করোনা প্রতিরোধে খোলা চিঠি-২

অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম
| আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২০, ২০:৫৬ | প্রকাশিত : ৩১ মার্চ ২০২০, ১৪:৪৪

করোনায় কে আক্রান্ত তা জানা কেন অত্যন্ত জরুরি?

একজন করোনায় আক্রান্ত মানুষ উপসর্গহীন থাকতে পারেন এবং তারাই ভাইরাসটি ছড়াতে পারেন। একটি রোগ মহামারী (এপিডেমিক) হওয়ার এটিও একটি কারণ। ওনারা কারা? স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া অর্থাৎ যারা এই রোগী ধরবেন, খাওয়াবেন, পরিষ্কার করাবেন এবং চিকিৎসা দেবেন। ওনাদের বাইরেও পরিবারের লোকজন (আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য), অ্যাম্বুলেন্স বা রোগী বহনকারী গাড়ির চালক বা সহকারী।

আরও একটি দুর্বল জায়গা। আমাদের দেশে আজ অবধি রোগীর ব্যবহৃত এবং চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী (যেমন-সিরিঞ্জ, ক্যানুলা, রাইলস টিউব, ক্যাথেটার, বমি, কফ, থুতু ইত্যাদি। একটি খোলা গামলায় ফেলা হয় এসব (এটি প্রায় সব হাসপাতালের ওয়ার্ড ও কেবিনের চিত্র)।

এগুলো যারা ধরবেন, সরাবেন তাদের মধ্যে যারা উপসর্গবিহীন থাকবেন ওনারাও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। তুলনামূলক উন্নত দেশ চীন। WHO এর বরাতে আমরা জানি উহানে হাসপাতাল সম্পৃক্ত (যাদের বর্ণনা আমরা দিলাম) তাদের মাধ্যমে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে প্রতি একশো জনে ৪১ জনে।

এখানেই শেষ নয়। অনেক সময় আমরা ভুলে যাই যেই মানুষগুলো রোগী হতে নমুনা সংগ্রহ করেন রোগ নির্ণয়ের জন্য (ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান) এবং ল্যাবে কাজ করেন তারাও ‍দুর্ঘটনাবশত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। নিঃশব্দে এই রোগটি ছড়াতে পারেন।

মনে হতে পারে যিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ওনাকে হাপসাতালে রাখলেই অন্যরা বেঁচে যাবেন বা রোগ ছড়াবেন না তা কিন্তু নয়। অধিকন্তু বাড়িঘরে, পাড়ায়, গ্রামে যেখানে সন্দেহভাজন কোনো রোগী আছেন তার সবরকম পরীক্ষা করে (Rt-Pcr, Igm/Igg, Chest x-ray, Ct scan of chest, Cbc Crp, Serun ferritin, D dimer) নিশ্চিত হতে হবে উনি করোনা রোগের রোগী কি না। নিশ্চিত হওয়া মাত্রই।

উনি অসুস্থ হওয়ার আগের (১৪ দিন) দিনগুলো কার কার সঙ্গে ঘোরাফেরা বা মেলামেশা করেছেন তাদের সন্ধান করতে হবে। ওই মানুষগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে কমপক্ষে ১৪ দিন। যাতে তারা আর কারও মাঝে এ রোগ ছড়াতে না পারেন।

করোনার ক্ষেত্রে নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা শুধু RT-PCR নয়। এই পরীক্ষাটি একশজনের মধ্যে ৭০ জনের রোগ নিশ্চিত করে। তাই বাকি ৩০ জনের জন্য করণীয়-

১. সন্দেহভাজন রোগী যার প্রথম RT-PCR টেস্ট নেগেটিভ তাদের ক্ষেত্রে একের অধিককার RT-PCR টেস্ট করতে হয়।

২. এছাড়া অন্য টেস্ট হলো করোনা ভাইরাসের বিপরীতে এন্টিবডি টেস্ট (বিষয়টি এমন- করোনায় আক্রান্ত রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিপরীতে এর প্রতিরোধী প্রোটিন IGM,IGG তৈরি হয়)। এই টেস্ট করে এই রোগ হয়েছে কি না ধরা যায়। আক্রান্ত হওয়ার তিনদিন পর I GM তৈরি হয়। আর তিন থেকে পাঁচদিন পর IGG রক্তে আসে। তাই আক্রান্ত রোগীর RT-PCR এবং IGM টেস্ট শুরুতে করা জরুরি। তবে করোনা ভাইরাসের কোন বংশ তা জানা জরুরি। স্পেনে চায়না থেকে আমদানি করা এন্টিবডি টেস্ট কিট যারা RT-PCR টেস্টে পজিটিভ তাদের মাত্র শতকরা ৩০ জনের পজিটিভ হয়েছে। এমনটি হতেই পারে। কারণ করোনা ভাইরাস বাধার মুখে এর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করতেই থাকে। তাই স্ব স্ব দেশ এই ভাইরাসের প্রকৃতি নির্ণয় করে এন্টিবডি টেস্ট কিট ব্যবহার করা উচিত।

৩. উল্লেখ্য, অতি সন্দেহভাজন রোগীর ক্ষেত্রে উপরের টেস্ট দুটি নেগেটিভ হলেও রক্ত পরীক্ষা, বুকের এক্সরে ও CT SCAN এর রিপোর্টের ভিত্তিতে করোনা রোগী মনে করতে হবে।

কেন এই আলোচনা?

ক. বাংলাদেশ ঘন জনবহুল জনপদের দেশ। ফলে একজন আক্রান্ত মানুষ সহজেই অনেকের মাঝে রোগ ছড়াতে পারেন।

খ. আমাদের অনেকেই এখনো পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সচেতন নন। অনেকে ইচ্ছে করে (হয়তো পরিস্থিতির কারণে) ডাক্তারের নিকট সত্য তথ্য দেন না। কাশি আছে কি না জিজ্ঞাসা করলে হ্যাঁ/না বলে কাশি দিয়ে বোঝান কাশের সমস্যা আছে। ফলে রোগী শনাক্তের আগেই স্বাস্থ্যকর্মীসহ ডাক্তাররাও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।

শুরুতেই আপনাদের জানিয়ে এসেছিলাম উপসর্গহীন কররকমের জনবল এই একজন রোগীর সঙ্গে সম্পৃক্ত (পরিবারের লোকজন, বাজারের দোকানদার, রিকশাওয়ালা,ভ্যান/গাড়ির অন্য যাত্রী, ওষুধ বিক্রিতা, পল্লী চিকিৎসক, কেনা কাটার সময় আশপাশের মানুষজন, মসজিদ বা উপাসনালয়ের আশপাশের লোকজন, চিকিৎসা নিতে গিয়ে অপেক্ষমান অন্য রোগী বা অ্যাটেনডেন্স ডাক্তার। আবার রোগের অবনতি হলে আত্মীয় স্বজনের আগমন, হাসপাতালে নেয়ার প্রস্তুতি, বিদায়ের সময় নাতিপুতিসহ সবাইকে মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে শেষ আদর, সন্তান সন্ততির সাথে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠা তারপর হাসপাতালে পৌঁছানো)। এত উপায়ে এই রোগটি ছড়াতে পারে।

গ. আমাদের দেশে এই সংস্পর্শের মানুষগুলোর সন্ধান পাওয়াসহ তাদের কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব নয়।

ঘ. এই রোগের পরীক্ষা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দেশের আনাচে কানাচে করা সম্ভব নয় এবং সময় সাপেক্ষ (যদিও সরকার সার্বিক চেষ্টা করছেন)।

এমন অবস্থায়:-

# সবাই কোন না কোনোভাবে ঝুঁকিতে

# কতদিন ঘরে বসে থাকা যাবে

# অনুগ্রহ করে সবাই সচেতন হই

ক. বাড়িতে কারো যদি করোনা রোগের উপসর্গ দেখা দেয় (হোক সেটা করোনা বা সাধারণ ঠান্ডা, জ্বর)।সাথে সাতে মাস্ক ব্যবহার শুরু করি। বাড়িতে আলাদা থাকি। কষ্টের উন্নতি না হলে হাসপাতালে যাই। কোনো তথ্য গোপন না করি। সাথে যারা আছেন সবাইকে মাস্ক ব্যবহার ও নিয়মমতো হাত ধুতে বলি (অনেকেই নাক খোলা রেখে শুধু মুখে মাস্ক পড়েন। এটি কিন্তু মাস্ক ব্যবহারের নিয়ম না। নাখ ও মুখ ঢাকতে হবে।)

# যেখানে সেখানে থুতু/কফ না ফেলি। কাগজের কোন ঠোঙায় (পলিথিন ব্যাগ না) ফেলে মাটিতে পুতে রাখি।

# যারা অসুস্থ রোগীকে ধুবেন বা বহন করবেন তারা গ্লাভস ব্যবহার করবেন। গ্লাভস পরা অবস্থায় কোনো কিছু ধরার আগে বা পরে হেস্কিসোল/হ্যান্ড সেনিটাইজার য়ে গ্লাভসসহ হাত পরিষ্কার করবন।

একটি গ্লাভস ব্যবহারের পর যদি বাধ্য হয়ে ২য়বার ব্যবহার করতে হয় তাহলে ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। তবে ব্যবহারের পর যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না। নির্দিষ্টস্থানে ফেলতে হবে।

খ. ওষুধ বিক্রেতা ও গ্রাম ডাক্তার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ঝুঁকির মাত্রা কত বেশি। তাই এমন কষ্টের কোনো রোগী বা অন্য কেউ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নিতে আসলে বা উপসর্গ শুনে আপনি ওষুধ না দিয়ে ওনাদের বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠাবেন। মনে রাখবেন আপনার নিকট অনেক মানুষ ওষুধ ও চিকিৎসা নিতে আসবেন।

তাই নিজে বাঁচুন, নিজের পরিবারকে বাঁচান। অসুস্থ মানুষগুলোকে সঠিক পথ দেখা।

গ. স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকগণ আপনার WHO এর গাইড লাইন যা ইতিমধ্যে সরবাহর করা হয়েছে। সেই অনুপাতে হাসপাতাল সেটআপ করে নিন। গাইডলাইন অনুযায়ী মাস্ক, গ্লাভস, ক্যাপ, চোখের Protector সহ পিপিই ব্যবহার করুন।

মনে রাখবেন সুতি কাপড়ের উপর এই ভাইরাস তিন ঘণ্টা থাকে। আর প্লাস্টিক/পলিথিনে থাকে তিন দিন।

অতি সন্দেহভাজন রোগীর টেস্ট নেগেটিভ হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর‌্যন্ত আইসোলেশনে রাখুন।

ঘ. প্রত্যেক উপজেলায় যতগুলো অ্যাম্বুলেন্স আছে সেগুলোর তালিকা তৈরীকরণসহ যোগাযোগের নম্বর জনপ্রতিনিধি স্বেচ্ছাসেবী বা সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে পাড়া মহল্লায় প্রচারের ব্যবস্থা করা জরুরি। অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও সহকারীদের পর্যন্ত ট্রেনিং দেওয়া কীভাবে রোগী বহনের পূর্বে ও পরে অ্যাম্বুলেন্স পরিষ্কার করবে ও নিজেরা পরিষ্কার থাকবেন। উপরন্তু রোগী এবং রোগীর লোকজনকে মাস্ক ব্যবহারের প্রচারণা করতে হবে।

ঙ. আমাদের সামনে কঠিন দিন আসছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখনই খারাপ। আরোও খারাপের আশঙ্কা আছে। আমাদের এই বিশাল জনবল একদিকে যেমন আশির্বাদ, অন্যদিকে এমন অর্থনীতিতে কষ্টে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন করছি- এখনই ইউনিয়/ওয়ার্ড ভিত্তিক রেশন দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যবস্থা গ্রহণের।

কেন এমন ভাবনা আমাকে তাড়িত করছে , এই গরমকালে এবং খাদ্য অভাবে কতগুলো অসুখ যেমন- ডায়েরিয়া, কলেরা, পেটের পীড়া ইত্যাদিসহ ডেঙ্গু মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে আরো দুর্বল করবে।

আমার দৃষ্টিতে কতগুলো মানবিক বিপর্যয়-

আমরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থপরতার নমুনা রাখছি। বাবা-মা প্রিয়জন মারা যাচ্ছেন আমরা সেই লাশ রেখে পালিয়ে যাচ্ছি। জান না আসলেই কি করোনায় মারা গেলেন কি না। তারপরও আশঙ্কাতে পালিয়ে যাচ্ছি। করোনায় মারা যাওয়া রোগীর সৎকার আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

আমাদের উচিত ছিল শুরুতেই এই বিষয়টি সকলকে জানিয়ে দেয়া কীভাবে নিরাপদে এই ধরনের লাশ গোসলসহ জানাজা এবং দাফন করা সম্ভব। এটি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নমুনা হয়ে যাচ্ছে। এটি থামানো উচিত। নিয়ম মেনে এবং PPE পড়ে লাশকে কফিনে নিলে ওই লাশ থেকে করোনা ছড়ায় না। করোনা জীবন্ত কোষেই বেঁচে থাকে। বংশবৃদ্ধি করে এবং ছড়ায়।

আর একটি অত্যন্ত অমানবিক সমাজ বিচ্ছিন্নের নমুনা-

ডাক্তার হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য যাতায়াত করছেন বিধায় বাসা ছাড়ার নোটিশ দেয়া বা বাসা ভাড়া না দেয়া। বিভক্তি আনবেন না। মানুষ সামাজিক জীব। বাঁচতে হলে সবাইকে নিয়েই বাঁচতে হবে। একা বাঁচতে পারবেন না।

আসুন ভালো আচারণ করি ও মানবিক সকল দিকগুলা চর্চা আবার শুরু করি। ভালো সমাজ গড়ি এবং একসঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করি।

সহযোগিতায়: নুসরাত বিনতে নজরুল ( ৩য় বর্ষ, এম.বি.বি.এস) ও ডা. নীরা ফেরদাউস (সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন), মডার্ন ওয়ান স্টপ আর্থারাইটিস কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার।

Sources:

1. Bmj 2020;368 doi: https://doi.org/10.1136/bmj.m1254

2. doi:10.1128/mBio.00722-20

3. https://doi.org/10.1148/radiol.2020200642

লেখক: চেয়ারম্যান, রিউমাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ; চেয়ারম্যান, প্রফেসর নজরুল রিউমাটোলজি ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :