দূষণ নেই, প্রাণ পেয়েছে ঢাকার প্রকৃতি

প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৩৫ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০, ১০:৫৪

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস

সবুজ কচিপাতা চোখ মেলছে। কী ফুরফুরে তাদের মন! চুলের মতো তিরতির করে উড়ছে বাতাসে। কুড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ফুল। কত রঙিন দেখতে! লাল-হলুদ আর বেগুনি। অন্যরকম এক আবেশ ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। দেখলে হয়তো বিশ্বাস হতে চাইবে না, খোদ ঢাকার রাজপথের এই রূপ।

শুক্রাবাদের বাসিন্দা তানভীর আহমেদ বললেন, ‘ঢাকায় এমন দৃশ্য! ভাবাই যায় না। কী সুন্দর সবুজ হয়ে আছে নতুনপাতা। ফুল। প্রজাপতিও উড়ছে দেখি। এবার তাহলে ভাবুন, ঢাকায় কী দূষণ হয়? শুধু যে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে তা নয়, এই প্রকৃতিও শ্বাস নিতে পারে না প্রাণ খুলে।’

করোনা প্রাদুর্ভাবে দেশ। সাধারণ ছুটির নোটিশ ঝুলছে দেয়ালে। বন্ধ অফিসপাড়া। গণপরিবহনের চাকাও আর ঘুরছে না। ঝাপ তুলছে না দোকানপাটের। কেবল খোলা খাবার আর ওষুধের পসরা। ঘর থেকে মানুষকে বেরোতে বারণ করা হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায়। মানুষ ঘরবন্দী। গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম দফা ছুটি চলছিল। এখন লম্বা হচ্ছে বিরতি। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত খুলবে না অফিস। তবে সীমিত আকারে খোলা থাকবে সেবা সংক্রান্ত দপ্তরগুলো।

গণপরিবহন আর জনশূন্য ঢাকা এখন আর দূষণের নগরী নয়। নেই গাড়ির ধোঁয়া। বাতাসে নেই ভারি শিশা। উন্নয়ন কাজ বন্ধ। ধুলোও তাই উড়ছে না। ফুরফুরে বাতাসে তরতর করে বেড়ে উঠছে সড়কদ্বীপের গাছ। পথ বিভাজনে সংসারপাতা ফুলগুলো। সারা বছরের ধূসরতা কেটে গেছে এ কদিনেই। আপন রূপে ফিরছে শোভা বৃদ্ধির জন্য লাগানো লতাগুল্ম।

এই শহর যে বায়ুদূষণের তালিকায় মাস কয়েক আগে শীর্ষে উঠে এসেছিল, এখন দেখে হয়তো কারো বিশ্বাস হবে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে এই কদিনেই ঢাকার সার্বিক পরিবেশের বেশ উন্নতি হয়েছে।

ঢাকার পরিচ্ছন্নতার কাছে নিয়োজিত মানুষের ছুটি নেই। ঝকঝকে তকতকে রাখার কাজ নেই বন্ধ। তাদের একজন মোমেনা খাতুন। তার ভাষায়, ‘রাস্তায় এখন বাইর হইলে দম নিয়া শান্তি পাই। ধুলাবালি নাই। পেট্রল পোড়া গন্ধ নাই। বুক ভইরা বাতাস নিতে পারি।’

সাইদুল ইসলামও কাজ করছেন নগর কর্তৃপক্ষের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। সড়কদ্বীপ আর বিভাজনের গাছগুলো দেখভাল করেন। পানি দেন। ছেঁটে সুন্দর রাখেন। বললেন, ‘এখন গাছগুলারে দেখলে মন ভইরা যায়। কী সুন্দর সবুজ হইয়া উঠছে। এমনে সময় সবুজ দেখা যায় না। ধুলার পরত পইরা থাকে।’

সোম ও মঙ্গলবার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ, ধানমন্ডি, বিজয়সরণি, মহাখালী, বনানী এবং বিমানবন্দর সড়ক ঘুরে দেখা গেছে পথের দুপাশে লাগানো গাছগুলোতে নতুন সবুজপাতায় রোদ পড়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পথবিভাজনের ফুল গাছ, লতাগুল্মগুলোও সতেজ হয়ে উঠেছে। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। বাতাসে নেই ধুলোর ঝড়।

এই ফাঁকা ঢাকাতেও দু-একটি ছোট ছোট পরিবহন চলছে। সিএনজি অটোরিকশাও দেখা গেলো দু-একটি। কোনোটায় যাত্রী আছে। কোনোটা খালি। অটোরিকশা চালক মনোয়ার হোসেনের কাছে ফাঁকা ঢাকাকে বিষাদের নগরী মনে হচ্ছে। বললেন, ‘রাস্তা ফাঁকা পাইলে তো ভালো লাগে। কিন্তু এইরকম ফাঁকা তো ভালো না। লোকজন নাই। যাত্রী নাই।’

মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। তিনি কেন বের হয়েছেন? জানতে চাইলে বলেন, ‘না বাইর হইলে খামু কী বলেন? পেটের দায়ে বাইর হইছি। তাও তো কপাল খারাপ। বেলা বাজে বারোটা। একটা ট্রিপ দিছি মাত্র।’

বাসায় রান্নার ব্যবস্থা নেই। হোটেলের খোঁজে বের হয়েছেন মহাখালীর বাসিন্দা আব্দুস সালাম। হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস আর মুখে মাস্ক। দূরে দাঁড়িয়েই বললেন, ‘ঢাকা শহরে এসেছি কুড়ি বছর হচ্ছে। এই রকম কখনো দেখিনি। ঈদের ছুটিতে ঢাকা ফাঁকা হয়। তাও অনেক মানুষ থাকে। ঘুরতে বের হয়। গাড়ি চলে। এমন সুনসান দেখিনি কখনো।’

তবে যানহীন ঢাকায় খোলা নিশ্বাস নিতে ভালো লাগছে তার। কোথাও কোনো দূষণ নেই। কিন্তু কোথাও করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন কিনা, এ নিয়েও শঙ্কা আছে মনে।

তবে যেতে যেতে তিনি বললেন, ‘আমরা যদি একটু সচেতন হয়ে দূষণ বন্ধ করতে পারি, তাহলে ঢাকাকে অনেকটাই সুন্দর রাখতে পারবো।’

বসন্তের যাবার সময় হচ্ছে। শীতের পরে প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে যাই-যাচ্ছি করছে ঋতুরাজ। যাবার আগে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রুক্ষতা। সেই ছোঁয়াই বদলে দিয়েছে ঢাকার ছবি। কিন্তু ছুটি শেষে তিলোত্তমা কর্মব্যস্ত চেহারায় ফিরে গেলে আবারও হয়তো ফিকে হয়ে আসবে এই রূপ, এই রঙ। তারপরও মানুষ চাইছে প্রাণ ফিরে আসুক প্রিয় ঢাকায়। আবারও কর্মব্যস্ত হয়ে উঠুক মানুষ। কেটে যাক করোনা প্রাদুর্ভাব।

ঢাকাটাইমস/১এপ্রিল/এইচএফ/এমআর