ঢাকাবাসীর ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ তিন দিনেই শিথিল

প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০২০, ২২:০১ | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২০, ২২:১৮

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস

শিমুল রহমান। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। থাকেন পূর্ব রাজাবাজার। করোনাভাইরাস ইস্যুতে সরকারি নির্দেশনা মেনে গত চার দিন তিনি বাসা থেকে বের না হলেও আজ রবিবার সড়কে বেরিয়েছেন। উদ্দেশ্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া।

শিমুলের মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবী এ ধরনের ‘অপ্রয়োজনে’ আজ সড়কে বের হয়েছেন। তাদের ভাষ্য, গত কয়েক দিন বাসায় থেকে থেকে বিরক্তি লেগে গেছে তাদের। তাই তারা সড়কে এসেছেন। তবে তারা এটাও মানছেন, এই পরিস্থিতিতে বের হওয়া ঠিক হয়নি।

আজ সড়কে রিকশা, সিএনজি ইজিবাইক ধরনের অনেক যানবাহনও দেখা গেছে, যা গত তিন দিন ছিল না রাজধানীর সড়কে।

দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার লোকজনের চলাচল সীমিত করতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। মূলত আজ রবিবার শুরু হয়েছে এই ছুটি। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ছিল স্বাধীনত দিবসের ছুটি, তারপর শুক্র ও শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। সেই হিসাবে আজ ছিল ছুটির চতুর্থ দিন।

এই ছুটির সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার থেকে সরকার সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে। এ ছাড়া সরকারি-বেসকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,  অফিস, বিপণিবিতানও বন্ধ। আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সবাইকে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করার জন্য নির্দেশনা দেয় সরকার। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ যেন ঘরের বার না হন।

দেশজুড়ে এই কোয়ারেন্টাইন গত তিন দিন বেশ মানতে দেখা গেছে।   রাজধানীর মূল সড়ক তো দূরের কথা বিভিন্ন অলিগলিতেও মানুষের সমাগম একেবারে ছিল না। কিন্তু চার দিনেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। আজ রবিবার দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। পান্থপথ, বাংলামোটর, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, কলাবাগানসহ বেশ কয়েকটি সড়কে বহুসংখ্যক মানুষকে সড়কে বের হতে দেখা গেছে।

সড়কে বের হওয়া আজিম নামের একজন বলেন, ‘ভাইরে, বাসায় কত বসে থাকা যায়? বিরক্ত হয়ে আজ রাস্তায় আসছি। তবে করোনা ঠেকাতে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে চললে আমাদেরই ভালো হতো।’

কলাবাগানের বাসিন্দা হান্নানের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব রেখে কথা বলতে গেলে বিরক্ত হন তিনি। উল্টো তিনি এই প্রতিবেদকে সড়কে বের হওয়ার কারণ জানতে চান।

গত কয়েক দিন রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও কঠোর হাতে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। আজ তাতে ছিল শিথিলতা।

তাদের কতিপয় সদস্যের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের কারণে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এই প্রেক্ষাপটে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী তার বাহিনীর সদস্যদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহিষ্ণু ও পেশাদার আচরণ করার নির্দেশ দেন। অর্থাৎ দায়িত্ব পালনের সময় সামাজিক দূরত্ব মেনে পেশাদারি আচরণ করতে হবে তাদের।

জরুরি দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহকারী ও টেকনোলজিস্ট, সিটি করপোরেশন ও নিরাপত্তা প্রহরীদের ব্যাপার বিশেষ যত্নশীল হওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আজ খুব নমনীয় অবস্থানে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। করোনাভাইরাস ঠেকাতে সড়কে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষকে জড়ো না হওয়ার অনুরোধসহ সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেন।

আবদুল হামিদ নামের একজন পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যেন অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের না হয়। কিন্তু সবাই এটা মানছে না। আমরা নমনীয়ভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। গত তিন দিন রাজধানীতে রিকশা, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) খুব একটা দেখা যায়নি। আজ সড়কে এসব যাবাহনের পাশাপাশি ইজিবাইক ও সিনজিও বেশ দেখা গেছে।

কাওরান বাজার সার্ক ফোয়ারার সামনে কথা হয় রিকশাচালক মতিন মিয়ার সঙ্গে। সড়কে গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই রিকশাচালক বলেনন, ‘আমি পুরান ঢাহাত তে এইখানে ভাড়া নিয়া আইছি। গত কয় দিন রাস্তায় রিকশা কম আছিল, কিন্তু আজ সকাল থেইক্কা রাস্তায় রাস্তায় অনেক প্রাইভেট কার, সিনজি দেখছি। মানুষ বের না হলে খাবে কী!’

পান্থপথে এক সিএনজিচালক জানান, তিন দিন পর আজ তিনি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নেমেছেন। সড়কে না নেমে উপায় নাই।’

সরকারি নির্দেশনা মেনে গত কয়েক দিন রাজধানীর সুপারশপ, কাঁচা বাজার, মোদি দোকান ও ফার্মেসি ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ রাখা হলেও আজ বিভিন্ন এলাকায় টুকিটাকি টং-এর দোকান খুলতে দেখা গেছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহলের সময় দোকান বন্ধ করে পরে আবার খুলতে দেখা যায়।

বাংলামোটর পুলিশের গাড়ির আনাগোনা দেখে একটি চায়ের দোকান সাময়িক বন্ধ করার পর খানকিটা সময় পরে গাড়িটি চলে যেতে আবার দোকানটি খোলেন চা দোকানি। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘মামা, দোকান বন্ধ রাখলে তো আমাগো পেট চলে না। আর কত বন্ধ রাখমু?’

রাজধানীতে বসবাসকারীদের বড় একটা অংশ বোয়াদের (ঠিকা ঝি) রান্না বা হোটেলের খাবারের ওপর নির্ভরশীল। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার বৃহস্পতিবার থেকে ছুটি ঘোষণার পরপরই বেশির ভাগ বোয়া গ্রামে চলে গেছেন। আর সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ করা হয়েছে সব ধরনের খাবারের হোটেলও। এতে করে রান্নার ব্যবস্থা না থাকা এসব মানুষ বিপাকে পড়ে। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে কর্তৃপক্ষ গতকাল হোটেল ও বেকারিগুলো খোলা রাখা যাবে বলে নির্দেশনা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে খাবার কিনে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি বসে খেতে চান, সে ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে বলেও জানানো হয়েছে। তবে আজ রাজধানীতে রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান খুলতে দেখা যায়নি।

গ্রিন রোডের একটি মেসে থাকা বেসরকারি চাকুরে নিজাম মহিউদ্দিন গত কয়েক দিনে তার কষ্টের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। নিজাম জানান, খাবারের হোটেল খোলা না থাকায় ভাত-ডিম আর আলুভর্তা দিয়ে দিন পার করছেন তিনি।

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন কেউ শনাক্ত হয়নি।  আজ রবিবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। গত দুই দিনে কারও মৃত্যুও হয়নি।

গত ৮ মার্চ প্রথম তিনজনের করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংবাদ আসে। আইইডিসিআরের তথ্যমতে, আজ রবিবার পর্যন্ত দেশে মোট ৪৮ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন পাঁচজন।

(ঢাকাটাইমস/২৯মার্চ/মোআ)