতো মানুষকেই। তাই করুন।’

তিনি ফোনটি রাখার আগে বললেন, ‘কিন্তু অতিকথন তো মানুষকে বিভ্রান্ত করে। কষ্ট দেয়। এটা কি মন্ত্রী বাহাদুররা বোঝে না?’

বললাম, ‘মন্ত্রীর ব্যক্তিগত নম্বরটা জোগাড় করে প্রশ্নটি তাকেই করেন। তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’

(ঢাকাটাইমস/ ২৪ মার্চ/ এইচএফ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :