করোনায় দূরদর্শিতা ও মানবিকতার জন্য হাহাকার

হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
| আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২০, ২৩:৪৯ | প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০২০, ১৮:১৩

শ্বাসরুদ্ধকর একটি পরিবেশের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবী থমকে গেছে। ডিসেম্বরের আগে হয়তো পৃথিবীর কোনো মানুষই এটা কল্পনা করতে পারেনি। এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে আমরা যাচ্ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যে মানুষের মধ্যে অনেক হিসাবনিকাশ হয়েছে। সেটা যে ঠিক এভাবে আসবে আমরা এটাও কেউ হয়তো ভাবতে পারিনি।

সারা পৃথিবী এক অজানা, অচেনা শত্রুর কাছে ধরাশায়ী হয়ে গেছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বেশেষে এর স্বীকার। আমরা সবাই এখন ঘরে বসে আছি। এই ঘরে বসে থাকাটা কেউ বাধ্য করেনি। চাপিয়ে দেয় নি। প্রত্যেকটা মানুষ সচেতন হয়ে নিজেরাই ঘরে অবস্থান করছে। যেটাকে হোম কোয়ারেন্টিন, বা লকডাউন যায় বলি না কেন। আমরা সচেতন মানুষ সবাই স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি অবস্থায় আমরা আছি।

বর্তমানের এই অচল সময়ে আমাদের দুইটা বিষয়ের খুব বেশি দরকার। একটি হচ্ছে মানবিকতা ও দুরদর্শিতা। এই দুটো বিষয় আমরা যেন দিনকে দিন হারিয়ে যেতে বসেছি। দিনকে দিন আরও দূরে সরে আচ্ছি। গতকালের রাতটা আমার খুব বাজেভাবে গেছে। সরকারের একটা সিদ্ধান্তের জন্য। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের একটি পরিপত্রের জন্য।

আমি একজন চিকিৎসক। চিকিৎসক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে। যখন সারা পৃথিবীব্যাপী যে যুদ্ধ। কোভিট-১৯ বা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সবচেয়ে ফ্রন্ট লাইনে যারা কাজ করবেন। অর্থাৎ চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের আস্থা অর্জন করার জন্য, তাদেরকে ভালোভাবে বুঝে এই যুদ্ধে সামিল করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বাইরের দেশে যেখানে অনেক চিকিৎসক মারাগেছে। উহানে যিনি প্রথম ডাক্তার এই ভাইরাসের সতর্কবানী দিয়েছিলেন। তিনিও পরে মারা গেলেন।

এইযে চীন সরকার প্রথমে ভুল করল। পরে তারা ভুল বুঝতে পেরেছে। ভুল স্বীকার করেছেন। পরে তারা তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন।

আমরা যদি দেখি আমাদের বাংলাদেশের উচ্চ আদালত। মহামান্য আদালত যেখানে জাতীয় বীর হিসেবে কেন গণ্য করা হবে না এই মর্মে একটা রুল জারি করেছেন চিকিৎসকদের জন্য। তখন আমরা সবাই আশায় বুক বাঁধি। আমরা যারা সরকারি উচ্চপদস্থ আমরা সবাই ভুক্তভুগি। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করছি। এই যুদ্ধে যে প্রথম সারি সেখানে তো শুধু স্বাস্থ্যকর্মীদেরই যাবার কথা। এরপরে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষীরা, আইনশৃঙ্খলা বাহীনিরা রয়েছেন। পরিচ্ছনতা কর্মীরা রয়েছেন। আমি সবার কথায় স্বীকার করি।

আমি কালকে লিখেছিলাম এই করোনার সঙ্গে সকল স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা কর্মী যারা। অর্থাৎ যারা ঝুকি নিয়ে কাজ করছেন। সবাইকে ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হোক। আমার মনে হয়েছে যে যারা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। তারা কেন ঝুঁকি ভাতা পাবেন না।

তারপর রাতের বেলায় দেখলাম আমাদের একজন স্বাস্থ্য উপসচিব স্বাক্ষরিত একটা পরিপত্র জারি করা হয়েছে। সেখানে একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সেখানে হাসপাতাল কতৃপক্ষ বলা হয়েছে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ যদি কোনো সেবা না দেয় বা সেখানে ন্যক্কারজনকভাবে বলা হয়েছে- পুলিশকে জানান। থানাকে জানান। সেনাবাহিনীকে জানান। এই বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে হয়েছে। সেখানে সারা পৃথিবীতে এই মহামারী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে হচ্ছে। কাল আমাদের মসজিদের এক হুজুর বলছেন এই যুদ্ধে বড় বড় নায়ক নায়িকা , গায়ক গায়িকা টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারবে কিন্তু এই করোনার বিরুদ্ধে তো যুদ্ধ করতে পারবে না। এই যুদ্ধ কেবল স্বাস্থ্য কর্মীরায় করতে পারবে।

যখন বিষয়টি সবাই বুঝতে পারে। উচ্চ আদালত বুঝতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন এই যুদ্ধে চিকিৎসকদের থাকতে হবে। আমরা দেখছি ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেখানে চিকিৎসকদের দেবতাতুল্য করে বলেছেন। সেখানে আমাদের দেশে খুবই ন্যক্কারজনক ভাষায় লেখা হয়েছে। একটা ভুল হয়েছিল যেটা শুধরানো হয়েছে। সেটা ফলো করে মন্ত্রণালয় আর একটি সার্কুলার দিয়েছিল সেটা স্থগিত রেখেছে। এখন পর্যন্ত টেলিভিশন পেপার পত্রিকায় যে তথ্য আসছে তাতে আমি খুবই মর্মাহত।

আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে বলছি তা নয়। এখন তো সারা দেশের কল্যানের জন্যই সব স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবলকে চাঙ্গা রাখতে হবে। এখন যে পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ঠি কাছাকাছি পরিমান ডাক্তার কোয়ারেন্টিনে আছে। অর্থাৎ ঝুঁকির মধ্যে আছে। দুই একজন তো শনাক্তও হয়ে গছে।

কিছু ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। যেমন পার্সোনাল প্রটেকশনের ইকুইপমেন্ট নিয়ে আমরা দুই ধরনের বক্তব্য পাচ্ছি। আমি নিজেই একজন সরকারি চিকিৎসক হিসেবে এই কথাগুলো কেন বলছি? বলছি একারণে যে আমরা তো চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমাদের এখন যারা পলিসি মেকিংয়ে আছেন। যেমন স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি বা এডিজি যারা আছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের বয়স দুই এক বছরের পার্থক্য হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনেক পরিচালক আছেন যারা আমাদের চেয়ে জুনিয়রও আছেন।

আমরা মনে করি আমাদের কিছু ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। আমাদের কয়েকজন দ্বায়িত্বশীল জায়গা থেকে বলেছেন যে ডাক্তাররা অজুহাত খুঁজছেন। এমন কথা কোনোভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়। এটা পরিবেশকে আরো উসকে দিচ্ছে।

এমনিতেই চিকিৎসকের মধ্যে পার্সোনাল ইকুইপমেন্টের অভাব। পিপিই নিয়ে যেখানে ক্ষোভ রয়েছে। তারাও আতঙ্কিত। এই ভাইরাস তো কাউকে ছাড়ে না। তাদের আস্থায় আনার জন্য এর মধ্যে যদি কোনো গরমিল থেকেও থাকে। হয়তো তারা মনে করছেন অভাবে আছে। উনারা মনে করছেন অভাব নেই। হয়তো সাপ্লাই দিয়েছে। স্থানীয়রা নেয় নি।

আমি এটি নিয়ে আইইডিসিআর এর উচ্চপর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মাঝেও কিছু অসহায়ত্ব আছে। নানানমূখী চাপও আছে এখানে। আমরা ওই অর্থে সভ্য হতে পারিনি। এই জাতীয় সংকটের সময় কীভাবে কথা বলা উচিৎ। বা ব্যক্তিগত, দলীয় বা রাজনৈতিক পর্যায় থেকে না নিয়ে কীভাবে এটা নিয়ে সবাই মিলে কাজ করা যায়। সেটা হয়তো আমরা সবাই অর্জন করতে পারিনি।

আবার নাগরিক হিসেবেও আমরা সভ্য হতে পারিনি। এইযে ছুটি পেয়ে হাজার হাজার মানুষ চলে গেল। বাস, ফেরি, ট্রেনে যেভাবে চলে গেল। এখানে আমরা দ্বায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দিই না। সেক্ষেত্রে আমাদের ডাক্তারদের মাঝে দুই একজনের ভুল হতে পারে না তেমন তো নয়। আমি নিজেও আমার পেশার অনেক সময় সমালোচনা করি। পেশার মানুষদের সমালোচনা করি। কিন্তু যখন ঢালাওভাবে এরকম অসম্মানজনক কথাবার্তা বলা হয় তখন খুব কষ্ট লাগে। খুবই মর্মাহত হই।

যেখানে ডাক্তারদের এমন চরম সঙ্কট মুহূর্তে সাহস দিয়ে অনুকূল পরিবেশ দিয়ে পাশে নিয়ে আসতে হবে। এখন প্রজ্ঞা দুরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। ধৈর্যধারণ করতে হবে। অনেকে চিকিৎসক নেতাদের প্রতি অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

চিকিৎসক যদি সুরক্ষা না পান তাহলে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। এটা জনগণের স্বার্থে দেখতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা আগে দরকার। আমাদের সবারই ভুল হতে হবে। তবুও বলছি এই যুদ্ধে প্রথমসারিরর যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দিবেন না।

গতকালকে কোনো নতুন রোগী শনাক্ত হয়নি। তারমানে এই নয় যে বাংলাদেশ ঝুকিমুক্ত হয়ে গেছে। ঝুঁকি রয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বের যেখানে অবস্থা খুব খারাপের দিকে। সেখানে আমারাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। স্পেন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে।

আমাদের তো সেই রকম বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। আইইসিডিআর এর কতটুকু সক্ষমতা আছে? শনাক্তকরন কীট আছে শুধু আইইডিসিআরের কাছে। মানুষের মাঝে দুই একটা বিষয় নিয়ে ধোয়াশা রয়ে গেছে। এপর্যন্ত সাড়ে আটশ জনকে পরীক্ষা করানো হয়েছে। সেখান দক্ষিণ কোরিয়া । চায়নার পাশের দেশ। তারা প্রতিদিন ১০ হাজার পরীক্ষা করিয়েছে। আমরা যেখানে যারা সন্দেহ করছে তাদের পরীক্ষা করেছি। এর বাইরে নয়। যারা আসেনি তাদের পরীক্ষা করা হয় নি। সুতরাং পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সংকীর্ণতা শুরু থেকেই হয়েছে।

বর্তমানের এমন পরিস্থিতিতে এত ভুলত্রুটি, খোঁচাখুঁচি না করে আসুন সম্মিলিতভাবে এটার বিরুদ্ধে কাজ করি। কথাবার্তা সংযত হয়ে পরিমিত বলি। ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি করি। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে। না হলে স্বাস্থযকর্মী যদি কোয়ারেন্টিনে চলে যায় বা অসুস্থ হয় তাহলে মহাবিপদ হবে। সমস্যা বাড়বে।

আর যেহেতু বিষয়টার সমাধান হয়েছে। সেহেতু সব ভুলে এই যুদ্ধে নিজেদের আত্মনিয়োগ করি। নিজেদের সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন থাকব। সবার মানবিকতাকে প্রাসারিত করি। আমরা মানবিক হই। কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎকের কাছে চিকিৎসা নিতে এসে যেন কেউ ফেরত না যায়। আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধ যেন টিকিয়ে রাখতে পারি।

সবাই এসময় ঘরে থাকি। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হব না। বারবার হাত ধুয়ে ফেলুন। সুস্থ থাকুন।

হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন: চিকিৎসক, প্রতিষ্ঠাতা ও জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ ক্যানসার ফাউন্ডেশন এবং এসোসিয়েট প্রফেসর, মিনিস্ট্রি অব হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার।

ঢাকাটাইমস/২৬মার্চ/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :