সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা

কর্মীদের টাকা লুটতে তৈরি হচ্ছে মালিকরা

মোল্লা জালাল
 | প্রকাশিত : ২৯ মার্চ ২০২০, ১৪:২৩

ষাটোর্ধ বয়স। হার্টে বাইপাস করা। ডায়বেটিস বেশি, ফলে কিডনিও আক্রান্ত হচ্ছে। দুই পায়ে হাঁটুর নিচে ভাসকুলার ব্লক। ফলে হাঁটতে কিছুটা সমস্যা হয়। এসব কারণে খুবই নিয়মের মধ্য দিয়ে আমার দিন কাটে। খালি ও ভরা পেটে সুগার লেভেল দেখে নিয়মিত ইনস্যুলিন নিই।…

১০ মার্চ ডাক্তার আমাকে বাসা থেকে বের হতে বারণ করলেন। তার যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু আমার বয়স ষাটোর্ধ, ডায়াবেটিস বেশি, হার্টে বাইপাস, কিডনিতেও সমস্যা আছে, শ্বাসকষ্টের জন্য নিয়মিত ইনহেলার নিতে হয়, সুতরাং করোনা ভাইরাস আমার জন্য খুবই বিপজ্জনক। অতএব আক্রান্ত না হলেও হোম কয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। প্রথম দিকে কয়েক দিন এভাবেই কেটে যায়। সকল মিডিয়ায় তখন প্রধান আলোচনা করোনা ভাইরাস নিয়ে। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা। যে যার মত করে ষ্ট্যাটাস দেয়া শুরু করে। ফলে সতর্কতার পাশাপাশি আতঙ্কও ছড়াতে থাকে। আতঙ্কের ধাক্কা এসে আমার হোম কয়ারেন্টিনেও লাগে। খুলানায় কর্মস্থল থেকে স্ত্রী আর কানাডা থেকে ছেলে আমাকে গৃহবন্দী করার জন্য প্রতিদিন নির্দেশ দিতে থাকে। ফলে এখন আমি বাসার একটি ঘরে সম্পূর্ণ আইসোলেটেড।…

‘মাঝেমধ্য ভাবি, কে আমাকে গৃহবন্দী করল, কার হুকুমে...। ভিতর থেকে জবাব আসে ‘মৃত্যুভয়’। শুধু আমাকে নয়, গোটা বিশ্বের সবাইকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে যে শক্তি তার নাম ‘ভয়’। আর এ ভয়ের কারণেই বিশ্ববাসী এখন নিয়ম মেনে চলছে। এ নিয়ম যার তার মনগড়া নিয়ম নয়, সরকারের নিয়ম। প্রত্যেক দেশের সরকার তার নাগরিকদের জন্য নিয়ম করে দিয়েছে। সকলেই ওই নিয়ম মেনে চলছে।

‘এই মহাদূ্র্যোগ থেকে বাঁচতে হলে প্রত্যেককে নিয়ম মানতেই হবে। আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়েজিত ডাক্তার নার্স স্বস্থ্যকর্মী, নিয়ম রক্ষায় নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, তথ্য দেয়ায় সংবাদকর্মী। এরা প্রত্যেকেই মানুষ। তাদেরও জীবন আছে। আছে স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিবার পরিজন। তাদেরও সুরক্ষা প্রয়োজন। ভারতে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরকার জনপ্রতি ৫০ লাখ টাকার বীমার প্যাকেজ দিয়েছে। গরিব মানুষদের বিনা মূল্যে ৩ মাস রেশন দিবে। আরো অনেক সামাজিক সুরক্ষার চিন্তাভাবনা চলছে।

‘বাংলাদেশেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পোশাক শ্রমিকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সাথে সাথেই একশ্রেণীর লুটেরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে প্যাকেজ লুট করার জন্য। পাশাপাশি প্যাকেজ সুবিধা নেওয়ার জন্য একের পর এক দাবিদারও বাড়তে শুরু করেছে। সবাই হিসাবের খাতাপত্র খুলে বসছে, কার কত চাই...। অথচ এসব লুটেরা মালিকরা কেউই নিজেদের কর্মীদের জন্য কিছুই করছে না। তারা লাভ চায়, লাভের আশায় কারখানা বন্ধ করে না। বাজারে ক্রেতা নেই তবুও উৎপাদন দরকার।

‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মহামারি ও আপৎকালে মাফিয়ারা অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত করার জন্য মানুষের জীবনকে বাজি ধরে। এদের কোন দয়া মায়া নেই। এরা শুধু মুনাফা বুঝে। প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজের টাকা রাষ্ট্রের। এ টাকা শুধুমাত্র শ্রমিকদের জন্য,মালিক নামের লুটেরাদের জন্য নয়। সুতরাং এই প্যাকেজ যাতে লুট না হয় সেনাবাহিনীকে বলুন প্রতিটি চালু গার্মেন্টসে গিয়ে নিজেদের হাতে প্রকাশ্যে শ্রমিকদের হাতে হাতে বেতন ভাতার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। নয়তো বেসুমার লুটপাট হবে, অনেকেই অনেক কিছু ইসারা করবে। সরকার তখন দায় এড়াতে পারবে না।

‘এক্ষেত্রে আরো অর্থের প্রয়োজন হলে গার্মেন্টস মালিকদের ওপর লেবি আরোপ করুন। সরকার জানে, কাদের কাছে টাকা আছে, ইতিমধ্যেই কারা ব্যাংকের ঋণ রিসিডিউল করাসহ ঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে, কারা অর্থনীতির আপৎকালের আগাম অজুহাতে রাষ্ট্রের ব্যাংক লুটের পাঁয়তারা শুরু করেছে।

‘টানা কয়েক মাস লকডাউন হলেও বাংলাদেশে কেউ না খেয়ে মরবে না যদি সরকার লুটেরা শ্রেণীকে রূখতে পারে। ইউরোপীয়দের হাতে ডলার থাকে তারা ঘরে খাদ্য মজুদ করেনা । কিন্তু আমাদের দেশে ঐতিহ্যগতভাবেই বেশির ভাগ পরিবার সারা বছরের খাবার ঘরে রাখে। তবে অসুবিধায় পড়বে গরিব মানুষ। তাদের জন্যও সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে। এদেশের মানুষ পাড়ায় মহল্লায় গ্রামে গঞ্জে হাটে ঘাটে প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনে। দলগতভাবে আওয়ামী লীগের লোকদের বলুন, প্রতিটি এলাকায় ১/২শ জনের তালিকা করে ছোট ছোট গ্রুপ করে নিজের পাড়ার গরীব মানুষদের খাবার দিতে।

‘হাটে বাজারে কাজ করে চলা লোকদের খাবার দিতে সমাজের সবচেয়ে ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ী নামের বজার লুটেরা দোকানদারদের বলুন ওদের খাবার দিতে। এমনিভাবে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর সুবিধা ভোগীদের বাধ্য করুন মহামারির এই দূঃসময়ে তার চার পাশের লোকদের জন্য কিছু করতে। আর এই সব কাজের দায়িত্ব দিতে হবে সেনাবাহিনীকে। অন্যথায় গরীব মানুষের জন্য দেওয়া সরকারি বরাদ্দ মহামারির চেয়েও ভয়াবহরূপে লুটপাট শুরু করে দিবে সুবিধা ভোগীরা।

‘গণমাধ্যম মালিকদের দরদ উপচে পড়ছে

‘করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে কিছু গণমাধ্যম মালিকদের দরদ ও দায়িত্ববোধ যেন উপচে পড়তে শুরু করেছে। বুঝা মুশকিল এর কতটা আন্তরিকতা আর কতটা ধান্ধাবাজি। প্রতিদিন কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জাতিকে খবরের কাগজ পড়ার পরামর্শ দিচ্ছে। অথচ কোন কাগজেই শুধু মাত্র কতিপয় ব্যক্তির সুরৎ দেখানো ছাড়া নতুন কোনো খবর থাকে না।

‘অপরদিকে গণমাধ্যমগুলো আগের মতোই অরক্ষিত। সংবাদকর্মীদের কারো সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। যে পরিমাণ ঝুঁকি নিয়ে মাঠে ময়দানে স্বাস্থ্যকর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দৌড়াচ্ছেন, ঠিক ততটা ঝুঁকি নিয়ে সংবাদকর্মীরাও কাজ করছেন। কিন্তু তাদের সুরক্ষার কোনো প্যাকেজ নাই। সংবাদকর্মীরাও মানুষ। তাদেরও জীবন আছে, আছে স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিবার পরিজন। তারাও তো বাঁচার অধিকার রাখে। না, সংবাদকর্মীরা করোনা ভাইরাসের আত্মীয়। যদি তা না হয় তবে সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সুনির্দিষ্ট প্যাকেজ ঘোষণা করে না কেন নওয়াবরা। করোনার এই ভয়াবহ দুঃসময়ে এসএটিভি থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই হলো। ইউনিয়ন প্রতিবাদ করলো, প্রতিকার চাইলো অথচ যাদের দেখার দায়িত্ব তারা শুধু বললো ‘অনভিপ্রেত’।

দুঃসময়েই স্বজন চেনা যায়

‘তাই চিনে রাখুন, সময়ে কাজে লাগবে। এই দূঃসময় কেটে গেলে বোঝাপড়া একটা হবেই হবে। মালিকদের বাণিজ্যিক তদবিরবাজ সাংবাদিক বন্ধুদের বলি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নয়, নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে জাতীয় স্বার্থে কাজ করুন। প্রয়োজনে প্রযুক্তির ব্যবহারে নিরাপদ থেকে দায়িত্ব পালন করুন। সরকারও অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় তথ্য ও করণীয় বিষয়ে ব্রিফিং করছে। তাহলে সংবাদ কর্মীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন মাঠে ময়দানে দৌড়াতে হবে। মালিকদের ধান্ধাবাজি আর লুটপাট তদবিরের সব নথিপত্র সংরক্ষণ করুন। নিজেকে সুস্থ্য রেখে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করুন। করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতায় বিশ্বব্যাপী অনেক কিছুই পাল্টে যাবে। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এখন বেঁচে থাকাই জরুরি।

লেখক: সভাপতি বিএফইউজে

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :