করোনা এবং জীবনের হিসাব

প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০২০, ১৭:০১

ড. আসিফ আহমেদ
ড. আসিফ আহমেদ

সুকুমার রায়ের ‘জীবনের হিসাব’ কবিতার বিদ্যে বোঝাই বাবু ঝড়ের কবলে পড়ে যখন মৃত্যু ভয়ে ভীত, মাঝি জানতে চেয়েছিল, ‘সাঁতার জানো বাবু?’। উত্তরে নানা রকম জ্ঞান জাহির করে প্রশ্নবাণে মাঝিকে কাবু করে ফেলা বাবু না সূচক মাথা নাড়েন। মূর্খ মাঝি বলে, ‘তোমার দেখি জীবনখানার ষোল আনাই মিছে’। আধুনিতকার গর্বে ফুলে ফেঁপে ওঠা মানবজাতির জ্ঞান বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, রাজনীতি,বিনোদন, বিলাসিতা সব যেন করোনাভাইরাসের একটা প্রশ্নের কাছে মলিন হয়ে গেছে, ‘শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রেখেছো তো? নইলে তোমারও যে ষোল আনাই মিছে’।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় রোগ হবার আগেই তাকে আটকে রাখার প্রক্রিয়াকে বলে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। একজন ব্যক্তি বা পুরো সমাজের মানুষকে রোগব্যাধি হবার আগেই তার থেকে দূরে রাখার জন্য দৈনন্দিন অভ্যাস বা জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত করে তোলাই এর মূল কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে সার্বিক প্রাথমিক চিকিৎসা খাতের ব্যয় স্বল্প আয়ের দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই ব্যয় আবার সরাসরি একটি দেশের জিডিপি বা স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এর সাথে সম্পর্কিত। উচ্চ আয়ের দেশগুলো বিশ্বের মোট স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের প্রায় ৮০% খরচ করে। ২০১৭ সালের WHO-এর হিসাব অনুযায়ী উচ্চ আয়ের দেশগুলোর সরকার স্বাস্থ্য খাতে যেখানে মাথাপিছু প্রায় দুই হাজার ৯৩৭ ইউএস ডলার ব্যয় করে সেখানে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর সরকার ব্যয় করে গড়ে মাত্র ৪১ ডলার। এর ফলে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মানুষকে চিকিৎসা খরচের প্রায় ৪১ শতাংশ পকেট থেকে ব্যয় করতে হয় যা উন্নত দেশগুলোর প্রায় দ্বিগুণ। আপাত দৃষ্টিতে উন্নত দেশগুলোর এই বিশাল ব্যয় এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তাদেরকে নিরাপত্তার একটা অনুভূতি এনে দিলেও করোনা পরিস্থিতি সারা বিশ্বকে একটা পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে আর সেটা হলো একা সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। বিশেষ করে বিশ্বায়নের যুগে এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের অবাধ যাতায়াতের মাঝে মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম করোনাভাইরাসকে ঠেকাতে সারা বিশ্বই এক প্রকার ব্যর্থ হয়েছে।

মৌলিক চাহিদার অন্যতম তিনটি উপাদান খাদ্য, চিকিৎসা এবং শিক্ষা পাওয়ার অধিকার। এর বাইরে মানুষ হিসেবে ভালোবাসা, নিরাপত্তা, ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার অধিকার ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানসম্পন্ন ও পুষ্টিকর খাবার সুস্থ এবং সুন্দর ভাবে জীবন ধারনের জন্য সবচেয়ে জরুরি। কারণ এই পুষ্টিকর খাবার এবং নিয়ম শৃঙ্খলার জীবন রোগব্যাধি থেকে মানুষকে দূরে রাখে। পাশাপাশি এটা স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ কমিয়ে আনে। রোগব্যাধি সম্পর্কে সাধারণ সচেতনতা এবং সেই অনুযায়ী ব্যক্তিগত আচার আচরনের অভ্যাস পরিবর্তন আনতে পারলে বৃহৎ পরিসরে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা সম্ভব হয়। বিশেষজ্ঞ মহলের মাঠ পর্যায়ে এবং গবেষণাগার থেকে পাওয়া তথ্যকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে পরিবেশন করায় শিক্ষা ও গবেষণার ভূমিকা অপরিসীম। এখানে সঠিক সমন্বয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন, রাতারাতি এর সুফল মেলেনা।

উন্নত বিশ্বগুলো স্বাস্থ্যখাতে এত বিশাল ব্যয় করলেও তারা আসলে মানুষের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার সঠিক কাজগুলো করছে কি? সিগারেটের প্যাকেটে, স্বাস্থ্যবিধিতে ধুমপান ও মদ্যপান ক্ষতিকর লেখা থাকলেও বিশ্বের ধনি গরিব নির্বিশেষে বিশাল অংকের বিনিয়োগ হচ্ছে এই চরম স্বাস্থ্যহানীকর পণ্যগুলো তৈরি ও বিপণনে। বিশেষ করে আর্থিক স্বচ্ছলতার সাথে এগুলোর ব্যবহারের মাত্রাও বাড়তে থাকে। আর অনুন্নত দেশগুলোতে কমদামে মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই এসব পণ্য মানুষ গ্রহণ করছে। এছাড়া রয়েছে হরেক রকমের নেশাদ্রব্য যা বৈধ অথবা অবৈধ ভাবে ঠিকই মানুষের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এর পর আসে প্রসেসড ফুড বা জাঙ্ক ফুড। স্বাস্থ্যসম্মত, প্রাকৃতিক খাবারের উল্টোপিঠে এর জনপ্রিয়তা যেন তুঙ্গে। এই অত্যন্ত ক্ষতিকর খাবারগুলো আমাদের শহুরে জীবনের অলস শরীরের সাথে যুক্ত হয়ে স্থূলতা, হার্টের সমস্যা, ডায়বেটিস, স্ট্রোক সহ নানা রোগের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা, গবেষণা কিংবা কর্মক্ষেত্রের ইঁদুর দৌড়ের আরেক প্রাপ্তি স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা আর ভোগ বিলাসের সীমাহীন স্বপ্নপূরণে মানুষ নিত্য সঙ্গী করেছে এই মানসিক চাপকে। আর কে না জানে, এই মানসিক চাপ সমস্ত বড় বড় শারীরিক অসুখের মূল উৎস। তাহলে এই বিশাল বিনিয়োগ করে স্বাস্থ্যহানীকর জীবনযাপন করলে মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা কিভাবে গড়ে উঠবে?

স্বাস্থ্য খাতের আরেকটি প্রহসনমূলক দিক একের পর এক ঔষধ আবিষ্কার। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকার কৌশল না নিয়ে আমরা সব রকম চাপের মধ্য দিয়ে দিন কাটাবো আর দিন শেষে একটা দুটো ট্যাবলেট খেয়ে সেই চাপ দূর করে ফেলবো। অথচ দৈনন্দিন খাবার আর ভেষজেই লুকিয়ে আছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার সমস্ত উপাদান। ঔষধ নির্ভর এই মিথ্যে জগতের অনুভুতি আমাদের ভিতর জাগিয়ে তুলে গবেষণা আর ঔষধ বাণিজ্যের একটা বড় খাত তৈরি করে ফেলেছে উন্নত দেশগুলো। একইভাবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনে আমাদের সবাইকে অভ্যস্ত করে তুলে যখন চারিদিক থেকে আমরা সংকটে তখন বড় বড় আবিষ্কার আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসবে এই আশ্বাসে আমরা অনেকটাই স্বস্তিতে আছি। ইনসুলিনের মতো আবিষ্কারকে আমরা যতোটা গর্বের সাথে দেখি, ঠিক ততোটাই যেন আমাদের অনীহা নিজের শরীরকে ঔষধ ব্যতিরেকে সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে।

করোনা পৃথিবীতে সাম্যের অনন্য উদাহরণ রেখে যাচ্ছে। ধনী, গরীব, সাদা, কালো সবাইকে ঘরে ঢুকিয়েছে, ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় বাধ্য করছে, ইঁদুর দৌড়ের জীবন থেকে একরকম স্বেচ্ছা অবসরে পাঠিয়েছে, রেখেছে পরিবারের সাথে। এ যেন পুরো পৃথিবীকে একটা ফোর্স রিস্টার্ট বোতাম চেপে দেয়ার মতো। দেশ থেকে দেশে জাতীয়তাবাদের হাত ধরে রাজনীতি থেকে খেলা কোথায় ছিলোনা যুদ্ধ। করোনা সবাইকে এক বিশ্বের এক নাগরিক হতে বাধ্য করেছে কয়েক মাসের ব্যবধানে। করোনাভাইরাসের স্বভাবজাত কাজইতো পোষক দেহের কোষে প্রবেশ করে নিজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। আমরা তাকে ভাইরাসের সংক্রমণ বলছি। অথচ ক্ষমতা আর বাড়াবাড়ির হাজারো নমুনা দেখিয়ে দেশে দেশে মানুষের নাগরিক অধিকারহরণ করে নিয়ে আমরা মানুষরা কম ভাইরাস হয়ে উঠিনি। ব্যক্তি হিসাবে সেই ক্ষমতার স্বাদ নিতে আমরাও দলে দলে মানুষরূপী ভাইরাসের কাতারে নাম লিখিয়েছি।

করোনা হয়তো একটা সময় স্তিমিত হবে। মৃত্যু আর অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি আমাদের মনোজগতে অনেক বড় চিন্তার খোরাক রেখে যাবে। করোনাই শেষ নয়, মানবজাতিকে হয়তো সামনে আরো অনেক ভাইরাস মোকাবেলা করতে হবে। জীবন মানেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করা, তাই এমন নয় যে করোনা না থাকলে মানুষ অমরত্ব পাবে। প্রশ্ন হলো করোনা পরবর্তীকালের বিশ্বে আমরা কোন ধারাকে বেছে নেবো। আগের মত মন ও শরীরের জন্য ভালো নয় এমন জীবনাদর্শ অনুযায়ী জ্ঞান, বিজ্ঞান, রাজনীতি পরিচালিত করতে থাকবো? নাকি একদম নতুনভাবে প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, সাম্য, সুস্থতা মোড়া একটি জীবন উপহার দেবার জন্য আমাদের সব মেধা নিয়োজিত করবো? সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার সব উপকরণ কিন্তু আমাদের নিজেদের হাতে। কবিগুরুর "জুতা আবিস্কার"কবিতার হবু চন্দ্রের ধুলা থেকে বাঁচবার দুনিয়াব্যাপী চেষ্টার শেষ সমাধান গবু এনে দিয়েছিলো কেবল নিজচরণ দুখানা চামড়া দিয়ে মোড়ার মধ্য দিয়ে। তেমনি আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিই, ব্যক্তিগত জীবন যাপনে সংযত হই, লোভ লালসা, পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায্যভাবে কিছু পাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত না হই, আপনা-আপনি এই বিশ্ব ভালোবাসা ভরা একটা বাসযোগ্য বিশ্বে পরিণত হবে। মৃত্যু আসবেই, কিভাবে জীবনযাপন করে মৃত্যুকে আমরা বরণ করবো সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। করোনাভাইরাস হয়তো আমাদেরকে ভাববার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সেই সূবর্ণ সুযোগটা করে দিয়েছে।   

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: [email protected]