লকডাউনে নববর্ষ

অয়েজুল হক
| আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২০, ২৩:২০ | প্রকাশিত : ১৩ এপ্রিল ২০২০, ২৩:১৯

নিলা ছাদের ওপর চড়া গলায় গাইছে, আহা আজি এ সুখের দিনে। নির্জনে আনমনে তোমার কথা পড়ছে মনে। বাদল সাহেব তৃতীয় তলায় জানালা খুলে বাতাসের অপেক্ষায় হা করে দাঁড়িয়েছিলেন। বাতাস নেই। হঠাৎ বেশ গরম পড়েছে। নিলার উচ্চ শব্দের মার্গের গান তার কানে পৌঁছাতে ছাদের দিকে ছুটে যান।

এই ছাগলটা নিয়ে তিনি বড় বিপদে আছেন। সমূহ বিপদ সম্পর্কে সে একেবারে উদাসীন। অঘোষিত কোয়ারেন্টাইন চলছে। মূল ফটকে বড় একটা তালা লাগিয়ে দেবার পর থেকে নিলার দাপাদাপি বেড়ে গেছে। সে কিছুতেই কোয়ারেন্টাইন মানবে না। তার হাজার হাজার কাজ।

বাদল সাহেব যে বোঝেন না তা নয়। এলাকার বখাটে নম্বর ওয়ান সাগর ছেলেটা নিলার মাথার ভেতর কিলবিল করছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আটকে পড়ায় দোতলা বাড়িটার ভেতর দাপিয়ে দাপিয়ে পরিবেশ নষ্ট করছে। তার গান গাওয়া রোগটা মাত্রা পেরিয়ে মাত্রার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মাত্রা যদি কোনো পাহাড় হতো বলা যেত নিলার গান গাওয়া রোগ মাত্রা পাহাড়ের চূড়ায়। যেকোনো সময় নিলা তার গানসহ মাত্রা পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে আছড়ে পড়বে।

ছাদে পৌঁছে বাদল সাহেব গর্জন করে বলেন, এই মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে এতো চড়া গলায় গান গাইছ কেন? তোমার কী লজ্জা শরম সব ধুয়ে গেছে?

-ধুয়ে যাবে কেন? লজ্জা তো আর কাপড়ের ময়লা না যে ধুয়ে যাবে।

ড্যাডি আমার জন্য হলুদ শাড়ি কিনেছ?

-দেখ নিলা তুমি ছোট না। মানুষ কীভাবে বাঁচবে সেই চিন্তায় অস্থির আর তুমি...

-আমি কী!

-তুমি একটা পশু।

-কী পশু?

বাদল সাহেব রাগে, দুঃখে অস্থির হলেও প্রকাশ করেন না। নিচের দিকে হেঁটে চলেন। নিলা পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে বলে, এই যে ড্যাডি আমি কী পশু বলে গেলে না?

বাদল সাহেব সাতদিন পর গেট খুলে রাস্তায় নামেন। বাড়ির পাশের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আবুল খায়েরকে ধরবেন। আবুল খায়েরের দোকানের চিত্র পাল্টে গেছে। চার হাত দূরত্ব রেখে বেঞ্চ দিয়ে বেরিগেড দিয়েছেন। রোগী কেউ নেই তারপরও তিনি ঝুপড়ি দিয়ে বসে আছেন।

বাদল সাহেব খানিকটা কড়া গলায় বলেন, 'কী ওষুধ দিয়েছেন?'

-কী ওষুধ দিয়েছি মানে! আমি আজ পর্যন্ত কাউকে কী ওষুধ দিইনি।

হোমিওপ্যাথিতে কী নামের কোনো ওষুধ নেই।

-বোঝেন না? -না।

-আমার মেয়ে ওষুধ খাওয়ার পর শুধু দৌড়াদৌড়ি করছে। একবার ছাদে, একবার নিচে।

-চিন্তা করবেন না,ওষুধে কাজ শুরু করেছে।

-মানে? -আপনি বলেছিলেন আপনার মেয়েটা যেন অস্থির থেকে স্থির হয়।

-হু।

-খুব দ্রুত আপনার মেয়েটা স্থির হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

-কীভাবে?

-ওই যে গান গাইতে গাইতে ছাদ থেকে নিচে পড়ে একেবারে স্থির হয়ে যাবে।

বাদল সাহেবের ইচ্ছা করে মুখের ওপর কষে একটা থাপ্পড় দিতে। দূরত্বের কারণে সেটা হয়ে ওঠে না। তাছাড়া লোকটা সারদিন দোকান খুলে বসে থাকে। বয়স্ক মানুষের ঝুঁকি বেশি। যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তিনিও থাপ্পড় দিতে গিয়ে সংক্রামিত হতে পারেন।

মিশ্রিত রাগ, আতঙ্ক নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। ফিরতি পথে দেখা যায় মানুষের আড্ডা, খোশগল্প। কেউ একজন পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও চমকে উঠছেন। কী এক ভয়াবহ রোগ যে, আজ মানুষ তার সহজাত মানুষকেই ভয় পাচ্ছে। করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লেও সাগর দের কিচ্ছু যায় আসে না এমন একটা ভাব। তারা দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে। সিগারেট খাচ্ছে। আনন্দ ফূর্তির ঘাটতি নেই। মাঝেমধ্যে লুকোচুরি খেলাও চলছে। পুলিশ, আর্মি এলে একটু গা ঢাকা দিয়ে আবার যেই সেই।

সাগরের পকেটে মোবাইল বেজে ওঠে। মোবাইল রিসিভ করে বলে, 'হ্যালো নিলা, কী অবস্থা তোমার?'

নিলার গলায় হতাশার সুর, 'সাগর এবার কী নববর্ষ আসবে?'

-হু।

-লকডাউনে কীভাবে আসবে?

-ভেঙে ফেল তালা, বসাই মিলন মেলা।

-তুমি কোথায়?

-এই তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি....

-তাহলে নববর্ষের আড্ডা হবে?

-অবশ্যই হবে। কিসের আবার লকডাউন....

সাগরের কথা শেষ না হতেই পেছন থেকে চটাচট লাঠিপেটা শুরু হয়। আচমকা পিটানি খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে, ওরে নিলা। ওরে স্যার। বিশ্বাস করেন নববর্ষ আসবে না। লকডাউন! সাটডাউন!!

লেখক: কথাশিল্পী

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :