কোয়ারেন্টাইনে চিকিৎসক মা, আদর পেতে ব্যাকুল শিশুটি
বাবা-মা কিংবা স্বজন তাদের শিশুকে আদর করা ছাড়া থাকতে পারেন না, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই করোনাকালে এখন আপনার ভেতরের স্নেহশীলা নদীতে পাষাণ বাঁধ দিতে হবে। নইলে করোনাভাইরাস আদরের পরশ নিয়ে ঢুকে যাবে আপনার কিংবা শিশুর শরীরে। সামাজিক দূরত্ব শিশুর ক্ষেত্রে বজায় রাখা খুবই জরুরি।
বিষয়টি সাধারণ মানুষ কম বুঝলেও চিকিৎসকরা সবচেয়ে ভালো জানেন। তাইতো ময়মনসিংহের এক নারী চিকিৎসক নিজের বুকে পাথর বেঁধে আছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে। কিন্তু তার শিশুটি কোনোভাবেই মানতে পারছে না যে মা বাড়িতে থাকার পরেও কেন তার কাছে আসছে না। কেন দরজা বন্ধ করে রেখেছে। তাই সে মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে বারবার। তাতেও দরজা না খোলায় লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে অবুঝ শিশুটি। এমন কয়েকটি ছবিসহ ফেসবুকে মর্মস্পর্শী পোস্ট দিয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটার্ন চিকিৎসক সুমন হুসাইন। সোমবার রাত ১০টার দিকে তিনি এই পোস্ট দেন।
ডা. সুমন হুসাইনের ফেসবুক পোস্ট হুবহু তুলে ধরা হলো:
মা অন্য ঘরে, ছেলে বায়না ধরেছে মায়ের কাছে যাবে । মেয়ে বায়না ধরেছে মায়ের সাথে রাতে শুবে । ওদের ডাক্তার মাকে খুব কমই পায় বাচ্চা দুটো । তবে, মা বাড়িতে আছে, অথচ মা ওদের সাথে থাকেনি - এমনটা হয়নি কখনো । দরজা ধাক্কায় ওরা, মাকে ডাকে ।
ওদের ডাক্তার বাবা ওদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করে, ভেতর থেকে মা ও । ওরা বুঝে না । ছেলেটা দরজা ধাক্কা দ্যায়, লাথি দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করে ।
ভেতর মা কাঁদে, যে মা একজন ডাক্তার । কোভিড-১৯ পজিটিভ প্যাশেন্টের ট্রিটমেন্ট দিতে গিয়ে যিনি গতকাল রাত থেকেই কোয়ারান্টাইনে, সবার থেকে আলাদা থাকছেন ।
চিত্রটা কল্পনা করুন । বেশ কষ্ট দিচ্ছে না গল্প টা? দারুণ না গল্প টা?
এটা গল্প নয়, একটুও গল্প নাই এখানে । আমার অনেক কাছের এক ডাক্তার আপুর গল্প । গল্পটা সব ডাক্তার মা-বাবার গল্প । ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী বিভাগের একটা ইউনিটের একটা প্যাশেন্টের কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়েছে । প্রায় সব ডাক্তার,নার্সরাই তার কনটাক্টে এসেছে ডায়াগনোসড হওয়ার আগে । সো পরের গল্প বুঝতেই পারছেন?
সবার ডাক্তারের পিসিআর টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে। না হউক এমন। মিটফোর্ড আর বরিশাল মেডিকেলের পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়তো "করোনাপুরী" হিসেবে যোগ হতে যাচ্ছে এ লিস্টে ।
সৃষ্টিকর্তা,
এই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোর সাথে এই যে মায়ের লুকোচুরি-সহ্য করতে পারেন?
গাইনীতে প্রায় সব ডাক্তার আপুর ই এক দুইটা ছোট্ট বাচ্চা আছে । ডিউটির সময় যখন এগুলো নিয়ে কথা হয় - সবাইকেই একটা কথা বলতে শুনেছি, আমি মারা যাই কোনো সমস্যা নাই, আমার বাচ্চাটার কি হবে? আমার বাচ্চাদের কি হবে?
সেদিন গাইনীতে কোভিড-১৯ সাসপেক্টেড একটা প্যাশেন্ট Expire করে । সেদিন কয়েকজন আপু বাসায়ই যাননি, তাদের একটা চিন্তা তখন - আমি মরে যাই, সমস্যা নাই, আমার বাচ্চাগুলোকে যদি আমার জন্য ইনফেক্টেড হতে হয়, তাহলে মরে গিয়েও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না, আমি আজ বাসায় যাবো না ।
এসব দেখে শুনে আমার প্রচন্ড মন খারাপ হয় ।
আমি মনে মনে ভাবি, আমার তো ভালোই, আমার এসব কোনো চিন্তা নাই, আমি আক্রান্ত হলে কিংবা মরে গেলে - আমার তো কোনো দুঃখই নাই ।
আমার তো কোনো বাচ্চা কাচ্চা নাই । বউ ও নাই
ঈশ্বরকে মনে মনে বলি - আমারে না হয় নাই দেখলা, এদের কষ্ট দেখে কেমনে সহ্য করো?
(ঢাকাটাইমস/২১এপ্রিল/কেএম)