বিশ্ব সাহিত্যে জায়গা করে নেবে 'তিমিরযাত্রা'

হাবিবুল্লাহ রাসেল
 | প্রকাশিত : ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১০:৫১

১ এপ্রিল থেকে পড়লাম মোজাফ্ফর হোসেন এর উপন্যাস 'তিমিরযাত্রা'। উপন্যাস কেবল কাহিনি নয়, ভাষার জাদুও। ভাষার জাদুময়তা দিয়ে কাহিনি গেঁথেছেন মোজাফ্‌র হোসেন তার উপন্যাস ‘তিমিরযাত্রা’য়। পাঁচটি গল্পগ্রন্থ ছাড়াও তার লেখা প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থ প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘তিমিরযাত্রা’ তার প্রথম উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবিক অবক্ষয়, ব্যক্তিগত হতাশার সাথে সাথে উপন্যাসে ফুটে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

উপন্যাসের কথক কানাডা প্রবাসী সুরুজ ছুটিতে দেশে ফিরে বাবা শফিকুন্নবীকে আবিষ্কার করেন সম্পূর্ণ অন্ধকার একটি রুমে। লাইটগুলোও খুলে রেখেছেন, আলো দেখতে না হয় যাতে। সে আলো থেকে বাঁচতে চায়; মূলত বাঁচতে চায় জীবন থেকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজাকারদের আধিপত্য, পঁচাত্তর ও পঁচাত্তর পরবর্তী জঘন্য কর্মকাণ্ড, কুখ্যাত রাজাকারের মন্ত্রীত্ব এসব দেখে দেখে পুরাপুরি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তার সাথে যুক্ত হয় ব্যক্তিগত হতাশা।

জীবনের সমস্ত স্মৃতি ভুলে, বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তার পার্থক্য করতে পারেন না। জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এমনই পিতার পুত্র সুরুজ। একটি ঘরে অসহায় বাবার পড়ে থাকা, অন্য ঘরে এক ধর্ষকামী পুরুষের যৌনদাসত্ব স্বীকার করে নেয়া মাকে দেখে দেখে বড় হওয়া ছেলে, যে পারিবারিক কোনো ইতিহাস জানে না। মাধ্যমিকের পরে কানাডা প্রবাসী হয়ে নিজেকে না পারে ভাবতে কানাডীয়, না বংলাদেশী। তার ভেতর চলতে থাকে উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা।

কিছু কিছু সত্য কোনোদিন না জানাই ভালো। সে সব সত্যের মুখোমুখি হওয়াটাও যুদ্ধ। তবু সে যুদ্ধ থেকে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে যায় না সুরুজ। বাবার বন্ধু হাফিজুল চাচাসহ গ্রামের এক এক জনের বয়ানের মধ্য থেকে জেনে নেয় বাবা-মায়ের স্মৃতির এক একটি পৃষ্ঠা, নিজের জন্ম পরিচয়, পারিবারিক ইতিহাস।

যে সন্তান নিজেকে নতুন করে চিনলো, জন্মধাত্রীকে নতুন করে চিনলো, তার বয়ানে যখন উঠে আসে, ‘মায়ের প্রতি এতদিন এক ঘৃণা নিয়ে বেঁচেছিলাম আমি। এখানে আসার পর খুব কষ্ট হচ্ছে তার জন্য। একটা মানুষ পরিবার-বাবা-মা-প্রেমিক সব হারিয়ে বেঁচে আছেন, একা। স্মৃতি যা আছে তা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, ভয়ংকর দুঃস্বপ্নও এতটা নির্মম হতে পারে না। বেঁচে থাকার খাতিরে একটা ভুল সংসারে, ভুল পরিচয়ে আশ্রয় নেওয়া- এই যদি বেঁচে থাকা হয় তবে ক্যাম্পে মৃত্যু হলে ভালো হতো।’ তখন যে কষ্টেপোড়া মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে তাই তো আমার ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ।

উপন্যাসের কথক সুরুজ, তার বীরাঙ্গনা মা ও জন্মদাতা নয় এমন পিতাকে কেন্দ্র করে যে আখ্যান রচিত হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে লেখক যেমন তুলে ধরেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা, কতো কতো সংগ্রাম-ত্যাগ-রক্ত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা; তেমনি তুলে ধরেছেন যুদ্ধের পরেও যে যুদ্ধ থাকে তার ব্যর্থতা। উপন্যাসে লেখক খুঁজেছেন সামগ্রিক নয়, ব্যক্তির ইতিহাস।

হাফি চাচার বয়ানে লেখক তুলে ধরেছেন, ‘সমষ্টির ইতিহাস আমাদের জানা থাকলেও ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস আমরা জানি না। এই কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানলেও বলতে পারি না তোমার বাবা কেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন। আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না তোমার মায়ের কষ্টকে।’

সুরুজকে ভাবনায় ফেলে দেয়, ‘যে যুদ্ধ আমাকে জন্ম দিয়েছে সেই যুদ্ধই আমাকে গৃহহীন করেছে।’ একটি যুদ্ধ যার জন্মদাতা তার কাছে তো যুদ্ধ শেষ হয় না, সুরুজের ভাষায়, ‘পৃথিবীর যেখানেই থাকি একটি যুদ্ধ আমার শরীরের সঙ্গে যাবে।’

আলোচনায় এ উপন্যাসকে ধরা সম্ভব নয়। এটা এমনই উপন্যাস যার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছুঁতে হবে চোখের গভীরের কান দিয়ে। ভাষার জাদুময়তা, জাদুবাস্তবতা-পরাবাস্তবতা, নান্দনিক নির্মাণে রহস্যমণ্ডিত কাহিনির ভেতর হেঁটে বেড়াবেন পাঠক।

উপন্যাসটি শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যে জায়গা করে নেবে। ‘তিমিরযাত্রা’ পাঠে যে ঘোরে বন্দি হলাম, আমি চাই সেই ঘোর আমায় অধীন করে রাখুক দীর্ঘ দীর্ঘ দিন।

‘তিমিরযাত্রা’- মোজাফ্‌ফর হোসেন। প্রচ্ছদ: জি জি, প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. মূল্য: ২৭০ টাকা।

ঢাকাটাইমস/৫এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :