বেঁচে থাকার কত প্রচেষ্টা আমাদের!

বিল্লাল বিন কাশেম
| আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১০:০৯ | প্রকাশিত : ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০৮:০৪

আহারে জীবন! বেঁচে থাকার কত প্রচেষ্টাই না আমাদের! বাঁচার জন্য দরিদ্র মানুষ ঘরবন্দি থাকলেও খাবারের খোঁজে পথে বের হচ্ছে। পোশাক কারখানা খুলছে শুনে শত মাইল পথ হেঁটে ছুটে আসছে মানব মিছিল। মানুষগুলোর বাঁচার কত প্রচেষ্টা! টেলিভিশন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞ মত দিচ্ছেন কাউকে কোথাও না গিয়ে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে করেন্টাইন বা জনবিচ্ছিন্ন থাকতে।

রাজধানী ঢাকার নিম্নআয়ের অনেক মানুষ আছেন যারা একই রুমে ৯ থেকে ১২ জন পর্যন্ত ঠাসাঠাসি করে থাকেন। এদের মধ্যে ছয়জনের একদল সকালে যখন কাজে বের হয় সারারাত নাইট ডিউটি করে আরেক দল ফেরে সকালে। এভাবে তারা জীবন কাটাতে অভ্যস্থ। ঈদ বা পূজা-পার্বণের সময় বাড়ি যাওয়া হয় তাদের। ওই সময়েও ট্রাকে করে বা ট্রেন-বাসে ঠাসাঠাসি করে যাওয়া আসা। রাজধানীতে এমন অনেক মানুষই আছেন যারা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেও দিনের খাবার জুটাতে পারে না। এসব মানুষ লকডাউনের কথা শুনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে নয়! কী খাবেন তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে বাড়ির পানে ছুটেছিলেন। আবার পেটের তাগিদে ঢাকার পানে ছুটে আসা। অনেকের একদিনের খাবার সঞ্চয় নেই! আবার হয়তো কেউ ভাবছেন করোনায় মৃত্যু হলে যেন নিজ এলাকায় হয়।

গত ২৬ মার্চ প্রথমে ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করলে তা আরও বাড়িয়েছে সরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিয়েছে মাঠ প্রশাসনের সাথে। কঠিন এই পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইই সহিষ্ণু আছেন। কঠিন ধৈর্যের পরিচয় দিতে হচ্ছে সবাইকে। বাঙালি সেই জাতি যারা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসেও পরস্পরকে সহযোগিতা করে উঠে দাঁড়াতে। অথচ সভ্য দেশে বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা গেছে সংকটকালে তাদের চরম অসহিষ্ণুতা ও রাহাজানি। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয় সংকটকালীন সময়ে বাঙালি ঘুরে দাঁড়াতে জানে। আর লকডাউন' কোনো লজ্জার বিষয় নয়। এটা যদি লজ্জার বিষয় হতো তাহলে পৃথিবীজুড়ে বহু দেশ এ ব্যবস্থা নিতো না।

দুই.

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে - A friend ineed is a friend indeed. 'অসময়ের বন্ধুই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু'। এই সময় সবাই কেমন যেন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা অবস্থা। করোনার এই মহাসংকটে সময় বদলেছে। একসময় পরিবারের সদস্য, বন্ধু কিংবা আত্মীয় বিদেশ থেকে এলে আমরা ভীষণ খুশি হতাম। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এলে তো কথাই নেই। সারাদিন তাদের কাছ থেকে গল্প শোনা আরও কতকিছু। পরিস্থিতি এখন উল্টো। বিদেশ থেকে আসছে শুনলে কোয়ান্টাইনে পাঠাচ্ছি। এড়িয়ে চলছি। কিংবা তারা জনসমাবেশে এলে প্রশাসন এর সাহায্য নিচ্ছি তাকে আবদ্ধ রাখতে। আর বিদেশ থেকে আসা কারও যদি সর্দিকাশি থাকে, তাহলে তো গ্রামশুদ্ধ সবাই পালানোর দশা! করোনা এখন শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়া দিতে শুরু করেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে হাজারো মানুষ। লকডাউন হয়ে পড়েছে প্রতিটি রাষ্ট্র। বন্ধ হয়ে পড়েছে মাঠের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব আন্তর্জাতিক আয়োজন। স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে সর্বত্র। ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার ফলে উড়ছে না বিমান। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে চাকরি হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।

মার্কিন সামরিক আধিপত্যের গর্ব পারমানবিক অস্ত্রবাহী রণতরী থিওডর রুজভেল্ট। গত ২৫ বছর ধরে দুনিয়ার সাগর-মহাসাগর দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই রণতরী। এ রণতরী থেকে যেকোনো দেশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো যায় অনায়াসে। এই রণতরী থেকে যুদ্ধ বিমান উড়ে যায়, বোমা ফেলে আবার ফিরে আসে। এই রণতরীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১শ ফুট। যা প্রায় ১০২ তলা বিশিষ্ট এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং এর সমান। সমুদ্রের পানি থেকে এটি প্রায় ২০ তলা বিল্ডিং-এর সমান উঁচু। মার্কিন সামরিক আভিজাত্যের প্রতীক রণতরী থিওডর রুজভেল্ট-এর ভেতরে করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে। সেখানে অবস্থানরত চার হাজার নাবিকের মধ্যে ১১৪ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং নাবিকদের বাঁচানোর জন্য রণতরী রুজভেল্ট-এর কমান্ডার মার্কিন নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাহায্য চেয়েছেন। রনতরী এখন নোঙরে।

এসব দেখে মনে হচ্ছে করোনা একটি বিবর্তিত সমাজের হাতছানি দিচ্ছে। যে প্রকৃতি মানুষকে এতটা উজাড় করে দিয়েছে আজ সে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে! সেই প্রকৃতিকে এখন বিশ্রাম দিতে হবে।

তিন.

করোনা রোগীর সংখ্যার থেকে হয়তো আমাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে প্রতিদিনই করোনার লক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও গ্রামে বেশ কিছু মানুষ মারা যাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা শহরেও এই সংখ্যা নেহাতই কম নয়। এর কারণও অনেক।

করোনা উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও লোকজন হাসপাতালে যাচ্ছেন না অনেকে। সেখানে গিয়ে হয়তো লাভ হবে না। কারণ উপসর্গ শুনলেই কেউ তাদের দেখবেন না। হটলাইনগুলোতেও যোগাযোগ করতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীকেও ডাকতে পারছেন না। লক্ষণ শুনলেই কেউ আসছেন না সহায়তা করতে। তাই বেশির ভাগ মানুষ বাড়িতেই থাকছেন। এমনকি বাড়িতে কেউ মারা গেলেও কাউকে জানাচ্ছেন না। করোনা ভাইরাস এখন আর শুধু রোগ নয়। নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিই প্রধান্য পাচ্ছে।

করোনা রোগটি নিয়ে আমরা একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছি। সমাজিক তা-ও কেমন বদলে গেছে। বিদেশ থাকা বা বিদেশ ভ্রমণ করা মানুষদের এতদিন সমাজে যে মর্যাদার ছিল। গেল দুই সপ্তাহে কেমন যেন পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এখন খুব কম পরিবারই পাওয়া যাবে যারা বলছে তাদের কেউ বিদেশ থাকে কিংবা বিদেশ থেকে আসছে। বিভিন্ন এলাকায় বিদেশ ফেরত বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার ফলে বিদেশফেরত লোকজনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বা পরিচয় লুকিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি আছে সামাজিক নাজেহালের ভয়। লক্ষণ শুনলেই পুরো এলাকা লকডাউন করা হচ্ছে এবং সেই পরিবারকে সামাজিকভাবে ‘হেয়’ করার বন্দোবস্ত হয়ে যায়। আর সে সময় কেউ মারা গেলে তাকে করোনার রেওয়াজ অনুযায়ী দাফন এটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তবে এসব না করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও এর কথানুযায়ী করোনা রোগী খুঁজে বের করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেই এ রোগ থেকে মুক্তি পাবো। অন্য কিছুতে নয়। কে জিতলো আর কে হারলো এটা না দেখে করণীয় কী সে আলোকে এগুতে হবে।

ইতিমধ্যে করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের উহান করোনাভাইরাস মুক্ত হয়েছে। করোনা মুক্ত হয়ে তারা উৎসবে মেতেছেন। স্বভাবিক হয়ে এসেছে উহানের জনজীবন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন তারা। যেসব চেক পোস্ট বসানো হয়েছিল সেগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। একদিন আমরাও করোনামুক্ত হওয়া উদযাপন করবো৷ সেদিনের অপেক্ষায় আছি সকলেই। আলো আসবেই।

চার.

পৃথিবীর বেশ কয়েকটা দেশ বেশ সফলভাবেই করোনাভাইরাস থেকে নিজেদের জোরালোভাবে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তার মধ্যে তাইওয়ান অন্যতম। তাইওয়ান হচ্ছে চীনের বর্ডারের সবচেয়ে নিকটতম দেশ। করোনা ভাইরাসে চীনের পরে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে তাইওয়ানে এটাই ভেবেছিল সবাই। যেহেতু দেশ দুইটা একেবারে কাছাকাছি। চীন থেকে প্রচুর মানুষ প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে তাইওয়ানে। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবে, তাইওয়ান খুব সফলভাবেই করোনাকে প্রতিরোধ করতে পেরেছে। এতো মারাত্মক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, তাইওয়ান কীভাবে এতো সফল হলো এ জিজ্ঞাসা সকলের? আসল কথা হলো, তাইওয়ান ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের সময় তাইওয়ান খুব ভালোভাবে আক্রান্ত হয়। তখনকার অভিজ্ঞতাগুলো, এবং সার্স ভাইরাস আর করোনা যেহেতু বহুলাংশে একইরকম ভাইরাস, তাই এরকম ভাইরাসের মহামারিকে ঠেকাতে কোন পদক্ষেপ নিলে একে দ্রুত আটকানো যায়, সেই অভিজ্ঞতা তাইওয়ানের ছিল। সেই অভিজ্ঞতার সফল বাস্তবায়নের সুফল পেয়েছে তাইওয়ান।

চীনে এই ভাইরাস ধরা পড়ামাত্রই তারা ব্যাপকভাবে সতর্ক হয়ে যায়। চীন ফেরত প্রতিটা ফ্লাইটকে তারা খুব ভালো অবজার্ভেশনে রাখে। প্রতিটা প্রবাসীকে তারা নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ এবং অবস্থা বুঝে যাবতীয় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একই কাজ করেছে জাপান, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডসহ আরও বেশ কয়েকটা দেশ। সেসব দেশের সরকার করোনাকে শুরু থেকেই ভালোভাবে নিয়েছে এবং বিমানবন্দর থেকে শুরু করে হাসপাতাল- সবখানে প্রস্তুত রেখেছে যাবতীয় দরকারি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যার দরুণ, এই দেশগুলোতেও করোনা কোনো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারেনি।

যেসকল দেশ একেবারে শুরু থেকে করোনা নিয়ে উদাসীনতা আর গা ছাড়া ভাব দেখিয়েছে, তাদের মারাত্মকভাবে মাশুল গুনতে হচ্ছে এখন। এই তালিকায় আছে চীন, ইরান, ইতালি, স্পেন এবং দক্ষিণ কোরিয়া। এদের মধ্যে চীন আর দক্ষিণ কোরিয়া এখন করোনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেও, বাকিদের অবস্থা এখনও শোচনীয় ও করুণ।

পাঁচ.

সব শেষে সুরা আল-বাক্বারাহ ২৮৬ নম্ব আয়াত দিয়ে শেষ করবো। ও আমাদের রব ! আমরা ভুলে গেলে বা ভুল করে ফেললে আমাদের পাকড়াও করো না। ও আমাদের পালনকর্তা!

আগেকার লোকদের উপর যেমন কঠিন বোঝা দিয়েছিলেন, আমাদের উপর তেমন বোঝা দিয়েন না।

ও আমাদের প্রভু! যে বোঝার ভার বইবার সামর্থ্য আমাদের নেই , সে-ই বোঝা চাপিয়ে দিয়েন না। আমাদের অপরাধগুলো মাফ করে দিন। আমাদের পাপগুলো গোপন করে দিন। আমাদের প্রতি দয়া বর্ষণ করুন।

আপনিই তো আমাদের প্রভু- রক্ষাকর্তা। সুতরাং অবিশ্বাসী লোকগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

লেখক: কবি, লেখক গল্পকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :