বাসায় শবে বরাতের ইবাদত প্রসঙ্গে

বিল্লাল বিন কাশেম
 | প্রকাশিত : ০৯ এপ্রিল ২০২০, ১১:১৯

শব ও বরাত দুটি শব্দ ফারসি থেকে এসেছে। শব এর অর্থ রাত ও বরাত এর অর্থ সৌভাগ্য। আর আরবি শব্দ লাইলাতুন। 'শবে বরাত' অর্থ মুক্তি বা নিষ্কৃতির রজনী। আরবি মাসের ১৪ শাবান দিবাগত রাতকে বলা হয় শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত। আর হাদিসের ভাষায় লাইলাতুম মিন নিসফে শাবান বলা হয়েছে। উপমহাদেশে এই রাতকে শবে বরাত বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুসলমান নফল ইবাদাতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করেন। অনেক অঞ্চলে, এই রাতে তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করেন। তবে সালাফি ধারা, শবে বরাতের রাতে বিশেষ ইবাদত আয়োজনের বিরোধিতা করে। মা আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সা. বলেন, এই রাতে আল্লাহপাক প্রথম আসমানে নেমে আসেন অতঃপর বনি কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরীফ)। হজরত আবু মুসা আশয়ারি রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সা. এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাতে সকল সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক, জাদুকর, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। হজরত আলী রা. বলেন, রাসুল সা. এরশাদ করেন, ইজা কানাত লাইলাতুন নিসফি মিন সাবান, ফা কুমু লাই লাহা,ওয়া সুমু ইয়াও মাহা অর্থাৎ যখন শাবান মাসের মধ্যের রাত হয়, তখন তোমরা সেই রাতে জাগরণ করো এবং পরের দিন রোজা রাখো।

হাদিসের আলোকে এবং ফেকাহের বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী শবে বরাত উপলক্ষে পাঁচটি আমলের কথা প্রমাণিত হয়। (১) এই রাত্রে এবাদত বন্দেগী জিকির আজগার তেলাওয়াত এবং নফল নামাজে মশগুল থাকা; (২) পিতা মাতা আত্মীয় স্বজনদের কবর জিয়ারত করা, তবে রাসুল সা. একা একা কবরস্থানে গিয়েছেন, আমরাও একাকি যাবো। নতুবা বাড়িতে বসে কবর যিয়ারতের নিয়তে, কবর জিয়ারত করব; (৩) দান সদকা করা অথবা গরিবদের জন্য কিছু আহারের ব্যবস্থা করে মৃত ব্যক্তিদের জন্য সওয়াব পৌঁছে দেয়া যেতে পারে, তবে এই রাত্রে হালুয়া রুটি করা একটি বদ রছমে পরিণত হয়েছে, এর থেকে বিরত থাকার জরুরি। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষের কাছে শবে বরাতে ইবাদত বন্দেগি এত গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ এই হালুয়া-রুটি তৈরি করা। এইজন্য উলামায়ে কেরামের মতে এই দিন উপলক্ষে হালুয়া রুটি তৈরি করা বেদায়াত; (৪) পরদিন অর্থাৎ ১৫ শাবান নফল রোজা রাখা উত্তম; এবং (৫) শবে বরাত রাত্রে গোসল করা মুস্তাহাব, মাগরিবের নামাজ পড়েই ইবাদতের নিয়তে গোসল করা। উপরোক্ত আমল ছাড়া মানুষের মনগড়া আমল, যেমন পটকা ফোটানো, আতর বাজি, মোমবাতি জ্বালানো মসজিদে আলোকসজ্জা করা এগুলো নাজায়েজ।

শবেবরাতের নফল নামাজ নিজ নিজ বাড়িতে পড়া উত্তম কেননা রাসুল সা. বলেন, তোমাদের বাসস্থানকে কবরস্থান বানিও না। তাছাড়া বর্তমান করোনা ভাইরাস ছোবলে থমকে গেছে গোটা বিশ্ব, অধিকাংশ দেশ লকডাউনে আছে। মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে আমরা নফল ইবাদাত জন্য মসজিদে অবস্থান করা, এটা এই মুহুর্তে কারোর জন্য সমীচীন হবে না। আল্লাহ শবে বরাতের বরকতে করোনা মহামারি নামক গজব, আমাদের থেকে উঠিয়ে নিন এবং আমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দিন।

দুই.

আজ ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পালিত হবে শবে বরাত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ইবাদতের মাধ্যমে শবে বরাত রাত পালন করেন। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে পালন হবে মুসলিমদের পবিত্র এ রাত। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেকোনো বড় জনসমাগম এড়িয়ে চলার। এমনকি জরুরি কাজ ছাড়া বাসার বাইরে বের না হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে জনগণকে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদেরকেও বাসায় থেকে নামাজ পড়ার অনুরোধ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। পবিত্র শবে বরাত ঘরে বসে নিজের মতো করে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৫ এপ্রিল রবিবার গণভবনে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানান তিনি। শবে বরাতে সকলে ঘরে বসে দোয়া করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দোয়া করুন যেন মহান আল্লাহ আমাদের বরাত ভালো রাখেন। দেশের মানুষ যেন এগিয়ে যেতে পারে। এ মহামারি থেকে যেন বিশ্ববাসী রক্ষা পায়।

শবে বরাত মুসলমানদের আমল করার একটি বিশেষ দিন। ভারতীয় উপমহাদেশে এ দিনটি বিশেষ মর্যাদায় পালিত হয়। শবে বরাত একটি ধর্মীয় রীতি হিসেবে চালু রয়েছে। একইরকম ব্যপক আয়োজনে প্রতি বছর এটি পালন করতেই হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। জুমার নামাজ তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু সেই নামাজও এখন প্রতীকী রূপে পালন করা হচ্ছে বিশ্বের দেশে দেশে। মসজিদের প্রধান আর তার সঙ্গে চারজন নামাজে অংশ নিচ্ছেন। সকলকে বলা হচ্ছে বাড়িতে বসে নামাজ পড়তে। মনে রাখতে হবে, গোটা বিশ্বে মহামারি শুরু হয়েছে। তার জন্য সামাজিক দূরত্ব তৈরি করা খুবই জরুরি। এবার আমাদের দেশেও শবে বরাতে ঘরোয়া আয়োজনে পালিত হবে। এ সংকটের সময় মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় ও নফল ইবাদত রুখসতের বা সীমিত উপস্থিতির সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী বলেও আলেমগণ মনে করেন।

তিন.

প্রতিবছর শবে বরাতে আমাদের দেশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নামে। ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি রাতভর বিভিন্ন নফল ইবাদত করেন তারা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নানা আয়োজন থাকলেও এবার করোনা ভাইরাসের প্রভাবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সারাবিশ্বেই যেকোনো গণজমায়েতকে নিরুৎসাহিত করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এটি মাথায় রেখে বিশ্বের ইসলামি চিন্তাবিগণ নফল ইবাদত ব্যক্তিগতভাবে করাই উত্তম বলে মত দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে নফল ইবাদত ঘরে করাই উত্তম। এ বছর শবে বরাতের ইবাদত-বন্দেগি নিজ নিজ ঘরে পালন করার আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানানো হয়। এদিকে, ইসলামি চিন্তাবিদরাও জানিয়েছেন, জরুরি পরিস্থিতিতে এমনভাবে ইবাদত করতে ধর্মীয় স্বীকৃতিও রয়েছে। শবে বরাতের রাতে সাধারণত বিপুল সংখ্যায় মুসল্লিরা বিভিন্ন মসজিদে জমায়েত করেন। এটি এড়ানোর বিষয়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ভারপ্রাপ্ত খতিব ও সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মিজানুর রহমান বিশেষ নির্দেশনার কথাই জানালেন। যেহেতু পরিস্থিতি এখনও উন্নতির দিকে আসেনি, সতর্কতা অবলম্বন এখনও অনেক জরুরি৷ শবে বরাতে আমরা মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে ইবাদত-বন্দেগি করার আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। মসজিদেও বড় আকারের জমায়েত হয়ে থাকে। কিন্তু এবারের শবে বরাতে আমরা দীনদার মুসল্লি ভাইবোনদের কাছে আমাদের অনুরোধ এই পরিস্থিতিতে আমরা মসজিদে জড়ো হব না। বরং আমরা যার যার অবস্থানে বাসায় থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবো, ফরিয়াদ জানাবো যাতে এই মহাবিপদ থেকে তিনি আমাদের উদ্ধার করেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে পরামর্শ করে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই বার্তা দেশের মানুষের কাছে জানানো হয়েছে বলেও জানান বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম। বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের কাছেও এ বার্তা এরই মধ্যে পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

চার.

আমাদের বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্র ভারতেও প্রায় একই অনুরোধ জানানো হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য থেকে। কদিন আগেই দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাবলিগ-ই-জামাতের ধর্মীয় জমায়েত থেকে বিশাল আকারে ছড়িয়েছে করোনা সংক্রমণ। জামাতে অংশ নেওয়া সাতজন এরই মধ্যে করোনায় মারা গেছেন। জমায়েতে অংশ নেয়ার পর তারা ছড়িয়ে পড়েছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে জমায়েতে অংশ নেয়া শতাধিক ব্যক্তিকে। এই জমায়েতের মাধ্যমে লকডাউনের মধ্যেও করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে ভারত। ফলে শবে বরাতের রাতকে ঘিরে একটু বিশেষভাবে বার্তা দিচ্ছেন ধর্মীয় নেতা ও বিশেষজ্ঞরা। ভারতের সব মুসলিম প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় সংগঠনের প্রধান প্রতিষ্ঠান মজলিস মুশায়েরাত এরও একই আহ্বান। সর্ব ভারতীয় মুসলিম মজলিস মুশায়েরাতের সভাপতি নাভেইদ হামিদ বলেছেন, করোনা মহামারি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে৷ হজযাত্রাও আপাতত স্থগিত রাখার কথা বলা হচ্ছে। জুম্মার নামাজ বাড়িতে বসে হচ্ছে৷ এই অবস্থায় কোনওভাবেই শবে বরাতের অনুষ্ঠানে জমায়েত হতে দেওয়া যাবে না। আমরা চাই না একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি কেউ কোথাও থাকুন। শবে বরাতের প্রার্থনা বাড়িতে বসেই হবে।

পরিশেষে বলবো শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা, রোজা রাখা, সদকা করা, তওবা করার বিষয়টি নফল ইবাদতের মধ্যে পড়ে। যেহেতু মসজিদে জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজও সীমিত রাখা হয়েছে বিধায় শবে বরাতের ইবাদতের দিনটিও আমরা ঘরোয়াভাবে আদায় করবো ইনশাআল্লাহ। বুখারি শরিফের ৫৭৩৪ নাম্বার হাদিসেও বলা হয়েছে, এরকম মহামারির সময়ে ঘরে বসে ফরজ ইবাদত করা শ্রেষ্ঠতম। আল্লাহ আমাদের সকলকে এই সংকট মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।

লেখক: উপ-পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :