করোনার পর করাল গ্রাস আসছে, বাঁচতে পারব তো?

পার্থ ব্যানার্জি
| আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৫০ | প্রকাশিত : ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০৯:২৪

এই মুহূর্তে এখানে আমেরিকায় ১২,৬৯২ জন করোনাভাইরাসের বলি হয়েছেন। এক কোটিরও বেশি আমেরিকান কর্মচ্যুত মাত্র দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে।

আমরা এখানে এই মনুষ্যত্ব-বিরোধী সিস্টেমের বলি।

না, শুধু পুঁজিবাদ দায়ী নয়। পাশের দেশ ক্যানাডা -- ঠিক আমেরিকার মতোই ধনী, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। ভাইরাসের বলি- ৩৭৫ জন। অন্য পাশের দেশ মেক্সিকো -অনেকটা ভারতের মতো ধনী-দরিদ্র মেশানো, ধনীরা প্রচণ্ড ধনী, আর গরিব অগণিত। চরম দুর্নীতি ঠিক ভারতের মতোই। সেখানেও মৃত মাত্র ১২৫ জন।

আমেরিকা সম্পর্কে আমি বহুকাল ধরে লিখে আসছি। আলোচনা করে আসছি। পড়িয়ে আসছি। আমার হাজার হাজার মার্কিন ও ভারতীয়, বাঙালি ছাত্রছাত্রী যারা আমার ক্লাস নিয়েছে, আলোচনায় অংশ নিয়েছে, তাদের চোখ খুলে গেছে। কিন্তু আমার ক্ষমতা সামান্য। আমার পক্ষে কোটি কোটি ভারতবাসী ও বাঙালিকে শেখানো সম্ভব নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ঠুর, নির্দয়, যুদ্ধবাদী, হিংস্র এবং মানবতার শত্রু আমেরিকার বর্তমান আর্থ-সামাজিক সিস্টেম। যে সিস্টেম সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে দেয়। তাদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করে তারপর তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয়। যে সিস্টেম বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, হিংসা ও রক্তপাতের জন্যে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে, কিন্তু তাদের নিজের দেশের মধ্যে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, পরিবহণ ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, ব্রিজ মুমূর্ষু।

এই সিস্টেমের কঠোর সমালোচনা করা, এই সিস্টেমকে উলঙ্গ করে মানুষের চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার আর জরুরি প্রয়োজন। তার অর্থ আমি আমেরিকা-বিরোধী, আমেরিকা-বিদ্বেষী নই।

ঠিক যেমন ভারতের নিষ্ঠুর, রেসিস্ট, মিথ্যাচারী শাসকশ্রেণীর মুখোশ খুলে দেওয়ার অর্থ ভারতবিদ্বেষ নয়, দেশদ্রোহিতা নয়। বস্তুতঃ, এই কাজ করার অর্থ দেশকে আরো বেশি ভালোবাসা, মানুষকে আরো বেশি ভালোবাসা। কারণ, সত্য উন্মোচিত করে দেওয়ার মাধ্যমে আমি মানুষের চেতনার জাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। ক্ষুদ্র ক্ষমতায়।

বিদেশে থেকেও দেশকে খুব ভালোবাসা যায়। আমি সামান্য মানুষ, সুভাষ বসু, রাসবিহারী বসু, মাইকেল মধুসূদন নই। গান্ধীও বিদেশে থেকেই দেশের কাজ আরম্ভ করেছিলেন। বিদেশে থেকে দেশের মানুষের জন্যে কাজ করা নতুন কিছু নয়। ওদের পার্টির ধর্মান্ধরাও কিন্তু বিদেশে থেকে দেশে ডলার, পাউনড পাঠাচ্ছে। লবিং করছে। ওরা যদি তা করতে পারে, আমরা আমাদের মতো করে মানুষের কাছে আসল খবর পৌঁছে দেবোনা কেন? সংগঠিত করবোনা কেন?

আজ হোক, কাল হোক, কয়েক মাসের মধ্যে হোক, এই করোনাভাইরাস মহাসঙ্কট একদিন শেষ হবে। অনেক প্রাণ, অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। তাদের স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যার কান্না কেউ শুনতে পাবেনা। এই শাসকশ্রেণী ও তাদের মিডিয়া সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছে দেবেনা।

আজ পর্যন্ত আমি এই আমেরিকায় টিভিতে একজন মৃত মানুষের পরিজনের কান্না শুনতে পাইনি। ঠিক যেমন ইরাক যুদ্ধের বর্বরতার সময়েও মৃত মানুষের কান্না আমেরিকার মিডিয়া আমাদের দেখতে দেয়নি। তাদের ভয়, মানুষ ক্ষেপে উঠতে পারে যুদ্ধের আসল চেহারা দেখে, বর্বরতা দেখে।

ঠিক তেমনই এখনো মিডিয়াতে এই ১২,৬৯২ জন মৃত মানুষের পরিবার পরিজনের কান্না আমাদের শুনতে দেওয়া হয়নি। কারণ, মানুষ ক্ষেপে উঠতে পারে এই সিস্টেমের ব্যর্থতার আসল চেহারা দেখে। ওরা বুঝে গেছে, রক্ত, কান্না, জ্বালা যন্ত্রণা, ক্ষুধার হাহাকার, হঠাৎ বেকার হয়ে যাওয়া এক কোটি আমেরিকানের হতাশার ছবি যদি লুকিয়ে রাখা যায়, তাহলেই সাধারণ মানুষের ক্রোধের সম্ভাবনাকে অনেকটাই বন্ধ করে রাখা যাবে। "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।" এই মডেল আশ্চর্যরকম সফল।

বাকিদের জন্যে আছে দেশনেতাদের সর্বময় নিরঙ্কুশ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এই সঙ্কট যেদিন শেষ হবে, সেদিন সেই তৈরি করা নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো জায়গাই আর অবশিষ্ট থাকবেনা। তারপর, সেই নেতারা "দেশের প্রয়োজনের তাগিদে" যে কোনো আইন পাশ করবেন। আপনার পেনশন, আপনার ব্যাঙ্কে সারাজীবনের অর্জিত সামান্য পুঁজি, আপনার সুদ, আপনার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হবে একটু একটু করে।

করোনাভাইরাসের করাল গ্রাস থেকে হয়তো কোনোভাবে আমার দেশ বাঁচবে। হয়তো আমেরিকার মতো মৃত্যু মিছিল হবে না। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমার দেশকে বাঁচাও। গরিব মানুষদের বাঁচাও।

কিন্তু তারপর যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক করাল গ্রাস আসছে, তার থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবেন তো?

আমি এতোদূর থেকে কী বলবো? সামান্য মানুষ। আপনারাই ভেবে দেখুন।

লেখক: লেবার এডুকেডর, এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল ট্রাস্ট ফান্ড, ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :