‘জৈব অস্ত্রের জৈব সন্ত্রাস’ বদলে যাবে বিশ্ব

আজিজুল বারী হেলাল
| আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৩:৩৭ | প্রকাশিত : ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৩:১৮
আজিজুল বারী হেলাল

শিশু করোনাভাইরাসের সুতিকাগার নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে। কিন্তু বস্তুজগতে আবির্ভাবের পর কোভিড-১৯ নামের ছোঁয়াছে ছাড়পত্র নিয়ে ক্ষুদ্র ভাইরাসটি ছুটে চলছে দেশ থেকে দেশান্তরে। মানব-মানবীর অঙ্গ-প্রতঙ্গের কোমল স্পর্শে সহিংস হয়ে সোজা ঢুকে পরে হোমোসেপিয়েন্সের ফুসফুসে।তারপর কোভিড-১৯ নামের ছাড়পত্রের প্রভাবে অসহায় মানুষ নিশ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ায় অক্সিজেনের অভাবে দম ফুরিয়ে চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে। কেউ বলছে বাদুড়, গন্ধগোকুল প্রভৃতি প্রাণীর মুখ নির্গত লালা বেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে ভাইরাসটি। কেউ বলছে সেখান থেকে শিশু ভাইরাসটি বিজ্ঞানের পরীক্ষাগার থেকে অসাবধানতায় লোকালয়ে সটকে পড়েছে। অথবা বনরুইয়ের শরীর থেকে লাফিয়ে পড়ে ভাইরাসটি মানব-মানবীর দেহে সংক্রমিত হয়েছে।কিন্তু বিশ্বব্যাপী ধীরে ধীরে যে মতবাদটি স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো বিজ্ঞানের পরীক্ষাগার থেকে পালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনুজীব ভাইরাস হয়ে নয়, পুরোপুরি লায়েক হয়ে বায়োলজিক্যাল উইপেন বা জীবাণু অস্ত্র হিসাবে।

পৃথিবীতে এ যাবৎ বিজ্ঞানের কৃত-কৌশলে প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী যত প্রকার মারাত্মক মারণাস্ত্র মানুষ তৈরি করেছে, দৃশ্যত অভিভাবকহীন এই জীবাণু অস্ত্রটির অন্যান্য মারণাস্ত্রের তুলনায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

আধুনিক কালের মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইল, রকেট ল্যাঞ্চার, পারমাণবিক বা রাসায়নিক প্রভৃতি অস্ত্র প্রয়োগ করতে যন্ত্র বা প্রযুক্তিতে দক্ষ সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত জনবলের প্রয়োজন হয়। এই সব মারণাস্ত্র সুচিন্তিত একটি বিশেষ কতৃপক্ষের অনুমতিতে সুপরিকল্পিতভাবে একটি সুনির্দিষ্ট পরিসরে প্রাণ-প্রকৃতির ওপর আঘাত হানে। এবং সীমাবদ্ধ সময়ের জন্য এর বিধ্বংসী প্রভাব সমাজ ও জনপদে বিরাজ করে।

তবে করোনাভাইরাস নামে জীবাণু অস্ত্রটি প্রকৃতিতে স্বতস্ফূর্ত উপায়ে কিংবা ল্যাবরেটরিতে জেনেটিক্যালি মডিফাইড হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে কিনা সে বিতর্ক পাশ কাটিয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায় অস্ত্রটির প্রভাব ও সন্ত্রাস কোন নির্দিষ্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ নয় বরং দ্রুত বেগে ধাবমান এবং তাবৎ বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান।

সুতরাং যেকোনো প্রান্তের মানব-মানবী নিজের অজান্তে এই জৈব অস্ত্রের আত্মঘাতী বাহক হয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে জীবজগতে অ্যানামেলিয়া পর্বের ম্যামাল বর্গের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান প্রজাতি হোমোসেপিয়ান্সকে।

ফলে দেশে দেশে নির্বিচারে কালে-অকালে ঝরে পড়ছে হাজারো তাজা প্রাণ।

জড় কিংবা জীব জগতে দিবালোকে কিংবা আঁধার রাতে যত্রতত্র পড়ে থাকলেও বুদ্ধিমান হোমোসেপিয়েন্স প্রজাতি খালি কিংবা চশমা চোখে দেখতে পায় না আণুবীক্ষণিক এই জৈব অস্ত্রটিকে। মানুষ শুধু এতটুকুই জানে জীবাণু অস্ত্রটি কোভিড-১৯ নামে ছোঁয়াছে ছাড়পত্র আছে। সুতরাং এর প্রয়োগ কিংবা ব্যবহারে সুপরিকল্পিত বা সুচিন্তিত কোন কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন নেই। বরং নিজের শারীরিক ছোঁয়ায় প্রাণ হারানোর সমূহ সম্ভাবনা শুধু নিজের নয় পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাপী বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর।

যুদ্ধকালীন শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত ও নিরাপত্তার নামে বর্তমানে বৃহৎ শক্তির দেশগুলো নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে, প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী নতুন নতুন মারাত্মক পারমাণবিক- রাসায়নিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রভৃতি প্রস্তুত ও মজুদ করে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়।

রাজনৈতিক পরিকল্পনায় দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে, জাতিতে জাতিতে-গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে সংকট তৈরি করা হয়। আবার সেই সংকট মোকাবিলা ও সমাধানের তত্ত্ব হিসাবে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার থিওরি উদ্ভাবন করে তাদের মজুদকৃত অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি করে দুর্বল সামরিক শক্তির দেশে বহুমূল্যে সেই অস্ত্র বিক্রয় করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থ উপার্জনের তাগিদে অস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসা চালিয়ে দুনিয়ায় নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট হিসেবে জাহির করে। যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ-জাতি-গোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক থ্রেট বা হুমকি হিসাবে দেখা দেয়।

এছাড়া অনেক দেশ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সামরিক সরঞ্জামাদি উৎপাদন ও মজুতে দুর্বল হওয়ায় প্রতিবেশীর হুমকি মোকাবিলায় নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে এলিটগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনীয় অস্ত্র ক্রয় করে। যুদ্ধ ছাড়াও অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থে এলিটগোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে সামরিক অস্ত্র অপ্রয়োজনে বেচাকেনা হয়।

সাধারণ চোখে বিমূর্ত জীবাণু অস্ত্র করোনাভাইরাস নিজেই সমগ্র বিশ্ববাসীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিপক্ষ। হোক সে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক এলিট কিংবা সামরিক পরাশক্তি।

জীবাণু অস্ত্র করোনাভাইরাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের মত।তাই পুরনো কায়দায় অস্ত্রের প্রস্তুত ও মজুত করার ঝুঁকি নিয়ে, শক্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ নেই। তবে জীবাণু অস্ত্রটির প্রভাব কমাতে ও বিস্তার ঠেকাতে মেডিকেল সাপোর্ট প্রস্তুত ও মজুদ এবং জীবাণুটির প্রতিষেধক আবিষ্কার করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নতুন নতুন এলিট বা এলিটগোষ্ঠী হিসাবে নিজেকে জাহির করার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই দুনিয়াজুড়ে রাজনীতিক নেতা ও দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠী এবং পুরনো এলিটদের তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে নিঃসংশয় চিত্তে শান্তির ঘুম নেই। যত দ্রুত সম্ভব জৈব অস্ত্রটির প্রভাব ও বিস্তার প্রতিরোধে দিনরাত ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মানবকল্যাণে এবং আর্থিক লোভে জীবাণুটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক এবং প্রতিষেধক প্রস্তুত ও মজুত প্রক্রিয়ার পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ।

সুতরাং যতদিন পর্যন্ত মানুষ করোনাভাইরাস নামের জীবাণু অস্ত্র মোকাবেলার পরীক্ষায় পরাজিত হবে, ততদিন মাটির পৃথিবীতে মানুষের আবাসভূমি থেকে শুরু করে তাদের নির্মিত চলমান সমাজ-সভ্যতা বিপর্যয়কর অবস্থার মুখামুখি হবে। কিন্তু বুদ্ধিমান হোমোসেপিয়েন্স প্রজাতি তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে, বদলে দেবে পুরনো সংসার-সমাজ-সভ্যতার ভীত। নতুন সৃষ্টির সুতীব্র চিৎকারে বদলে যাবে মানুষের অভ্যাসগত সংস্কৃতি।এই সময়ে মানুষের যাতায়ত, পারস্পারিক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ এবং সম্পর্ক এমন কঠিন ও কঠোর নজরদারিতে নিয়ন্ত্রণ হবে যে, ভেঙে পড়বে দীর্ঘদিনের সামাজিক কাঠামো, বিলুপ্ত হবে পুরনো ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রথা। পাল্টে যাবে পারস্পরিক ব্যাক্তি সম্পর্ক গড়ার ধরন অর্থাৎ রাষ্ট্র দখল করে নেবে সমাজ কাঠামো ও বিন্যাস এবং স্থান করে নেবে পারস্পরিক ব্যক্তি সম্পর্কের ভিতরে। আত্মঘাতী জীবাণু অস্ত্রের বাহক কে তা নির্ণয়ে চালু হবে রাষ্ট্রীয় নজরদারি।স্বাস্থ্যসেবার নামে ব্যক্তিগত শারীরিক নজরদারিতে মানুষ বন্দী হয়ে যাবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে মানুষ হবে সমাজবিচ্ছিন্ন জীব।

সুতরাং মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, এই পুরনো কথাটি বদলে মানুষ হবে রাষ্ট্রীয় নজরদারীর অধীনস্ত জীব। সুতরাং রাষ্ট্রের একচেটিয়া নজরদারি সামাজিক ও ব্যক্তি মানুষের অধিকার হরণ করবে।

এই জীবাণু অস্ত্রের জৈব হুমকি বা বায়োথ্রেটের সমুচিত জবাব বা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে পাল্টে যাবে আমাদের আবাসভূমি পৃথিবীতে মানুষের যাপিতজীবন। জৈব সন্ত্রাস বা বায়ো টেররের ফলে বাঁচার তাগিদে আমাদের সামনে আসবে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।

সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সমাজ-সভ্যতা-দেশ-কালের চিরায়ত ঐতিহ্যের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বদলে যাবে রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি।

মুক্ত ময়দানে জনসমাবেশ, পাবলিক মিলনায়তনে কিংবা বিলাসবহুল কনভেনশন সেন্টারে আলোচনা সভা-সেমিনার, ঝলমলে বিপণি বিতান, সুরম্য অট্টালিকার মত শপিংমল কিংবা গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে মানুষে-মানুষের যোগাযোগ কোলাহল থমকে যাবে।সব কর্মযজ্ঞের অন্যতম স্থান বা জনপরিসর হবে ভার্চুয়াল জগতের সেলুলয়েডে নির্মিত রঙিনপর্দা।

শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে অর্থাৎ ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

বায়োলজিক্যাল উইপেনের সৃষ্ট বায়োটেররের প্রভাব ও বিস্তার রোধের প্রতিযোগিতায় যিনি সিকান্দর তিনিই হবেন চলমান বিশ্বের নেতা বা গ্লোবাল এলিট।

লেখক: তথ্য সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :