তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাসের গতিবিধি

ড. আসিফ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১৭:৪৩

শীতকালীন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামক রোগের ইতিহাসে এর প্রাচীনতম তথ্য পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে হিপোক্রেটিস লিখিত গ্রিক বই ‘বুক অব এপিডেমিকস’-এ। ২০০২-০৩ সালের সার্স করোনাভাইরাস (SARS Cov) এবং সাম্প্রতিক সার্স করোনাভাইরাস-২ (SARS Cov-2) শীতকালে বিস্তৃতি লাভ করেছে। শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, এদের বিস্তারে ঠান্ডার একটি ভূমিকা রয়েছে, যেটাকে সংক্রমণের ওপর ঋতুর প্রভাব হিসেবে দেখা হয়। ঋতুর এই প্রভাব বেশ কয়েকটি উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রার পরিবর্তন, পরম আর্দ্রতা (বাতাসে জলীয় বাস্পের পরিমাণ), সূর্যের আলো, ভিটামিন এ-র অবস্থা, এবং ব্যক্তির আচরণ। পরিবেশের উপকরণগুলো ব্যক্তির শ্বাসনালিতে ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ভাইরাসের টিকে থাকা এবং শরীরে বাসা বাঁধার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখে। আর ব্যক্তির আচরণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি।

ঋতুনির্ভর সংক্রমণ বা সিজনাল ইনফেকশন হলো বছরের কোনো একটি সময়ে একটি রোগের প্রকোপ। এই বিষয়টি বেশি প্রযোজ্য ছিল যখন মানুষ অত্যন্ত কঠিন জলবায়ুতে প্রায় কোনো প্রতিরক্ষা ছাড়াই বসবাস ও কাজকর্ম করত। কিন্তু শিল্পায়নের সাথে সাথে মানুষ প্রকৃতি এবং বাইরের জলবায়ু থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছে। সময়ের পরিক্রমায় মানুষ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, আবদ্ধ বাসা বা অফিসে ঢুকে গেছে, যেখানে আরামদায়ক তাপমাত্রা তাকে বাইরের পরিবেশের জলবায়ুর থেকে প্রায় আলাদাই করে দেয়। বৃষ্টি, রোদ, ঠান্ডা বা বরফ মানুষের কাজের ওপর কমই প্রভাব ফেলে, ফলে সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে মানুষে মানুষে যোগাযোগ সারা বছর প্রায় একই রকম মাত্রায় থাকে। বরং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সেটা কিছুটা হলেও কমে বাসাতে সীমাবদ্ধ হয়। তাই বাসা, গণপরিবহন কিংবা কর্মস্থল- এই যুগের মানুষ জীবনের ৯০ শতাংশ সময় এসব আবদ্ধ জায়গায় কাটিয়ে দেয় যেখানে শ্বাস নেওয়ার বাতাস যথেষ্ট সীমিত। বাকি যে ১০ শতাংশ সময় মানুষ প্রকৃতির কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়, সেই সময়ে শরীর প্রাকৃতিকভাবে ভাইরাস মোকাবেলার কিছু কৌশল রপ্তদ করে নেয়।

অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার দেশগুলোতে (টেম্পারেট রিজিওন) শ্বাসতন্ত্রের প্রায় নয় রকমের ভাইরাসের তথ্য থেকে দেখা যায়, এরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এদের সংক্রমণ ঘটায়। এর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, হিউম্যান করোনাভাইরাস, আরএসভি ভাইরাস (রেস্পিরেটরি সিন্সাইসিয়াল ভাইরাস) স্পষ্টভাবেই শীতের মাসগুলোতে দেখা দেয়। তাই এদের শীতকালীন ভাইরাস বলা হয়। এ ছাড়া কিছু ভাইরাস সারা বছর ছড়ায়, আর কিছু ভাইরাস কেবল গরমের সময় দেখা যায়।

ভাইরাসগুলো আবার মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতা করে, তাই শীতের মাসগুলোতে প্রতিটা ভাইরাসের সর্বাধিক মানুষ সংক্রমণের হটস্পট সময়টা আলাদা আলাদা হয়। মানুষের শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টিকারী চারটি হিউম্যান করোনাভাইরাসের ওপর তিন বছর গবেষণার একটি ফল প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালে জার্নাল অব ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলজিতে, যার মুখ্য লেখক ছিলেন ই আর গন্ট। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে রয়্যাল ইনফারমারি অব এডিনবরাতে ১১ হাজার ৬৬১টি নমুনার তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন করনোভাইরাসগুলো মূলত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল এই মাসগুলোতেই বেশি মানুষকে সংক্রমিত করে। কিন্তু এবার নতুন কোভিড-১৯ সম্পর্কে এখনো এত পর্যাপ্ত তথ্য বিজ্ঞানীদের হাতে আসেনি যা থেকে খুব সোজাসুজি কোনো যোগসূত্র টানা যায়। তবে সার্স ও কোভিড-১৯ কাছাকাছি ভাইরাস হওয়াতে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন কিছু মিল হয়তো পাওয়া যাবে।

বাতাসে পরম আর্দ্রতা হলো প্রতি ঘনমিটারে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ, অপরদিকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা হলো যতটা জলীয় বাষ্প থাকতে পারত তার প্রেক্ষিতে কতখানি আছে তার অনুপাত, যা শতকরায় প্রকাশ করা হয়। এই মান যত বেশি হয় তত বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ে এবং বেশি গরম অনুভূত হয়। বিভিন্ন আপেক্ষিক আর্দ্রতায় শীতকালীন ভাইরাসগুলো মানবদেহের বাইরে ছোট পানির কণা (ড্রপলেট) বা অতিক্ষুদ্র কণা (এরোসল) অথবা কোনো বস্তুর ওপর কত সময় টিকে থাকে এ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, হিউম্যান করোনাভাইরাসসহ প্রায় সব শীতকালীন ভাইরাসই অতিমাত্রার আপেক্ষিক আর্দ্রতাতে (>৮০%) খুব কমই টিকে থাকতে পারে। উলটো করে বললে ঘরের ভেতর আরামদায়ক তাপমাত্রা (২০-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও কম আপেক্ষিক আর্দ্রতায় (২০-৫০%) শীতকালীন ভাইরাসগুলো সহজে অকার্যকর হয় না। এই পরিবেশ ভাইরাসের লিপিডগুলোকে আরও সুসজ্জিত হতে সাহায্য করে ভাইরাসগুলোর টিকে থাকা সহজ করে দেয়। ইঁদুর, ফেরট ও গিনিপিগের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে-শুষ্ক, কম বাতাস চলাচল করে এমন পরিবেশে প্রাণী থেকে প্রাণীতে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ৪৭% আর্দ্রতায় ৭০% আর্দ্রতার তুলনায় বেশ বেড়ে যায়। গিনিপিগের ওপর অন্য পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও কম আর্দ্রতায় (২০-৩৫%) অসুস্থ গিনিপিগ থেকে সুস্থ গিনিপিগে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ঘটে। কিন্তু একই তাপে উচ্চ আর্দ্রতায় (>৮০%) সেই সংক্রমণ দেখা যায় না। আবার তাপমাত্রা যদি আরও কম হয়, যেমন ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেক্ষেত্রে ৮০% আর্দ্রতাতেও সংক্রমণ দেখা যায়।

অতি ঠান্ডা আবহাওয়াতে শরীরের শ্বাসনালি থেকে ভাইরাস বের করতে পারার ক্ষমতা কমে যাওয়া, ভাইরাসের শ্বাসনালিতে টিকে থাকার শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া এবং পরম আর্দ্রতা কম থাকা এর কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে। আবার ট্রপিকাল অঞ্চলে (যেখানে ঠান্ডার সময়গুলোতে গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে) যেখানে তাপমাত্রা বেশি, সেখানে আর্দ্রতার তারতম্য ভাইরাসের ওপর তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে না। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শীতপ্রধান দেশগুলোতে এরোসল ভাইরাস ছড়ানোর মূল মাধ্যম, অপরদিকে গরম দেশগুলোয় যেকোনো বস্তুর স্পর্শ থেকে এটি বেশি ছড়ায়। কারণ গরম ও আর্দ্র দেশগুলোয় ড্রপ্লেট সহজে শুকায় না, তাই ভেসে না থেকে ভারি ড্রপলেট দ্রুত নিচে কোনো বস্তুতে পড়ে এবং লেগে থাকে। তবে শীতপ্রধান অঞ্চলে এরোসলের ক্ষেত্রে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৪০-৬০% আর্দ্রতা বজায় রাখাকে ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর আদর্শ সীমা ধরা হচ্ছে।

আমাদের শ্বাসনালির বাতাসপ্রবাহ প্রাথমিকভাবে এই নালির দেয়ালে ভাইরাস সংক্রমণ কমিয়ে রাখতে সক্ষম। শ্বাসনালির গায়ে যে মিউকাস বা শ্লেষ্মা তৈরি হয়, তা পর্যাপ্ত পরিমাণ জলীয় বাষ্প পেলে প্রবাহিত হতে পারে এবং ভাইরাসকে শ্বাসনালি থেকে বের করে দিতে পারে। কিন্তু শুষ্ক শ্বাসনালিতে এই মিউকাস সরে যেতে পারে না এবং নালির গায়ে আটকে থেকে ভাইরাসের শরীরে প্রবেশে ভূমিকা রাখে। শ্বাসনালীর যেই এপিথেলিয়াল লেয়ার থাকে তার গায়ে কিছু সুতার মতো তন্তু থাকে যাকে সিলিয়া বলে। শুষ্ক বাতাস এই সিলিয়াগুলো নষ্ট করে দেয়, নতুন সিলিয়া তৈরি বাধাগ্রস্ত করে ফলে ভাইরাস সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করার রাস্তা পেয়ে যায়। এ ছাড়া শীতপ্রধান দেশে সূর্যের আলোর ঘাটতির ফলে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি হয়, এতে ভাইরাস মোকাবেলার ক্ষমতা কমে আসে আমাদের শরীরে। তাই সার্বিকভাবে শুষ্ক পরিবেশে ঘরে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করে আর্দ্রতা বজায় রাখা, আলো বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা, মাস্ক পরে নাকের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা, পুষ্টিকর খাবার ও ভিটামিন নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত ঘুম ও সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে জোর তাগিদ এসেছে। এই নতুন কোভিড ১৯ গরম ও আর্দ্র অঞ্চলগুলোতে ঠিক কেমন আচরণ করবে সেটি সামনের দিনগুলোতে আমরা আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারব।

[এই লেখাটি Miyu Moriyama ও তার সহগবেষক লিখিত Annual Review of Virology তে প্রকাশিত Seasonality of Respiratory Viral Infections অবলম্বনে লেখা। মূল লেখাটি এখানে পাবেন https://doi.org/10.1146/annurev-virology-012420-022445]

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইলঃ [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :