একাধিক ক্রাইসিস ম্যানেজার চাই

প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৪:৪৯ | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১৮:৫২

আরিফুর রহমান দোলন

বিশ্বজুড়েই সংকট। স্বাস্থ্য ঝুঁকি তো বটেই। সেই সঙ্গে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকটও চরমে পৌঁছানোর উপক্রম। বিশ্ব নেতৃত্বের চোখেমুখে কোথায় যেন আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি। মহাপরাক্রমশালী দেশের কর্ণধারেরাও কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছেন। করোনাভাইরাসের আক্রমণজনিত ক্ষতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতির চেয়েও কত ব্যাপক হবে সেই অপেক্ষা শুধুই সময়ের ব্যাপার মাত্র। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো করোনা ভাইরাস ও এর সর্বগ্রাসী প্রভাব কাটিয়ে উঠবে তাদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ব্যবহার করেই।

কিন্তু বাংলাদেশ? আমাদের পক্ষে কি অত সহজে বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হবে?

সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নানামুখী সুদূরপ্রসারী পদেক্ষপ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি কাজ, সিদ্ধান্তে থাকতে হবে দক্ষতার ছাপ। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে দক্ষ, যোগ্য, শতভাগ নিষ্ঠাবান একজন রাষ্ট্রনায়ক। সকল সংকটে নিজেকে শতভাগ উজাড় করে দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। তিনি করছেন, তিনিই করবেন, আমরা নিশিদিন এই আশায়ই থাকি। কিন্তু তার টিম? সংকটকালীন সময়ে কতখানি দক্ষতা, যোগ্যতার ছাপ মন্ত্রিসভার সদস্যরা রাখছেন? কিংবা আমলাতন্ত্রের মধ্যেও এখন সেরকম অসাধারণ কোন নেতৃত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি? যারা এই মুহূর্তের সংকট এবং যে সংকট আসন্ন তা দক্ষতার সাথে মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নির্ভার রাখতে পারেন?

পরিষ্কার বলতে চাই, আমাদের ক্রাইসিস ম্যানেজারের বড্ড অভাব।

কেন যেন মনে হচ্ছে সবক্ষেত্রে অধিক মনোযোগ দিতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কার্যত বাধ্য হয়েও সব সময় অতিরিক্ত কাজে ডুবে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। সহকর্মীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও সরকার পরিচালনায় আরও মেধার স্বাক্ষর রাখলে আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খানিকটা নির্ভার থেকে যে কোন সংকট মোকাবিলায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারতেন।

টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টকে (পিপিই) বার বার পিপিপি বলে আখ্যা দিচ্ছেন। মুখ ফসকে বার বার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভুল উচ্চারণ বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করছে। সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতিতে মন্ত্রীর নিজের প্রস্তুতি, এই রোগ, এর চিকিৎসা, চিকিৎসা সামগ্রীসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার যোগ্যতা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কানাঘুষা করছেন। এমনিতেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর স্বাস্থ্যখাতে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে ছোটখাটো সংকটেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ঘাটতি দেখেন স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই। দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন নাজুক তখন তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মালয়েশিয়া সফর দায়িত্বের প্রতি কতখানি আন্তরিকতা প্রদর্শন তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি।

জাতিসংঘের একটি কর্মসূচিতে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে যেদিন বক্তব্য উপস্থাপন করার কথা সেদিন বিনা নোটিশে তার অনুপস্থিতিও ছিল অবাক করার মতো। যদিও সেইদিনই যথারীতি অনুষ্ঠানস্থল থেকে ৩০/৪০ কিলোমিটার দূরের একটি নৈশভোজে আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমন্ত্রিত সবার আগেই উপস্থিত ছিলেন।

করোনাভাইরাস নিয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে যে কয়দিন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বশরীরে বা অনলাইনে যুক্ত হয়েছেন তাতে তাঁকে কি প্রাণবন্ত, তথ্য সমৃদ্ধ বা পরিপাটিভাবে উপস্থাপন যোগ্য মনে হয়েছে? বরং কোথায় যেন আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এমনটাই লাগে। এটা কি অনভিজ্ঞতা? না-কি স্বভাব সূলভ নেতৃত্ব দানের ঘাটতি? ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগতদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারিন্টিনে সঠিকভাবে না রাখা, হজ ক্যাম্প অপরিচ্ছন্ন রাখা বা যথাযথভাবে প্রস্তুত না করার ব্যর্থতা তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই। শুরুতে ওই মন্ত্রণালয়ের দায়সারা মনোভাব, সমন্বয়হীনতা যে ছিল তা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। পিপিই লাগবে, লাগবে না-স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একরকম নির্দেশ আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরেক রকম বক্তব্যের মধ্য দিয়েই বোঝা গেছে সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় খুব একটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি।

সংকট তো কেবল শুরু। আশংকা করা হচ্ছে মহাসংকট সামনে। তাহলে স্বাভাবিক সংকট মোকাবিলায় যে নেতৃত্ব হিমশিম খায় বা সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে বড় সংকটে সেই নেতৃত্ব কি সরকার প্রধানকে যোগ্য সহযোগিতা করতে পারবে?

সমস্যা যে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা আমলাতন্ত্রের মধ্যে তা তো নয়। এই সমস্যা কার্যত সর্বত্র।

ভারতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ক্রাইসিস ম্যানেজারের নাম কি? বিজেপি ও বিজেপির বাইরে এক বাক্যে সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের নামই বলেন। বিভিন্ন রাজ্যে বিধান সভা নির্বাচনে জয়ের কৌশল, অন্য দলের জনপ্রিয় নেতা, বিধায়ক ভাঙ্গিয়ে বিজেপিতে ভেড়ানো, একের পর এক বিতর্কিত আইন পাশ ও রাজ্যে বিরোধ সামলানোসহ সব সংকটে মোদির মুশকিল আছান হলেন অমিত শাহ। এরপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গাড়কড়ি, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পিযুষ গোয়েল এরা সবাই মোদীর দক্ষ ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে খ্যাত। সাবেক আমলা ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও মোদীর ক্রাইসিস ম্যানেজারদের একজন। এই তো কয়েকদিন আগেই যখন দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের সদস্যদের বিচ্ছিন্নকরণ করতে মোদীর কপালে সামান্য ভাজ পড়লো মাঠে নামলেন দোভাল। তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বের সাথে কথা বললেন, বোঝালেন, করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে এই মুহূর্তে ধর্মীয় জমায়েত বন্ধ করা জরুরি। ব্যস, কাজ হয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মোদী।

কিন্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রাইসিস ম্যানেজার কে বা কারা? সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সংকট সমাধান করে প্রধানমন্ত্রীর মুশকিল আসান হওয়া নেতৃত্ব কোথায়?

মন্ত্রিসভার সবচেয়ে সিনিয়র মন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। কয়েক মাস আগে বিতর্কিত কিছু মন্তব্য করে সরকারকেই বেকায়দায় ফেলেছেন। সাধারণত সরকারের যে কোনো সংকটে মন্ত্রিসভার এক নম্বর সদস্যের ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমরা সবাই জানি, আদৌ সেই সক্ষমতা তিনি রাখেন কি না। যদিও একজন চমৎকার ভালো মানুষ আমাদের এই মন্ত্রী। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু তার শারীরিক কারণেই বাড়তি কাজ না করার কিছু বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও ভেবে দেখার।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম লোটাস কামাল, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানেরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্রাইসিস ম্যানেজার হয়ে উঠেছেন এটিই আমরা দেখতে চাই। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সংকট ব্যবস্থাপনা, যে কোন বিষয়ে পূর্বানুমান করার সঠিক ক্ষমতা দেশের জন্য কার্যকর এই বিশ্বাস ও আস্থা সব মহলের হয়েছে এটি দৃশ্যমান হওয়া জরুরি। আমলাতন্ত্রকে সঠিকভাবে পরিচালনায় আমাদের মন্ত্রীরা অত্যন্ত কার্যকর এটি অতি দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আমলাতন্ত্রের বোঝাপড়ার হিসেব নিকেশের ঘাটতি আছে এই প্রচার কিন্তু প্রবল। আরও সহজভাবে বললে অনেক সচিব মন্ত্রীর কথা শোনেন না অথবা প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত দিক নির্দেশনা পান না এমন কানাঘুষা প্রবল।

একজন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেনদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি, এটাই মনে হচ্ছে। তাদের অভিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞতাকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা দরকার। বর্তমান ও আগামীতে সরকার, প্রশাসন পরিচালনায় অনেক অনেক বেশি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে থাকা দরকার। পরীক্ষিত ক্রাইসিস ম্যানেজারদের সাহচর্যে নবীনেরা দক্ষ হয়ে উঠুক। সরকার পরিচালনায় অধিকতর অভিজ্ঞ, দক্ষ, প্রবীণ নেতাদের অন্তর্ভূক্ত করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নিশ্চয়ই আমরা করোনার ধাক্কা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪ ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়