মৃত্যুর নৈকট্য থেকে ফেরা

মজিবর রহমান খোকা
| আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২০, ১৬:০২ | প্রকাশিত : ০৮ এপ্রিল ২০২০, ১৩:১৪

বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের দু' সপ্তাহ পরেও নাটোরসহ উত্তরাঞ্চলের সব জেলা, মহকুমায় অফিস-আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, স্কুল-কলেজ সবকিছু বন্ধ রয়েছে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া অপ্রতুল। মানুষের চলাচল আগের তুলনায় বহুলাংশে কম। সন্ধ্যার পর পুরো শহর নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

লোকমুখে জানা যায়, পাবনার দাশুরিয়া, নাটোরের গোপালপুর চিনিকলে পাকসেনাদের সাথে বাঙালি পুলিশদের গুলিবিনিময় হচ্ছে। রেডিওর খবরে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে হানাদার পাক-বাহিনীর সাথে বাঙালি সেনা ও গেরিলাদের যুদ্ধ চলছে। আমরা উদ্বুদ্ধ হই। অনুপ্রাণিত হই। আনন্দিত হই জেনে যে, ভারত আমাদের সংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারও আমাদের পক্ষে কথা বলছে। হাউস অব কমন্স সভায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথের সেক্রেটারি আমাদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে তা বন্ধের আহ্বান জানান।

দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা আমাদের মাঝে কেউ সঠিকভাবে বলতে না পারলেও তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, যুদ্ধ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প পথ নেই। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নাটোর মহকুমা প্রশাসকের পক্ষ থেকে মাইকযোগে ঘোষণা করা হলো, 'পাকসেনারা নগরবাড়িতে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে পাবনার দিকে এগিয়ে আসছে । জনগণকে অতিসত্বর নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।'

আমাদের বাসায় তখন রাজশাহী থেকে বড় আপার চার ছেলেমেয়ে, দুলাভাই এবং তাঁর ভগিনা-ভাগিনী, আমার ফুফুতো ভাই, রুয়েটে অধ্যায়নরত তালতো ভাই, আমাদের গ্রামের এক আত্মীয়সহ আমাদের আটজন পরিবার। সর্বমোট ১৮ জন সদস্য। নাটোরের প্রত্যন্ত অঞ্চল হালদা গ্রামে আব্বার একটি সাইড অফিস আছে। তিনি পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের রিকশাযোগে রওয়ানা দিয়ে সেখানে রেখে রাতে ফিরে এলেন।

পরদিন সকালে ফুফুতো ভাই এবং গ্রামের আত্মীয়র সঙ্গে চাল-ডাল ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ রিকশাযোগে গিয়ে আবার ফেরত এলেন।

বাসায় আমরা তিনজন। আব্বা, আমি আর আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই বাবু।

সকালে একটি রিকশায় কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আমরা তিনজন হালদার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। আমাদের বাড়ির আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, বই-খাতা, জামা-কাপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পুনরায় পাওয়ার আশায় রয়ে গেল।

আমরা শহরের পুবে মাদ্রাসা মোড় পার হয়ে মাইলখানিক যাওয়ার পর হরিশপুর এলাকায় হানাদার পাক-বাহিনীর সামনে পড়লাম । তারা পাবনা থেকে সাঁজোয়া বহর নিয়ে রাস্তার দু'ধারের বাড়ি-ঘর লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এবং অগ্নিসংযোগ করতে করতে নাটোরের দিকে ধেয়ে আসছে। আমরা কোনোমতে রাস্তার বামে একটি জরাজীর্ণ কুড়ে ঘরের উঠোনে রিকশা ঢুকিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ রান্না ঘরে একটি ট্রেঞ্চ দেখে মুহূর্তের জন্য বিস্মিত হয়ে আমরা চারজন ঢুকে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলাম। আমরা পাকসেনাদের অশ্লীল গালাগাল আর গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ ছোটভাই ভীত হয়ে ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠে খোলা মাঠের দিকে দৌড়ে পালালো। আমরা শঙ্কিত হলাম! সে হয়তো এখন হানাদারদের গুলিতে মারা পড়বে।

আমরা তার আর্তচিৎকার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে পাকসেনাদের কয়েকজন গোলাগুলি আর গালাগাল করতে করতে বাড়ির উঠোনে এসে উপস্থিত হলো। তাদের বুটের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। যেন আজরাইলের পদধ্বনি। আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে দোয়া পড়ছেন। আমি বিনা অপরাধে মৃত্যুর প্রহর গুণছি। হানাদাররা জীর্ণ ঘরের দরজায় লাথি দিয়ে ভেতর উঁকি দিয়ে কাউকে না পেয়ে গজগজ করতে লাগলো। সেই মুহূর্তে শুনলাম, রাস্তা থেকে কেউ কারো উদ্দেশ্যে ডাকছে। উঠানে দাঁড়ানো হানাদারদের বুটের শব্দ ধীরে ধীরে অপসৃত হলো। তবুও আমরা নিঃশব্দে বসে রইলাম।

তারা চলে যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর, আমরা ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে বিস্ত্রীর্ণ খোলার ভেতর দিয়ে রিকশা ঠেলে নিয়ে দূর গ্রামে গিয়ে উঠলাম। সেখানে আমরা বাবুকে পেলাম না। আব্বা চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকছে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করছে। কেউ দেখেনি বলে মাথা নাড়ছে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর একজন বললো, হ্যাঁ, হাফপ্যান্ট পরা এক ছেলেকে একজন লোকের সাথে পুব দিকে যেতে দেখেছে।

আব্বা এবং আমি দোয়া পড়তে পড়তে হালদা অফিসে গিয়ে দেখি বাবু সেখানে। সে অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেছে। পাকসেনারা তাকে উদ্দেশ্য করে গুলি করেছিল কিন্তু সে আঁকাবাঁকা ভাবে দৌড়ানোয় গায়ে গুলি লাগেনি। আমরা পৌঁছানোর আগেই বাবু সেখানে ভয়াবহ বিপদের কথা বলায় সবাইকে আমাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।

সেদিনই সিদ্ধান্ত নেই-- মুক্তিযুদ্ধে যাবার।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকাশক, বিদ্যাপ্রকাশ।

ঢাকাটাইমস/৮এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :