নৈতিকতা ভুলে আমরা কি চূড়ান্ত অসংবেদনশীল হয়ে যাচ্ছি?

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫৮

আরিফুর রহমান দোলন

বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ২৪ এ করোনা ভাইরাস নিয়ে হেলথ টিপস বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম। টেলিফোনে মুজতবা খান নামে সাবেক একজন জনপ্রতিনিধি দর্শক নিজের পরিচয় দিয়ে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিলেন। বললেন, হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে তার বন্ধু রাজধানী ঢাকার চারটি হাসপাতাল ঘুরেছেন। কোথাও ভর্তি করেনি। চিকিৎসা না পেয়ে অতঃপর ওই হৃদরোগী মারা গেছেন। কোভিড-১৯ আতঙ্কে এইভাবে অন্যান্য রোগাক্রান্তদের সামাজিক হেনস্থা ও বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি কি কেবলই কাকতালীয়? না-কি এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।

প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় হুটহাট সাধারণ মানুষের হেনস্তার নানাসব খবর দেখছি। পত্রিকার পাতা এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতেও সন্দেহের বশে অনেক নিরীহ মানুষের হেনস্তা হওয়া, সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার খবরগুলো পড়ে মন ভারী হয়ে উঠছে।

‘করোনা সন্দেহে চিকিৎসা দেয়নি হাসপাতাল’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যু, কয়েকদিন আগে দেশের সকল পত্র-পত্রিকায় এক যোগে এই শিরোনামের খবরটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সুমন চাকমা নামে ওই শিক্ষার্থী ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিল, তার বিদেশেও চিকিৎসা হয়েছিল। অসুস্থবোধ করার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, গণস্বাস্থ্যনগর হাসপাতাল ও জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু চারটি হাসপাতালই তাঁকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী বলে সন্দেহ করে। এরপর তাকে ঢাকা থেকে তার খাগড়াছড়ি গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সম্পূর্ণ অবহেলা, বিনা চিকিৎসায় দেশের অন্যতম সেরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর এইভাবে মৃত্যু হাওয়া কি শুধুই দুর্ভাগ্যজনক! না-কি এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেয় আমরা আসলে কতটা অমানবিক হয়ে গেছি। দায়িত্ব, কর্তব্যনিষ্ঠা ফেলে কতটা দায়সাড়া গোছের আমরা তাঁর ও প্রমাণ সুমন চাকমার মৃত্যু। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরেও বিষয়টি এসেছে। মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সঙ্গেই তুলে ধরেছেন। দেশের চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীর প্রশংসা, দায়িত্বপালনের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধাদি দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত উদার মনোভাব পোষণ করেছেন। পাশাপাশি বলেছেন, এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীটি কোনো চিকিৎসা ছাড়াই মারা গেলো, এটি কি মেনে নেওয়া যায়? যাদের অবহেলায় এটি হলো তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এই মনে করাটা আসলে এক ধরনের অনুশাসনই। জানিনা আদৌ কর্তব্য অবহেলা, চূড়ান্ত অমানবিক আচরণকারীরা আদৌ শাস্তির আওতায় আসবে কি-না!

দিন দশেক আগে দেশের শার্ষী স্থানীয় একটি খবরের কাগজে একটি শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গেলো। ‘করোনা সন্দেহে ঢাকা থেকে ফেরা স্বামীকে বের করে দিলেন স্ত্রী।’ খবরে যা লেখা হয়েছে, ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরলেন স্বামী। তার জ¦র, সর্দি ও কাশি দেখা দেয়। এতেই বাধে বিপত্তি। করোনা আক্রান্ত সন্দেহে স্বামীকে আর বাড়িতে উঠতে দেননি স্ত্রী। কাবিল প্রামাণিক নামে ওই ব্যক্তি আসলে মৌসুমী জ¦রে আক্রান্ত ছিলেন এবং পরে সুস্থও হয়ে ওঠেন। কিন্তু স্ত্রী জেসমিন আক্তারের সন্দেহের কারণে প্রতিবেশী এবং পরে গ্রামবাসী ও স্থানীয় প্রশাসন কাবিলকে রীতিমতো নির্জনে থাকতে বাধ্য করে। ঘটনাটি বগুড়ার আদমদীঘির। নির্মাণ শ্রমিক কাবিলের স্ত্রী হয়তো অতি সতর্কতামূলক আচরণ করেছেন। কিন্তু এরপর গ্রামবাসী ও প্রশাসনও যা করেছে তাও কি যুক্তিযুক্ত?

নড়াইলের নড়াগাতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রোকসানা খাতুন অভিযোগ করেছেন, যশোর সদর হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তাঁর স্বামী আহসানুল ইসলাম। বুকে ব্যথা অনুভব করলে ৯ এপ্রিল তাকে যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি। একইভাবে নওগার রানিনগরে এক জ¦রাক্রান্ত যুবক চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন, অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকায় কাপড়ের দোকানে কাজ করা ওই যুবক জ¦র, কাঁশি নিয়ে ঢাকা থেকে নওগাঁয় আসেন। এ সময় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে গ্রামবাসী ও ইউপি সদস্য তাকে গ্রামে ঢুকতে দেননি। এরপর চিকিৎসার জন্য তাকে পাশ^বর্তী আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানেও চিকিৎসকরা তাকে ফিরিয়ে দেন। এরপর অসুস্থ ওই ব্যক্তিকে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের বারান্দায় রাখা হয়। এইভাবে ঘুরে ঘুরে নওগা সদর হাসপাতাল হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

বিদেশ থেকে স্বামী দেশে ফিরেছেন শুনে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছেন, এমন একাধিক খবর পত্রিকার পাতায় দেখেছি। কোথাও কোথাও বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের নাম ধরে মাইকে প্রচার, তাদেরকে বয়কটের কথা কিংবা সামাজিক গণমাধ্যমেও ধোলাই, যা- কি না গণপিটুনির চেয়ে কোনো অংশে কম না। বিদেশ ফেরত কেউ যদি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয় তাহলে এই আমরা যা করছি তাও কি খুব যুক্তিযুক্ত? এমনও শুনছি ভাড়াটিয়া স্বাস্থ্যকর্মী হলে কোথাও কোথাও বাড়িওয়ালার বিরূপ আচরণের মুখোমুখি হচ্ছেন। এসব তো মোটেই কাম্য নয়।

কেউ কেউ কেন এমন মনে  করছেন যে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী করোনা রোগী দেখছেন মানেই করোনা ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছেন! এভাবে অবিশ্বাস, সন্দেহ আর আস্থাহীনতায় মানবিক আচরণগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। এগুলো খুব খারাপ লক্ষণ।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্তকে কেন অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে? কোণঠাসা করা হচ্ছে আক্রান্তের পরিবারকে? যার জেরে পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত হচ্ছেন অন্যরা। এক্ষেত্রে তাই সংক্রমণের থেকেও যেন সামাজিক হয়রানির আশঙ্কাই বেশি। গোপনীয়তার সব নৈতিকতা জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। আক্রান্তকে একবারও না দেখে, উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে নানা অবিচার হচ্ছে তার প্রতি, পরিবারের প্রতি। আমরা কি তাহলে নৈতিকতা ভুলে চূড়ান্ত অমানবিক হয়ে যাচ্ছি?

সংকটে, বিপর্যয়ে, দুঃসময়েই আসল পরীক্ষা হয় মানবিকবোধ আর মনুষ্যর্ত্বে আমাদের মানবিকসত্তা কত সুদৃঢ় তা বুঝে নেওয়ার সময় এটাই। এই দুঃসময়ে অনেকেরই সভ্য-ভদ্র মুখোশ নিজের অজান্তেই খসে বেরিয়ে আসে ভেতরের সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের এই মহামারির সময়ে থেকে থেকে আমরা এমন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি, যেখানে মনুষ্যত্বের অবমাননা প্রকট হয়ে উঠছে।

স্বার্থপরতা আমাদের মধ্যে বরাবরই আছে। থাকবেও। কিন্তু পরার্থপরতাও আছে সেই সঙ্গে এবং সেটি যত বৃদ্ধি পাবে ততই মনুষ্যত্ব জয়ী হবে। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যেই তো প্রকৃত মনুষ্যত্ব। করোনা ভাইরাসের কারণে লম্বা ছুটি এবং হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের মুখে দু মুঠো অন্ন জোগাতে সমাজের অনেক বিত্তবান এগিয়ে আসছেন। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি অসহায়, দরিদ্রদের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু এই অতি দুঃসময়েও সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎ, চাল চুরির খবরও আসছে। কোথাও দু’চারজন জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারীর জড়িত হওয়ার খবরও আসছে।

এরা কি মানুষ? না-কি নরপিশাচ? মনুষ্যত্বহীন মানুষ নামধারী এই অমানুষদের কঠিনতম বিচার কাম্য।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।