করোনায় মৃত্যু ও স্বজনদের হাহাকার

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০৯:০০

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস

যখন কেউ তার প্রিয়জনকে হারায়, সেই কষ্ট সামলানো প্রত্যেকের জীবনের কঠিন সময়গুলোর একটি। কিন্তু এখন স্বজনকে বিদায় জানানোর সেই ব্যাপারটিকে আরও কঠিন আর বেদনা-বিধুর করে তুলেছে করোনাভাইরাস। এখনকার চরম বাস্তবতা হলো, ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখা। ফলে খুব অসুস্থ এবং মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তিরাও তাদের স্বজনদের পাশে পাচ্ছেন না।

সাধারণত যেভাবে শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হয়ে থাকে, সেভাবে হচ্ছে না। মানুষজন এমনকি একসাথে মিলে শোক পালনও করতে পারছে না।

সবচেয়ে কঠিন হলো একত্রে থাকতে না পারা

নর্থফোক এন্ড নরউইচ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ আইক স্কিনডারের ৯৯ বছর বয়সী দাদাকে যখন বক্ষব্যাধির সমস্যা নিয়ে গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, তখন তিনি জানতেন যে, তার দাদা হয়তো আর বাড়িতে ফিরে আসবেন না।

তিনি বলেন, 'সাধারণ সময় হলে হয়তো আমাদের কেউ তার সঙ্গে যেতাম। সেখানে হয়তো আমরা তার ব্যাপারে আলোচনা করতাম এবং পরিবারের সদস্যদের জানাতাম। কিন্তু এখন তার বদলে তার সঙ্গে এখন আমাদের রিমোট যোগাযোগ করতে হচ্ছে।'

তিনি বলছিলেন, লন্ডন রয়েল ফ্রি হাসপাতাল খুব ভালো একটি হাসপাতাল, কিন্তু টেলিফোনে কথা বলার জন্য সেখানে খুব কম সময় পাওয়া যায়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, হাসপাতালে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি দেখা করতে পারবেন। কিন্তু তাকেও মাস্কসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম পরতে হবে।

এরপর পরবর্তী ১৪দিন তাকে আইসোলেশনে থাকতে হবে। স্কিনডারের খালা তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, 'একপর্যায়ে আমরা বুঝতে জানতে পারলাম, সেখানে একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা জানার পরেও আমার ওই খালা সেখানে অংশ নিতে পারেননি, কারণ তখন দাদাকে দেখে আসার কারণে তিনি আইসোলেশনে রয়েছেন।'

স্কিনডার বলেন, যখন তার দাদার মৃত্যু হয়, তখন পরিবারের সবাই বুঝতে পারছিলেন যে, এখানে নতুন করে আর কিছু করার নেই। তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয়টি ছিল এরকম একটি সময়েও পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হতে না পারা। যেদিন শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়, সেদিন তিনি বাড়িতে আইসোলেশনে ছিলেন, কারণ তার দুই বছর বয়সী শিশুটি জ্বরে ভুগছিল।

দাদার শেষ বিদায় অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে না পেরে জুমের মাধ্যমে ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়। তাদের ১২জন আত্মীয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে সেই অনুষ্ঠান দেখেন। শুধুমাত্র তার মা, বাবা আর বোনরা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তার পিতামাতার কাছ থেকে দুইমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বোন।

শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরে পরিবারের সদস্যরা আরেকটি জুম অ্যাপ ব্যবহার করে আরেকটি মিটিং করেন। সেখানে তারা সদ্য বিদায়ী দাদার স্মরণে নানা গল্প করেন, টোস্ট পান করেন পুরো ব্যাপারটি হয় রিমোট বা দূর প্রযুক্তি ব্যবহার করে। স্কিনডার বলছেন, 'এটা একেবারেই বাস্তবের মতো লাগছিল না'।

শেষকৃত্যানুষ্ঠান নিয়ে কী বলছে ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগ?

  • যারা শেষকৃত্যানুষ্ঠান পরিচালনা করবেন, তাদের অবশ্যেই দায়িত্ব হবে যাতে যতটা সম্ভব কম মানুষ উপস্থিত থাকেন।
  • শুধুমাত্র ওই পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা সেখানে অংশগ্রহণ করবেন।
  • করোনাভাইরাসের লক্ষণ রয়েছে, এমন কেউ সেখানে অংশগ্রহণ করবেন না।
  • পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত না হলে খুব কম সংখ্যক বন্ধু অংশ নিতে পারেন।
  • সেখানে এমন কোন ক্রিয়াকর্ম করা যাবে না, যাতে মৃতদেহের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে কাউকে আসতে হয়।

 

৪০ বছর ধরে শেষকৃত্যানুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন ফিউনারেল ডিরেক্টর লিয়ানা চ্যাম্প। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি আসলেই হৃদয়বিদারক। এটা দেখা খুবই হৃদয়বিদারক যে, পরিবারের সদস্যরা ছয় ফিট দূরে দূরে বসে আছেন, একজন আরেকজনকে স্পর্শও করতে পারেন না। আপনি ভাবতে পারেন যে, তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নিতে কে কে যাবেন আর কে যাবেন না!

তিনি জানান, 'করোনাভাইরাসের কারণে শেষকৃত্যানুষ্ঠান এমন কিছুতে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের অচেনা। যখন কেউ মারা যায়, মানুষ কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার কথা ভাবে, একত্রে থাকার কথা ভাবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের ভীতি আমাদের জীবন-মৃত্যু সবকিছুতে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পরিবর্তন এনেছে মানুষের শেষ বিদায়ের মতো আনুষ্ঠানিকতাতেও।'

লেখক ও শোক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চ্যাম্প মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দেয়া যে, দাফনের মতো অনুষ্ঠানে যাতে কোন বন্ধু বা স্বজনদের উপস্থিতি না থাকে। মানুষ যখন শোকের মধ্যে থাকে, তখন পরিচ্ছন্নটার ব্যাপারে কম সতর্ক থাকে-যেমন তারা চেয়ার-টেবিল স্পর্শ করে ফেলে অথবা তাদের নাক পরিষ্কার করে ফেলে। এখানে আরও অনেক মানুষ উপস্থিত থাকে, তাদের স্বাস্থ্য সতর্কতারও ব্যাপার রয়েছে।

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, যে জীবন বেঁচে রয়েছে, মানুষের এখন সেদিকেই বেশি নজর দেয়া উচিত। যিনি মারা গেছেন, বা শেষকৃত্য নিয়ে বেশি মনোযোগ বা চিন্তার সময় এটা নয়। সূত্র: বিবিসি

ঢাকা টাইমস/০৬এপ্রিল/একে