মৃত্যুগন্ধী সময়ে আসুন কিছু আশার কথা শুনি

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২০, ১১:৫৮ | আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০, ১২:০৯

নাসরিন শাপলা

পৃথিবী তার জন্ম থেকে যেসব ভয়াবহ কালো অধ্যায় পাড় করে এসেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার মাঝে অন্যতম। নাৎসিদের হাতে নির্মমভাবে নিগৃহীত হওয়া যে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ এখনও এই পৃথিবীতে বেঁচে আছেন, কেনেডিয়ান অ্যাঞ্জেলা ওরোজ তাদের একজন। এ বছর ৭৫ এ পড়লেন। স্বভাবে একেবারে 'সোশ্যাল বাটারফ্লাই' অর্থাৎ মানুষের সঙ্গ ছাড়া তার পক্ষে জীবন কাটানো কঠিন। নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার পাশাপাশি নানা স্কুলে স্কুলে ঘুরে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে হলোকষ্টের ইতিহাস বলে যান তিনি। এর ফাঁকেও সিনিয়র কেয়ারে থাকা এক বন্ধুকে প্রতিদিন সঙ্গ দিতে ভোলেন না। যত ব্যস্ততাই থাকুক প্রতিদিন অন্তত একবার বন্ধুর সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে আসাটা তার রুটিনের মাঝে পড়ে। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে তিলতিল করে উপভোগ করেন অ্যাঞ্জেলা।

জীবন তার কাছে এতো মুল্যবান কারণ এই পৃথিবীতে অ্যাঞ্জেলার জন্মটাই এক পরম বিস্ময়কর ঘটনা। নাৎসিদের বানানো কুখ্যাত অশউইটজ ক্যাম্পে তার জন্ম। সেই কুখ্যাত ক্যাম্পে জন্মে বেঁচে যায় মাত্র দু'জন শিশু। তিনি তার মাঝে একজন। একটি বাঙ্ক বেডের  (দো'তলা খাট) উপর তলায় গোপনে তার মা তাকে জন্ম দেন। অপুষ্টির কারণে প্রচন্ড দূর্বল হওয়ায় শিশু অ্যাঞ্জেলার কাঁদার শক্তিটুকু ছিলো না। আর সেটাই ছিলো তার বেঁচে যাবার অন্যতম কারণ। ভাগ্যগুণে তার জন্মের কিছুদিন পরেই যুদ্ধশেষে  ক্যাম্পের বন্দী ইহুদীরা মুক্তি পান। আর এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান অ্যাঞ্জেলা আর তার পরিবার। সেখানে থেকে ক্যানাডায় পাড়ি জমান তারা। তারপর শুধুই জীবনকে নতুন করে গড়ে নেবার ইতিহাস।

আজ পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসজনিত এই প্যানডেমিকের সময়টিতে সবচেয়ে ভালনারেবল বয়োবৃদ্ধদের একজন অ্যাঞ্জেলা। স্বভাবতই নিজেকে বাঁচানোর জন্য সেল্ফ আইসোলেশন-এ আছেন। চাইলেই বন্ধুদের সাথে আর আড্ডা জমাতে পারছেন না। চাইলেই স্কুলে স্কুলে ঘুরে ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে পারছেন না। সবচেয়ে মিস করছেন সিনিয়র কেয়ারে থাকা বন্ধুর পাশে প্রতিদিন দু'দন্ড যেয়ে বসা। প্রতি মুহুর্তে উদ্বেগে কাটে বন্ধুর জন্য।

তবুও আশা ছাড়েন না অ্যাঞ্জেলা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে সুন্দর জামা পরেন, মেক আপ করেন। আর দশটা দিনের মতোই একটা নতুন দিনের জন্য নিজেকে তৈরি করেন। মাঝেমাঝে সিনিয়র কেয়ারের দরজায় দূরত্ব বজায় রেখে বন্ধুর জন্য খাবার রেখে আসেন।

তার জন্ম, তার বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা এই দুঃসময়ে তাকে সাহস যোগায়। অ্যাঞ্জেলা বিশ্বাস করেন কনসানট্রেশন ক্যাম্পের দিনগুলোর তুলনায় জীবন এখন অনেক সম্ভাবনাময়। তখন তাদের চারপাশে ছিলো শুধুই শত্রু আর শত্রু। তবুও মানুষ সাহস দিয়ে, ধৈর্য্য দিয়ে সেই যুদ্ধটা জিতে গেছে।

অ্যাঞ্জেলার বিশ্বাস আজকের অদৃশ্য শত্রু ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটাও মানুষ খুব শীঘ্রই জিতে যাবে। আর সেই যুদ্ধ জেতার প্রধান অস্ত্র হবে ভালোবাসা আর মানবিকতা।

অ্যাঞ্জেলার কথায় আমি আশার আলো দেখি। আশার আলো দেখি বিশ্বের প্রতিটি  স্বাস্থ্যকর্মীদের মহানুভবতায়। আশার আলো দেখি বাংলাদেশের বিদ্যানন্দসহ প্রতিটি সাংগঠনিক এবং ব্যাক্তি পর্যায়ের সাহসী এবং মানবিক পদক্ষেপে। আশার আলো দেখি যেই মানুষটির দিকে তাকিয়ে যিনি আজ মনের কষ্ট নিয়েও সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘরে বসে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করেছেন, সব ধর্মের মানুষের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই মানবতার মিছিল যতো দীর্ঘ হবে ততোই স্তিমিত হতে থাকবে করোনার শক্তি। তাই আসুন আজ না হয় গতকালের চেয়ে আরেকটু মানবিক হই।

নাসরিন শাপলা, লেখক।