মানসিক চাপ সামলানোর বৈজ্ঞানিক উপায়

জাকির জাফরান
| আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২০, ১৫:৪২ | প্রকাশিত : ০৯ এপ্রিল ২০২০, ১৪:২৯

এই মুহূর্তে আমরা করোনাভাইরাস নিয়ে একটা আতঙ্কে আছি । এই স্ট্রেস সবার ওপরই কম বেশি কাজ করছে। এখন এই মানসিক চাপ যদি আমরা না কমাই তাহলে এটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

আমরা যখন কোনকিছু নিয়ে টেনশনে থাকি, তখন আমাদের স্নায়ুগুলো উত্তেজিত থাকে। তাই টেনশন/আতঙ্ক/চাপ মিনিমাইজ করতে হলে স্নায়ুকে শিথিল করতে হবে।

নার্ভকে রিলাক্স করার অনেক পদ্ধতি আছে। তার মধ্যে মেডিটেশন সবচে বেশি কার্যকরী। আমরা হয়ত পুরোপুরি মেডিটেশন করতে পারব না। তবে কিছু বেসিক জিনিস জেনে নিলে এগুলো খুব কাজে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

শিথিলায়ন পদ্ধতি

এটা স্নায়ু বা নার্ভাস সিস্টেমকে শীতল করার একটা উত্তম পদ্ধতি। একটা ঘরে কিছুক্ষণের জন্য একা হয়ে যান। শুয়ে বা চেয়ারে বসে করতে পারেন। চেয়ারে বসে করলে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। আর শুয়ে করলে হাত পা সোজাসুজি ছেড়ে দিয়ে রিলাক্সড হয়ে শুয়ে পড়ুন। এবার গভীরভাবে লম্বা করে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। শ্বাস নেয়ার সময় পেটটা ধীরে ধীরে ফুলে উঠবে। আর শ্বাস ছাড়ার সময় পেট ধীরে ধীরে নিচে নামবে। এভাবে ১০ বার করুন।

এ পর্যায়ে আপনার স্নায়ু অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে। এখন নিজের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের দিকে মনোযোগ দিন। পায়ের আঙুল থেকে শুরু করুন। কতদিন আপনি আপনার পায়ের দিকে ভাল করে তাকাননি সেটা খেয়াল করুন। গভীর মমতা নিয়ে নিজের মুখের দিকে তাকান। আপনি ভাবুন যে আপনার পায়ের পাতা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে হতে বরফ হয়ে যাচ্ছে। শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বরফ হয়ে যাচ্ছে। কল্পনা করুন পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরটাই বরফে পরিণত হয়ে গেছে। ভাবতে থাকুন আপনি একটা বরফখণ্ড। আপনার শরীর একদম শীতল। আপনার স্নায়ুগুলো একেবারে ঠাণ্ডা। এখন মনে করুন এই বরফখণ্ড গলে গলে পানি হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আপনার শরীর নামক বরফখণ্ড গলে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে।

মাত্র ১০ মিনিট এটা প্র্যাক্টিস করুন। সম্ভব হলে মোবাইলে হালকা একটা মিউজিক চালিয়ে দিন। সকালে আর রাতে অথবা যে কোনো সময়ে ২ বার। এই শিথিলায়ন পদ্ধতিটা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মেডিটেশনের সিডিতে আছে। আপনার কাছে থাকলে সেটা ফলো করুন।

এই পর্বে আমরা অটোসাজেশন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। মনোবিজ্ঞান জগতে মন নিয়ন্ত্রণের এক শক্তিশালী পদ্ধতির নাম অটোসাজেশন, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে অনেক আগেই।

ফরাসী বিজ্ঞানী এমিলি কোয়ে ১৯২০ সালে তার Self Mastery বইয়ে এই ধারণার অবতারণা করেন। যারা মানসিক চাপ বা বিষন্নতায় আছেন, তাদের জন্য তিনি এ বইয়ে একটি মন্ত্রের উল্লেখ করেন। সেটি হলো-

"Every day, in every way, I'm getting better and better."

"প্রতিদিন, প্রতিটি উপায়ে, আমি ভালো থেকে আরো ভালো হয়ে উঠছি।"

অটোসাজেশন আসলে কী?

অটোসাজেশন মানে নিজের মনকে নিজে কমান্ড করা, নির্দেশ দেয়া, নিজের আচরণকে গাইড করা। অবচেতন মন কিন্তু একেবারে অন্ধ। তাকে যে মেসেজ দেয়া হয় সে তাই বিশ্বাস করে, এবং সেই অনুযায়ী দেহ-মনকে নির্দেশনা দেয়। আমরা যখন কোনকিছু নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হই, কিংবা যখন ইমোশনাল ব্রেকডাউন হয়, অথবা যখন একই খারাপ খবর বারবার আমরা শুনি বা দেখি (এখন যেমন করোনা পরিস্থিতি), তখন অবচেতন মন এই খারাপ মেসেজগুলো রিসিভ করে। তারপর সে ভাবে যে এটা সত্যি সত্যি আতঙ্কের বিষয়, এবং সেই অনুযায়ী নার্ভাস সিস্টেমকে খবরটা পাঠিয়ে দেয়। তারপর মন ও দেহ এই অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করে। অটোসাজেশনের টেকনিকটা হলো অবচেতন মনের এই নেগেটিভ মেসেজগুলোকে পজিটিভ মেসেজ দিয়ে রিপ্লেস করা। এবং বারবার, প্রতিদিন নিয়ম করে পজিটিভ কথাগুলো উচ্চারণ করা।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন আপনি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আতঙ্কগ্রস্ত। আপনি অস্থিরতায় ভুগছেন, ঘুমে সমস্যা হচ্ছে, ঘন ঘন মন খারাপ হচ্ছে কোন কারণ ছাড়াই। এটা কেন হচ্ছে? এটা এ কারণে হচ্ছে যে, আপনি ফেসবুক খুললেই করোনার খবর পড়ছেন, টিভি অন করলেও একই বিষয় দেখছেন। আর প্রতিদিন এটা দেখতে দেখতে এবং শুনতে শুনতে আপনার অবচেতন মন এটা বিশ্বাস করেছে যে পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। তাই সে আতঙ্কের বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছে দেহমনে। সেই অনুযায়ী আপনি বারবার আতঙ্কিত হচ্ছেন। এখন কী করতে হবে? অবচেতন মনকে পজিটিভ মেসেজ দিতে হবে। যেমন আপনি বলতে পারেন, "আমি খুব ভাল আছি, আমার মন প্রশান্ত আছে। প্রতিদিন আমি প্রশান্ত হচ্ছি।"

অটোসাজেশন কীভাবে প্র্যাকটিস করবেন

নিয়ম করে প্রতিদিন ২ বার করুন। ঘুমুতে যাওয়ার আগে আর সকালে ঘুম থেকে উঠে। রাতে শুয়ে চোখ আলতো করে বন্ধ করুন। তারপর ১০ বার নাক দিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়ুন। এটা করার পরে আপনার স্নায়ু শীতল হয়ে যাবে। তারপর আপনি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী অটোসাজেশন দিন। আপনি যদি কোনকিছু নিয়ে ভয়ে থাকেন, তাইলে আপনি এভাবে অটোসাজেশন দিন--"আমি খুব সাহসী। আমি প্রতিদিন সাহসী হয়ে উঠছি।" আসল কথা হলো, আপনি যে বিষয়টা নিয়ে মানসিক চাপে আছেন, তার পজিটিভ কথাগুলো আপনি নিজেকে কমান্ড করুন। এভাবে রাতে ২০ বার এবং সকালে ২০ বার অটোসাজেশন প্রয়োগ করুন। নিয়মিত প্র্যাচক্টিস করলে ২ সপ্তাহেই পরিবর্তন বুঝতে পারবেন।

বি. দ্র. অটোসাজেশন এ কখনোই নেগেটিভ কথা/শব্দ বলা যাবে না। যেমন-- আপনি যদি কিছু ভয় পান, তাহলে এটা বলা যাবে না "আমি অমুক জিনিস ভয় পাব না"। বরং এটাকে পজিটিভ করে বলতে হবে " আমি খুব সাহসী। আমি প্রতিদিন সাহসী হয়ে উঠছি"। যারা আগের পর্বের শিথিলায়ন প্র্যা্ক্টিস করবেন, তারা শিথিলায়ন শেষ করে অটোসাজেশন প্রয়োগ করবেন।

লেখক: কবি ও সি‌নিয়র সহকা‌রি স‌চিব, প‌রিকল্পনা বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :