যেমন আছেন করোনায় গৃহবন্দীরা

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২০, ১৮:১০ | প্রকাশিত : ২৯ মার্চ ২০২০, ১৫:৫৭

মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবে থমকে আছে বিশ্ব। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। চলছে সাধারণ ছুটি। মানুষ গৃহবন্দী। খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হতে বারণ। এই অবস্থায় নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কাটছে দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন। কেউ ঘরে বসেই সারছেন দাপ্তরিক কাজ। তাদের দিনকাটানোর গল্পগুলো প্রায় অভিন্ন। চিন্তার বিষয়ও এক-‘যদি দিনেদিনে করোনার প্রভাব বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে কোনদিকে যাবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি?’ চাকুরি ও ব্যবসায় ধ্বসের শঙ্কা তো আছেই সবার মাঝে!

চিকিৎসক, গণমাধ্যমকর্মী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

রাজধানীর আনোয়ার খান মেডিকেলের চিকিৎসক মাহফিল আরা রহমান। পাঁচদিন ধরে তিনি গৃহবন্দী দিন কাটাচ্ছেন। গৃহপরিচারিকা না থাকায় নিজেই সব কাজ করছেন। ফাঁকে পড়াশোনাও করছেন। এছাড়া পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ও টিভি দেখে সময় কাটছে তার।

তবে প্রথম দুদিন ভালো লাগলেও এখন কিছুটা একঘেয়ামি চলে এসেছে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘নিয়মিত লাইফে কখন ফিরতে পারব সেজন্য ছটফট করছি। বাবা-মাকে মিস করছি। রোগীদের খুব মিস করছি।’ মোবাইলে রোগীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনলাইনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ক্লাসও করছি।’

মাহফিল আরা বলেন, ‘যারা ঘরে থাকছেন না তাদের নিজের এবং পরিবারের জন্য হলেও বাইরে না যাওয়া উচিত। তবে একদম খেটে খাওয়া মানুষের পাশে সরকার ও বিত্তবানদের দাঁড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে পরিস্থিতি যাইহোক দেশ ও দশের প্রয়োজনে আমাকে কাজে যোগ দিতেই হবে। সেক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি লম্বা হওয়া না হওয়াতে তেমন পার্থক্য নেই।’

দেশে সনামধন্য একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত আরমান হক। গত চারদিন ধরে পুরো সময় চট্টগ্রামের বাসায় থাকছেন। ইবাদত-বন্দেগি, পরিবারকে সময় দিয়ে আর টিভির খবর ও সিনেমা দেখে সময় কাটছে তার।

তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হঠাৎ নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। সামনে কী হবে কেউ জানি না।’

তিনি বলেন, নিজের নিরাপত্তা না ভেবে আশপাশের লোকজনকে যখন বাইরে অযথা ঘোরাফেরা করতে দেখেন তখন বিরক্ত হন। তার ভাষায়, ‘এরা নির্বোধ। নিজেও বিপদে পড়ছে। অন্যকেও ফেলছে।’

আপাতত অফিসের কোন কাজ বাসায় করার প্রয়োজন না পড়লেও কতদিন এমন চলবে তা জানা নেই তার। এই অবস্থা দীর্ঘ হলে কী হবে, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলে চাকরি এবং ব্যবসার প্রচুর ক্ষতি হবে। চাকরি হারানোর ভয়ও আছে।’

জেবিন ইসলাম। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তিনি। গত ১৪দিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। বললেন, খুব প্রয়োজন ছাড়া এক মুহুর্তের জন্যও বের হচ্ছি না। নিরাপত্তার কথা ভেবে বিষয়গুলো এমনিতে স্বাভাবিক লাগছে। তবে যখন মনে হয় চাইলেই বের হতে পারব না, তখন কেমন যেন লাগে! সবসময় ব্যস্ত থাকতাম।এখন দীর্ঘ অবসর।’

কীভাবে কাটছে গৃহবন্দী জীবন? বললেন, ‘প্রচুর বই পড়ছি। টিভিতে সবশেষ খবর জানার চেষ্টা করছি। করোনা ভাইরাস থেকে দেশ ও দেশের মানুষ যাতে রক্ষা পায় সেজন্য দোয়া করছি।’

তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। বরিশালে সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও চেষ্টা করছেন পড়াশোনা করে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করতে। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নানা পরামর্শও দিচ্ছেন।

ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার পেশাই পড়ানো। প্রতিষ্ঠান যেহেতু বন্ধ তাই নিজেকে সমৃদ্ধ করছি যাতে আরো ভালো পড়াতে পারি। অনলাইনে (মেসেঞ্জার গ্রুপে) শিক্ষার্থীদের ব্যাকরণ শেখাচ্ছি অনেকদিন ধরে। এখন তাতে বেশি সময় দিতে পারছি। ‘তানভীরের বাংলা ক্লাস’ নামে ফেসবুক পেজ আছে সেখানে আগ্রহীদের প্রচলিত ভুল ও তার সংশোধন শেখাচ্ছি ।’

কোয়ারেন্টিনের নিয়ম মানার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্য মানতে হবে। যারা বের হচ্ছেন তার কারণ বের করে সমাধান করতে হবে। ইতোমধ্যে যা ভুল হওয়ার, হয়ে গেছে। কমিউনিটির মধ্যে সংক্রামণ শুরু হয়েছে। এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা এদেশে সম্ভব নয়। একবার গণসংক্রামণ শুরু হলে আর সামলানো যাবে না।’

তিনি মনে করেন, করোনা ব্যাপকভাবে ছড়ালে বৈশ্বিক মন্দায় শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়বে। দেশের শ্রমজীবীরা খাদ্য-সংকটে পড়বে। পর্যটন সংশ্লিষ্টখাত চরম পর্যদুস্ত হবে। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও সমগ্র বেসরকারি খাতে ওলট-পালট লেগে যাবে।’

একটি ব্রিটিশ চ‌্যারিটি সংস্থার ‘প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা’আরাফাত সিদ্দিকের ব্যস্ততা একটু ভিন্নরকম। কারণ তাকে বাসায় বসে করতে হচ্ছে অফিসের কাজ। গত আটদিন ধরে তিনি বাসাবন্দি। ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আছে। তবে ফেসবুক আর টিভি নিউজ না দেখলে উদ্বেগ কম হয়। আগামী দিনগুলোর কথা চিন্তা করতেই সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে। তাছাড়া আমার বাবা-মা ও পরিবারের সদস‌্যদের সুরক্ষা কতদিন থাকবে তা নিয়েও শঙ্কার মধ‌্যে থাকছি।

তিনি বলেন, ‘নিয়মিত অফিসের টিমমেটদের সঙ্গে ভিডিও কলে মিটিং করছি। কর্মপদ্ধতি কীভাবে পুরোটা অনলাইন ভিত্তিক করা যায় সেই উপায়ও বের করা হচ্ছে। আশাকরি অদূর ভবিষ‌্যতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।’

তিনি বলেন, যারা প্রয়োজনীয় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করছেন না তারা বেঁচে থাকলে ভবিষ‌্যতে তাদের প্রতি কেউ আর আস্থা রাখবে না। তবে খেটে খাওয়া মানুষদের কথা আলাদা। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে যারা বেসরকারি চাকরি করেন সবার চাকরি নিয়েই দুশ্চিন্তা আছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতিতে থাকা আফরা রহমান গত পাঁচদিন ধরে পুরোপুরি গৃহবন্দী। তার কাছে বন্দি জীবনের মতো মনে হচ্ছে সময়টা। বাইরে যেতে পারছেন না এটা ভাবতে খারাপ লাগছে তার।

পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে জানিয়ে তিনি ঘরের বাইরে থাকা লোকদের উদ্দেশে বলেন, ‘ মৃত্যুর মিছিল একবার শুরু হলে দাফন করারও কেউ থাকবে না। তাই ঘরে থাকুন। নিরাপদ থাকুন,অন্যকে নিরাপদ রাখুন।’

করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে অনেক প্রতিষ্ঠান লোকবল ছাঁটাই করতে পারে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন আফরা।

ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন আটদিন ধরে কক্সবাজারে গৃহবন্দি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটছে ভালোই। তবে অজানা আতঙ্কে মনটা হঠাৎ হঠাৎ খারাপ হয়ে উঠছে বলে জানান।

বলেন, ‘পূর্বনির্ধারিত কিছু অফিসিয়াল কাজ ছিলো যা ঠিক সময় শেষ হবে না। এতে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে আগের কিছু কাজ বাসায় করার চেষ্টা করছি।’

নিয়ম না মানা লোকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অন্তত নিজের জন্য না হলেও পরিবারের জন্য, দেশের জন্য সরকারের নেওয়া উদ্যোগ ও আদেশকে মানার চেষ্টা করুন।’

ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে আমার ধারণা উচ্চবিত্তরা মধ্যবিত্ত হয়ে যাবে। আর মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তে পরিণত হবে।’

(ঢাকাটাইমস/২৯মার্চ/বিইউ/ এইচএফ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :