দিল্লিতে গৃহহীন মুসলিমদের ছাড়তে হলো ক্যাম্পও

প্রকাশ | ২৬ মার্চ ২০২০, ১৫:২১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস

এখনও রাস্তার দুই ধারে পোড়া পোড়া বাড়ি। কোনো বাড়ির ছাদ নেই। কোথাও ভেঙে পড়েছে দেয়াল। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দোকান ঘরের ভিতর এখনও টাটকা সন্ত্রাস। মাস কেটে গিয়েছে, করোনায় লকডাউন দিল্লি। কিন্তু সেই ক্ষত মুছে যায়নি। শুনশান রাস্তার ধারে ইতিহাসের দলিল হয়ে জেগে রয়েছে জনমানবহীন কিছু কাঠামো।

উত্তরপূর্ব দিল্লিতে ভয়াবহ সহিংসতার পর গৃহহীন, দিশাহীন মানুষদের জন্য বেশ কিছু ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। কোনো ক্যাম্প তৈরি করেছিল দিল্লি সরকার। কোনো ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল ব্যক্তি বা সংস্থার প্রচেষ্টায়। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই সব অপরিসর আস্তানায়।

 

কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পের পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কা করেছিনলে ক্যাম্পের চিকিৎসকরা। তারা জানিয়েছিলেন, করোনা ছড়িয়ে পড়লে অপরিসর ক্যাম্পে গায়ে গায়ে বেঁচে থাকা মানুষেরা আরও বিড়ম্বনায় পড়বেন। পড়লেনও।

মঙ্গলবার সরকারের উদ্যোগে তুলে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ক্যাম্প। ক্যাম্পের অধিবাসীদের বলা হয়েছে ফিরে যেতে নিজেদের বাড়ি। আর যাদের বাড়ি নেই, ধ্বংস্তূপে পরণত হয়েছে যাদের বাসা, তাদের হাতে  তিন হাজার টাকা তুলে দিয়ে বলা হয়েছে, বাড়ি খুঁজে নিতে। খবর ডয়চে ভেলের।

শুধু ক্যাম্প নয়, করোনার কারণে যথেষ্ট আপত্তি সত্ত্বেও উঠে যেতে হয়েছে শাহিনবাগকে। প্রায় ১০০ দিন ধরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, এনপিআর নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েছিলেন সাধারণ ঘরের অসংখ্য নারী। এর আগে রাজনীতি বা আন্দোলনের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। শাহিনবাগ মডেল হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশে। রাজ্যে রাজ্যে শাহিনবাগ তৈরি হয়েছিল। করোনার কারণে আপাতত সেই সমস্ত আন্দোলন বন্ধ হয়েছে। হয়ত লকডাউন শেষ হলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হবে। আন্দোলনকারীরা অন্তত সে কথাই বলছেন।

কিন্তু ক্যাম্পের মানুষেরা? অযাচিত দাঙ্গা কেড়ে নিয়েছিল তাদের গৃহ। তারা যেচে ক্যাম্পে আসেননি। মাঝরাতে পেটে চার সপ্তাহের সন্তান নিয়ে যে মহিলা দেখে ছিলেন নিজের বাড়ি ছাই হয়ে যেতে, আক্রমণকারীদের তাড়া খেয়ে যিনি মাইলের পর মাইল দৌড়ে একটা ত্রিপলের আশ্রয় পেয়েছিলেন, কী হবে তার? মাত্র এক সপ্তাহ আগে মুস্তাফাবাদের ক্যাম্পে এক মুখ আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে সাংবাদিককে সেই মহিলা বলেছিলেন, 'ওই রাতে পেটের বাচ্চাটা মরে গেলেই ভাল হত বোধহয়। ওর জন্ম হলে কোন পৃথিবী উপহার দেব ওকে? জন্মের মুহূর্তেই তো ও জেনে যাবে ওর কোনো বাড়ি নেই, কোনো আশ্রয় নেই।'

বুধবার সেই মহিলাই ফোনের ও প্রান্তে কেবলই নিঃশ্বাস নিয়ে গেলন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি নেই। জানেন না, এরপর এই ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে পেটের বাচ্চাকে কোন আশ্রয়ে পৌঁছে দেবেন।

ক্যাম্পের চিকিৎসক ওয়াসিম বলছিলেন, ক্যাম্প বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। যেভাবে করোনা ছড়াচ্ছে গোটা দেশে এবং দিল্লিতে, তাতে সংক্রমণের ভয় করছিলেন সকলেই। মুস্তাফাবাদের ক্যাম্পে যেভাবে গায়ে গায়ে ছিলেন মানুষ, তাতে একবার সেখানে সংক্রমণ ছড়িয়ে গেলে তা মহামারির চেহারা নিত। কিন্তু একই সঙ্গে ওয়াসিমের বক্তব্য, ক্যাম্পে তাও খানিকটা আশ্রয় পেয়েছিলেন এখনও আহত, আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত কয়েক হাজার মানুষ। এবার তারা কোথায় যাবেন, কী করবেন, কেউ জানে না।

সরকার নির্দেশ দিয়েছে, যাদের বাড়ি এখনও সামান্য অক্ষত, তারা যেন বাড়ি ফিরে যান। আর যাদের নেই, তাদের ভাড়াবাড়ি খুঁজে নিতে হবে।

স্থানীয় প্রশাসন এবং ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ির ব্যবস্থা করছেন। তবে তা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ক্যাম্পে ছিলেন শাবানা আনসারি। ফিরে যাওয়ার মতো বাড়ি নেই তার। সব জ্বলে গিয়েছে। এক কাপড়ে সন্তানদের নিয়ে ক্যাম্পে চলে এসেছিলেন। তার প্রশ্ন, 'তিন হাজার টাকা আর কিছু চাল-ডাল নিয়ে এতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় বাড়ি খুঁজব? কে দেবে বাড়ি আমায়?'

দিল্লিতে এমনিতেই এখন বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বাড়িওয়ালারা ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। লকডাউনের পরে বাড়ি পাওয়া আরও মুশকিল। পুলিশ রাস্তায় হাঁটতে চলতে দিচ্ছে না। পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ। এই অবস্থায় ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত মানুষেরা আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন। অনেকেই বলছেন, ক্যাম্পে থেকে করোনা হলে অন্তত একটা হাসপাতালে পৌঁছনো যেত, অন্তত কিছুদিন মাথা গোঁজার একটা জায়গা পাওয়া যেত। এখন সেটুকুও নেই।

আর যারা ফিরেছেন নিজেদের বাড়ি? দশ বছরের এক শিশু টেলিফোনে সাংবাদিককে বলেছেন, নিজের বাড়িতে ঢুকে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। কেবলই মনে হচ্ছে হাতে অস্ত্র নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে শেষ করে দেবে কিছু হিংস্র মানুষ। চোখ বুজতে হচ্ছে না, খোলা চোখেই দৃশ্যগুলি ভেসে আসছে বার বার।

শিশুর বাবার বক্তব্য, 'বাড়ি তো ফিরে এলাম। কিন্তু সামান্য জিনিস কিনতে পাড়ার দোকানে যেতেও ভয় হচ্ছে। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়। যে আগুনকে পিছনে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেই আগুনের ভিতরেই আবার ঢুকে পড়লাম মনে হচ্ছে। এ ভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব।'

গোটা দিল্লির মুখে এখন কেবলই করোনা। উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত, গরিব-এলিট সকলেই ২১ দিনের লকডাউনকে স্বাগত জানিয়েছেন। সকলেই বুঝতে পারছেন, করোনা ছড়াতে শুরু করলে কী সাংঘাতিক পরিস্থিতি তৈরি হবে। শুধু উত্তরপূর্ব দিল্লির এক বিশাল অঞ্চল করোনা আতঙ্ক টের পাচ্ছে না। জীবনই তাদের কাছে এখন সব চেয়ে বড় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা টাইমস/২৬মার্চ/একে