সম্রাটের কাকরাইলের অফিস এখন

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২০, ১৬:১২ | প্রকাশিত : ৩০ মার্চ ২০২০, ১১:১৭

শান্তিনগরের দিকে থেকে আসা পথটি সোজা নেমে গেছে সেগুনবাগিচায় রাজস্ব ভবনের দিকে। খাঁ খাঁ শূন্যপথে রোদের দাপট। কালো পিচ নরম হয়ে লাভার মতো উগড়ে দিচ্ছে তাপ। কাকরাইলের এই নির্জন পথটাতে হঠাৎ দু-একটা রিকশা আসছে। খালি। যাত্রী নেই কোনোটাতেই। চালকের চোখেমুখে হতাশার কালো ছায়া।

এমন একজনের দিকে তাকাতেই ইশারা করলেন। রিকশার গতি কমিয়ে সামনে এসে থামলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘যাইবেন, মামা?’

উত্তরে ‘না’ বললেও তার যাওয়ার কোনো তাড়া দেখা গেল না। কী মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকালেন। বললাম, ‘এখন তো করোনার কারণে সব ছুটি চলছে, যাত্রী পাবেন কোথায়?’

‘কী করমু, পেট তো চালাতে হবে। তাই যাত্রীর জন্য ঘুরছি। আপনে কেন আইছেন?’ উৎসুক চোখে তাকায় আমার দিকে।

‘এই তো রাজধানী দেখতে বেরিয়েছি। আপনাদের দেখতে বেরিয়েছি। আপনি কি এ এলাকাতেই রিকশা চালান?’

‘হ।’ তারপর বলেন, ‘এইখানে আগে মাইনসের লাইগা গাড়ি চালান যাইতো না। কুনু জায়গায় ক্ষ্যাপ না পাইলেও এনে আইলে পাওন যাইতো।’

‘ছুটির আগের কথা বলছেন?’ জিজ্ঞেস করি।

বললেন, ‘না, এহনকার কথা কই না। আগে যহন পার্টির লোকজন আইতো তহনকার কথা। কী জায়গা কী হইয়া গেলো!’

রাজমণি সিনেমা হলের এই ‘কী জায়গা কী হইয়া গেলো’ গলিটার একাধিক রূপান্তর ঘটে। এটি একসময় সিনেমাপাড়া বলে পরিচিত ছিল। প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল এখানে। সিনেমা জগতের মানুষের পদচারণে মুখর ছিল পথটি। তাদের দেখতে আসত সাধারণ মানুষ। সিনেমা শিল্পের ভাটার টানে অনেক অফিস উঠে যায়। তখন ভিড়ের মানুষ বদলায়। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভিড়। তীর্থ হয়ে ওঠে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার। এই ভবনেই ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কার্যালয়।

বিভিন্ন দিবসে পার্টির পক্ষে এখান থেকে সারা রাজধানীতে ভোজের আয়োজন করতেন যুবলীগের ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। এখন এই করোনা-দুর্যোগে কোনো আয়োজন নেই সেখানে। কেননা সম্রাট যে কারাগারে বন্দি।

রবিবার ভবনটির সামনে গিয়ে কোনো কাকপক্ষীরও দেখা মেলেনি। নেতাকর্মীরা না থাকলেও ভবনটি আগের মতোই আছে। মাথা তুলে তাকালে দেখা গেল লাল বোর্ডে সাদা হরফে লেখা সাইনবোর্ড- যুবজাগরণ, পাঠাগার, প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র। তার নিচে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ।’

সম্রাটের অফিসকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মী এই ভবনের সামনে ভিড় করতেন। এক দল চলে গেলে আরেক দল আসত। মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের পদভারে সরব থাকত এই পথ। সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তারপর থেকে আর নেতাকর্মীদের ভিড় নেই গলিটায়।

গত বছরের ৬ অক্টোবর সর্বশেষ এখানে এসেছিলেন সম্রাট। তবে একা নয়। র‌্যাবের সদস্যদের সঙ্গে। তাকে সঙ্গে নিয়েই ভবনটিতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিশেষ এই বাহিনীটি। এরপর কত কিছু ঘটে গেছে এই যুবলীগের নেতাদের নিয়ে! সম্রাট, খালেদ এমনকি সংগঠনটির তখনকার সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।

কিন্তু ভবনের বাঁদিকে পিলারের সঙ্গে এখনো ঝুলছে ওমর ফারুক চৌধুরীর আপাদমস্তক একটি ছবি। ছবির নিচে লেখা আছে তার সাবেক পরিচয়টিই। ডানে উপরে দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের আবক্ষ ছবি। তার নিচে হাসিমুখে ঝুলছে ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ছবিটিও। ফারুকের ছবির নিচে লেখা আছে যুবলীগের সভাপতি পরিচয়, সম্রাটের ঢাকা দক্ষিণ সাধারণ সম্পাদক পরিচয়।

পথ থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে যে সিঁড়িটি, তাতে পা দিতে গেলে চোখ পড়ে যায় ব্যানারটি। ঢাকার সর্বস্তরের যুব সমাজের পক্ষে তাতে ঝুলছে সম্রাটের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেও এখন আর ভবনটির ভেতরে ঢোকা যায় না। কলাপসিবল গেটে ঝুলছে তালা।

নেমে এলে কথা হয় এক মধ্যবয়সীর সঙ্গে। বললেন, ‘এইখানে কাউরে পাইবেন না। আহে না তো কেউ।’ ঘুরে ঘুরে চা-সিগারেট বিক্রি করেন তিনি। জানালেন, করোনার কারণে এখন সব বন্ধ। তারপরও প্রতিদিন একবেলা এখানে হাঁটতে আসেন। তার ভাষায়, ‘অইব্যাস। না আইলে ভালো লাগে না।’

তিনি শুনেছেন ঢাকায় খাবারের দোকান খোলা থাকবে। কিন্তু ঘুরে ঘুরে চা-সিগারেট বিক্রির অনুমতি নাই। বললেন, ‘অনুমতি দিলেও বা কী! কে খাইবো? লোক কই?’

তিনি জানান, সম্রাটকে গ্রেপ্তারের পর এই ভবনে পুলিশ তালা দিয়ে গেছে। সঙ্গে একটি নোটিশও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কে বা কারা রাতে সেই নোটিশ খুলে নিয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে কাউকে তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেখেননি তিনি।

ইউনূস নামে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘এই ভবনের সামনে একসময় রাত-দিন সমান আছিলো। কত লোক আসতো। রাইত বারো-একটা কোনো বিষয় ছিল না। চা-বিড়ি চলতো সোমানে। সম্রাট ভাইরে গ্রেপ্তার করার পর আর কাউকে দেখি না। কেউ আর এইদিকে আহে না।’

গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে হঠাৎই আলোচনায় আসে ক্যাসিনো। একের পর এক চলতে থাকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। উন্মোচিত হয় ক্যাসিনোর গোপন আখড়াগুলো। অভিযান শুরুর পর থেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের কারণে সম্রাটের নাম আলোচনায় আসে। অভিযানে যুবলীগ, কৃষক লীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

অভিযানের শুরুতে দিকে সম্রাট ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। প্রথম ছয় দিন তিনি কাকরাইলের এই ভবনের নিজের কার্যালয়ে ছিলেন। পাহারায় থাকত কয়েক শ যুবক। তারপর হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। দিন পনেরো পরে গত বছরের ৬ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি গ্রাম থেকে সম্রাট ও যুবলীগের বহিষ্কৃত আরেক নেতা এনামুল হক আরমানকে আটক করে র‌্যাব। ওই দিনই তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

তাকে নিয়ে র‌্যাব অভিযান চালায় সম্রাটের কার্যালয়ে। ক্যাঙারুর দুটি চামড়া, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র পাওয়া যায় সেখানে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিক তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। পরে র‌্যাব বাদী হয়ে সম্রাটের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করে।

এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) সম্রাটের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা করে।

সম্রাট এখন আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে। সেখানে কারা হেফাজতে তার চিকিৎসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সেখানকার চিকিৎসকদের ভাষ্য, সম্রাটের হার্টের অসুখ আছে। বছর কয়েক আগে তার হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়েছে। সেটি এখন কিছুটা জটিলতা তৈরি করছে। এ ছাড়া জন্মগতভাবে তার হার্টের আকার বড়। ফলে তাতে প্রায়ই শর্টসার্কিট হয়।

(ঢাকাটাইমস/৩০মার্চ/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :