তিন বছর নামে আসছে চাল, জানেন না ভাতাভোগী

প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০২০, ১৯:২৩

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

আব্দুর রাজ্জাক। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার গোস্বামী দুর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর মাগুরা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গত তিন বছর ধরে তার নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ওএমএসের বরাদ্দকৃত চাল উঠছে। অথচ তিনিই জানেন না তার নামে কার্ড আছে।

হঠাৎ গত বুধবার খবর পেয়ে ডিলারের ঘরে হাজির হন। দেখেন সাড়ে তিন বছরে ধরে তার নামে চাল উঠে আসছে। তিনি পান না। পরে তাকে ৩০ কেজি চাল দেয়া হয়। আর বলা হয় এ কথা কাউকে না জানাতে, এখন তিনি নিয়মিত চাল পাবেন বলে জানানো হয়।

শুধু আব্দুর রাজ্জাকই নন, এলাকার অনেকেরই অভিযোগ- গত তিন বছরে ধরে অনেক গরীব ও অসহায় মানুষের নামে এভাবে ১০ টাকা কেজি দরের চাল উত্তোলন করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কিছুই জানেন না। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দবির উদ্দিন বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গত তিন বছর যাবত গরীবের চাল বিক্রি করে খাচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ তুলেছেন।

আগামী নির্বাচনে চাল চোরেরা মনোনয়ন পাবেন না হুঁশিয়ারি দেয়ার পর এখন অনেকের বাড়িতেই গোপনে চাল দিয়ে আসছে এই সিন্ডিকেট। বিষয়টি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গত তিন বছরে এ ইউনিয়নের গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত ৬০০ টন চালের বড় অংশ ঢুকেছে চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতারা পেটে।

ইউনিয়নে চাল বিতরণের সময় যে সরকারি প্রতিনিধি থাকেন তিনিও বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সুখেন কুমার পাল ট্যাগ অফিসারের দায়িত্বে আছেন।

সুখেন কুমার পাল বলেন, ‘আমি সময়ের অভাবে সব সময় যেতে পারি না। অনেক সময় উপস্থিত থাকলেও একজনের কার্ড নিয়ে অন্যজন চাল নিয়ে যায় এমন ঘটনাও ঘটেছে। এটা চেয়ারম্যান ও ডিলাররা করে, সেটা তো আমি জানি না।

প্রতারণার শিকার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দবির উদ্দিন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকে একটি কার্ড করে দেয়। শুরুতে একবার মাত্র চাল পেয়েছিলাম। তাও টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে তিন বছরে তালিকায় নাম থাকার পরও কোনো চাল আমার কপালে জোটেনি। গত বুধবার চাল বিতরণের সময় আমি উপস্থিত হয়ে তালিকা দেখতে চাইলে সরকারি কর্মকর্তা সুখেন কুমার বলেন, আপনার নাম তালিকায় আছে। এরপর আমাকে ৩০ কেজি চাল দেয়া হয়। আমি আমার দুই প্রতিবেশির ঘরে খাবার না থাকায় তাদের ১০ কেজি চাল দিয়েছি।

রাজ্জাক বলেন, আমার মতো কয়েকশ’ লোকের নামে কার্ড আছে, অথচ চাল তারা পান না। অনেকেই এক-দুইবার চাল পাওয়ার পর তাদের কপালে আর চাল জোটেনি।

ওই ইউনিয়নের কুঠিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের রাশিদুল ইসলাম, জোয়াদ আলী, সিদ্দিক আলীসহ কমপক্ষে ৩০ জনের অভিযোগ, তারা গত তিন বছরে কোনো চাল পাননি। অথচ তাদের নাম তালিকায় আছে।  জেলা খাদ্য অফিস থেকে পাওয়া তালিকা ঘেটে এমন সত্যতা মিলেছে। উত্তর মাগুরা গ্রামের ভ্যানচালক আইয়ুব আলীও চাল পান না।

খাদ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গোস্বামী দুর্গাপুর ইউনিয়নে প্রতি বছর দুটি ধাপে ৮০০ কার্ডধারীর অধীনে ফেয়ার প্রাইসের চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিকেজি চালের দর ১০ টাকা। প্রতি বছর দুটি সময়ে দেয়া হয়। প্রথম ধাপে মার্চ ও এপ্রিল এবং দ্বিতীয় ধাপে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দেয়া হয়। দুইজন ডিলার এ ইউনিয়নে রয়েছেন। একজন মিন্টু হোসেন গোস্বামী দুর্গাপুর বাজারে। অন্যজন আলীউল আজিম শংকরদিয়া বাজারে। এর মধ্যে মিন্টু হোসেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজ উদ্দিনের ভাই। অন্যজন চেয়ারম্যানের আত্মীয়।

দেখা গেছে, দবির উদ্দিন বিশ্বাস ২০১৬ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন করে অনেকের কার্ড করা হয়। তালিকায় ৮০০ জনের নাম রয়েছে। এদের বেশির ভাগ কার্ড হওয়ার পর প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি চাল পেলেও তিন বছরে তাদের কপালে আর কোনো চাল জোটেনি। ৬০০ টনের বেশি চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এ পর্যন্ত। যার বেশির ভাগই নয়-ছয় হয়ে গেছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ  সম্পাদক দবির উদ্দিন বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজ উদ্দিন, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক সেলিনুর রহমানসহ আরও কয়েকজন ডিলারদের সঙ্গে  মিলে সাধারণ মানুষের চাল ‘নয়-ছয়’ করছে। এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি দেয়ার পর যাদের কার্ডে চাল উঠছে এসব চাল বাইরে বিক্রি করে যে অর্থ আয় হয় তা ভাগাভাগি হয়ে যায়।

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘অনেক কার্ড ডিলারের কাছে থাকে হিসাবের জন্য। চাল নেয়ার সময় যার কার্ড তারা নিয়ে যান’। চাল না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো কথা আমি বলতে পারব না।’

ডিলার মিন্টু হোসেন বলেন, ‘কেউ চাল পাচ্ছে না এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই’। কয়েকজনের নাম বললে তিনি তার কোনো জবাব দিতে পারেননি।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দবির উদ্দিন বলেন, ‘ভাই কিছু অনিয়ম থাকতে পারে। তালিকা ঘাটলে আমিও পাব, আপনিও পাবেন। আপনি এবারের মতো সুযোগ দেন যাতে আগামীতে আর ভুল ক্রটি না হয়।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘চাল নিয়ে অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। তালিকায় যাদের নাম আছে তারা কেন চাল পাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

(ঢাকাটাইমস/১৭এপ্রিল/কেএম)