সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীর বাস্তব প্রতিচ্ছবি মাসরুর আরেফিনের ‘আলথুসার’

এম এম মাহবুব হাসান
 | প্রকাশিত : ২৩ এপ্রিল ২০২০, ১০:৪৩

করোনাক্রান্তিতে হোম কোয়ারেন্টাইনের ফাঁকে ফাঁকে অবশেষে শেষ হলো লেখক মাসরুর আরেফিন-এর দ্বিতীয় উপন্যাস ’আলথুসার’ পড়া। এই উপন্যাসের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ‘মাসরুর আরেফিন’ ও লেখককে চিনলাম ভিন্নভাবে। সেই সাথে জীবনের অন্যরকম একজন আদর্শবান মানুষের সন্ধান মিললো এখান থেকেই। একজন খ্যাতিমান কর্পোরেট ব্যক্তিত্বের চিন্তা-চেতনা ও মননে কমরেড কেন্দ্রিক বাসনাগুলো এতো প্রজ্জ্বল ও গভীরভাবে জাগ্রত হওয়ার স্বপ্ন দেখে! কি আশ্চর্য, ভাবা যায় না।

আজ থেকে সতেরো বছর আগে আমার ক্যারিয়ারের ফরমাল হাতেখড়ি হয়েছিলো খুলনার শীতলাবাড়ীর শীতল মাটি ফুঁড়ে ওঠা এক অদম্য কমরেড আশরাফ-উল-আলম টুটু ভাইয়ের হাতে, যিনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে ভারতের দেরাদুনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্ম-দক্ষতার বিবেচনায় বনে গেলেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষক। খুলনা এলাকার অনেক প্রত্যন্ত জনপদে যাকে মুক্তিফৌজি টুটু ভাই নামেও জানে। মাওসেতুং, চে, লেলিন, কার্লমার্কস এর অসংখ্য শিক্ষামূলক, বিপ্লবী চেতনামূলক, জীবনদর্শনমূলক গল্প, উদ্ধৃতি প্রকাশ পেতো তার নিত্যনৈমিত্তক জীবনাচারণে।

এতো পড়ুয়া লোক আমার জীবনে নয় অনেকই অনেকের জীবনে দেখেনি। শুধু সভা-সেমিনারে কথা বলা, বাথরুম আর ঘুমের মধ্যে ছাড়া কখনো বই থেকে আলাদা হতে কেউ তাকে দেখেনি। এক বই সাতবার পড়ারও রেকর্ড ছিলো তার জীবনে। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন, কাজই ছিলো তার সন্তান। তিনি ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকমানের পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও পিপলস’ সেন্টারড গবেষক। আমরা অনুপ্রাণিত হয়ে তার কাজের ভুয়সী প্রশংসা করে অনেক সময় বলতাম- বস আপনি চাইলেতো একটি বিদেশি এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর হতে পারতেন, তিনি বলতেন আমি “আমি খড়ের বল দিয়ে খেলতে বেশি পছন্দ করি, সবাই আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেললে লোকাল মাঠের দর্শকদের জন্য কে খেলবে”।

দীর্ঘ ছয় বছর টুটু ভাইয়ের খুব টাচে থেকে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। ২০০৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি চুয়ান্ন বছরের মাথায় এই কমরেড হঠাৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। আমার জীবনে যে শোক আজও মুছে যায়নি। মার্কসবাদের শিক্ষাকে ইতিবাচক অর্থে কাজে লাগিয়ে সমাজের কোন একটি শ্রেণীরও খতম বা বিনাশ কামনা না করে বরং তাদেরকে জাগ্রত করে তৃণমূল মানুষের পক্ষে অবস্থাণ করিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারকদের প্রভাবিত করার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিচরণও ছিলো বেশ। এই প্রো-পিপল অ্যাক্টিভিস্ট মানুষটির সান্বিধ্যে যে একবার এসেছে সেই তার প্রেমে পড়ে গেছে, তাই সে দেশি বা বিদেশি যেই হোক। অসম্ভব ব্যক্তিত্ববোধ ও কনভিন্সিং ক্ষমতা ছিলো তার, যার প্রেমে পড়ে আমি তার মৃত্যুর পর প্রায় দুই বছর বিনা বেতনে কাজ করি এবং তার সন্তানতুল্য স্বপ্নের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসী অর্গানাইজশন ‘সিডিপি’ পুন:জ্জীবন পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকি।

মাসরুর আরেফিনের আলথুসার পাঠে আমার পূর্বের অর্গানাইজেশনের প্রধান প্রয়াত কমরেড আশরাফ-উল-আলম টুটু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো, কারণ টুটু ভাই ছিলেন বাই প্রফেশন একজন কমরেড, তারমধ্যে সেই চিন্তা ভাবনাটা থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু মাসরুর আরেফিন বাই প্রফেশন অন্য জগতের উজ্জ্বল তারকা যার মধ্যে কমিউনিজমের এতো গভীর ও শক্তিশালী আবাসভূমি তা সত্যিই অস্বাভাবিক ঘটনা।

প্রসঙ্গক্রমে ব্যাক্তিগত ক্যারিয়ারের আলোকপাত করা হয়ে গেলো। কারণ ‘আলথুসার’ পড়ার পরে আমার মনে হয়েছে যে জীবনের দশটি বছর স্রেফ ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করেছি, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি COP এর গতিবিধি’র সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকেছি (এখনো খোঁজ-খবর রাখি), কোনো কোনোটিতে ফিজিক্যালি বা ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেছি।

পৃথিবী বাঁচানোর তথাকথিত লড়াইয়ের অংশ হিসেবে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত কপ-১৪ এ আমার ও আমার কলিগদের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার বিকল্প সংগ্রামের একটি উদাহরণ হিসেবে ঝুলন্ত সব্জি চাষের একটি রেপ্লিকা প্রদর্শিত হয় যা পরবর্তীতে পোল্যান্ডের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অফিসে স্থান করে নিয়েছে বলে জেনেছি।

ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত কপ-১৫ এ স্বশরীরে অংশগ্রহণের আগে পিপলস ট্রাইবুনাল অন ক্লাইমেট চেন্জ, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পক্ষে এক লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ ও বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৩৫০ পিপিএম এর বেশি বাড়তে না দেওয়ার জন্য সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী ৩৫০.ওআরজি এর ক্যাম্পেইন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কত কি যে করলাম। বাংলাদেশের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জনগণকে যেনো ‘ক্লাইমেট রেফুজি’ না বলা হয় সেজন্যও শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করলাম, আমরা সফলও হলাম বেশকিছুতে। আমাদের এমন অনেকের অনেক কাজ হয় যার সবগুলো কাজ কোপেনহেগেনে গিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু দুনিয়ার সব মানুষ একত্রিত হয়ে বিশ্বমোড়ল অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও তথাকথিত ভোট কামাইয়ের ধান্দাবাজি স্লোগান ‘ইয়েস উই ক্যান’ এর প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘাড় ধরেও কিয়োটো প্রটোকল বা জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে পারলাম না। এই ঘাড় ধরার চেষ্টাটি পৃথিবীর হাজার হাজার পরিবেশবাদীরা করছে পৃথিবীর পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানোর জন্য, তবে এই আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘অনেকে এটা করে খায়’ সংখ্যাটিও নেহাত কম নয় বলে ’এক্সটিংশন রেবেলিওন‘ এর বড় নেতার সাথে লন্ডন পুলিশ চিফের সখ্যতা এতো সুকৌশলে ও বেরসিক সাহসিকতার সাথে উঠে আসার সুযোগ পেয়েছে ‘আলথুসার’ উপন্যাসে।

আলথুসার নিয়ে ইতিমধ্যে অসংখ্য রিভিউ হয়েছে। অনেক রিভিউতে হয়তো লেখকের অব্যক্ত ধ্বনির নিগুঢ় বহিঃপ্রকাশও হয়েছে বটে। প্রতিটি অধ্যায়ে বিভিন্ন পথ-পরিক্রমায় লন্ডনের ‘এক্সটিংশন রেবেলিওন’ এর পৃথিবী বাচানোর সংগ্রাম ভেদ করে সুন্দরী মেগানের উত্তপ্ত শরীর স্পর্শ করে যৌনকাতর ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার তথা আরএসএ মার্ককে পরাস্ত করে নায়কের মনে দোলা দিয়ে কাহিনী গড়ায় প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনান্দ দাশের দেখে যাওয়া প্রবহমান ধানসিড়ি যা এখন মৃতপ্রায় নালা পর্যন্ত, আর অপ্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘রূপসী বাংলা’র পাল্ডুলিপি রেখে গিয়ে কোলকাতায় প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশের ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগের শেষ আকুতি পুরো উপন্যাসে যুক্ত করেছে ভিন্নমাত্রা। তবে পুঁজিবাদের রহস্য উন্মোচনকারী পৃথিবীজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক কার্ল মার্কসের বিভিন্ন দর্শন, মার্কসবাদে বিশ্বাসী স্বীয় স্ত্রীর গলাটিপে হত্যাকারী স্লিপ ওয়াকার দার্শনিক লুই আলথুসারের রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস (আরএসএ) ও আইডোলোজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস (আইএসএ) এবং মিশেল ফুকোর রাষ্ট্র থেকে ঘরের মধ্যে ক্ষমতার ডিসকোর্স যেভাবে উঠে এসেছে তা অনেকের রিভিউতে হয়তো চমৎকারভাবে আলোচিত হয়ে গেছে।

আমি আলথুসার উপন্যাসের এই শক্ত আলোচনার উপযুক্ত বা যোগ্য পাঠক বা আলোচক কেউ না। আমার যা ভাবনা-চিন্তা সব এই বইয়ের লেখককে নিয়ে। কারণ একটি ‘আলথুসার’ সৃষ্টি করতে লেখক হিসেবে মাসরুর আরেফিনকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে, মার্কস এর সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও বস্তুবাদ সম্পর্কে বেশ গভীরে প্রেবেশ করতে হয়েছে নি:সন্দেহে, জানতে হয়েছে আলথুসারের মার্কস, ম্যাকিয়াভেলী, ক্যাপিটাল, আইডিওলোজিসহ অন্তরদৃষ্টি দিয়ে আলথুসারের নিজস্ব সত্ত্বাকেও। মিশেল ফুকোর পাওয়ার বা ক্ষমতাতত্ত্বকে যাকে তিনি বলেছেন পাওয়ার 'ডিসকোর্স' অর্থাৎ ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাওয়ার, ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার, নরমালাইজিং পাওয়ার এবং বায়ো পাওয়ার ইত্যাদি নিয়েও অসম্ভব রকমের ঘাটতে হয়েছে, সেই সাথে ফুকোর 'রিজিম অব ট্রুথ' এবং আন্তোনিও গ্রামশি’র 'হেজিমনি' ধারণার মধ্যে মেলবন্ধনও রপ্ত করতে হয়েছে লেখককে। এই অসম্ভবকে তিনি কিভাবে সম্ভব করলেন উপন্যাসের বাইরে এখন সেটিই ভাববার বিষয় যারা আলথুসারের পাঠকশ্রেণী তারা নিশ্চয় এই বিষয়ে আমার সাথে একমত হবেন।

আলথুসার পাঠে আমার পয়েন্ট অব ভিউ নিপিড়িত মানুষের হয়ে এক সময়কার অ্যাক্টিভ উন্নয়ন কর্মী হিসেবে, অনেকগুলো দেশি-বিদেশি পরিবেশ, প্রকৃতি, ভূমি, কৃষক ও খাদ্য নিরাপত্তা আন্দোলন কমিটির সাথে যুক্তথাকা আন্দোলনকর্মী হিসেবে, বহুপাক্ষিক ফারাক্কা বাঁধকে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে বছরের পর বছর জিইয়ে রাখার ফলে কৃষিনির্ভর ভুক্তভোগী পরিবারের একজন সন্তান হিসেবে তথা জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর বা জায়ান্ট ও শক্তিধর দেশ থেকে পুতুল মার্কা জাতিসংঘের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের একজন পথ-প্রান্তরের নিবেদিত কর্মী হিসেবে যে কি না কাচের দেয়ালে ঘেরা দামি দামি কোট-টাই পরা আর উত্তেজনাকর ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহারকারী কর্পোরেটদেরকে এবং লাল ফিতার দৌরত্ব্যে মোড়ানো গোফওয়ালা মোটা মাথার স্যার লাভার মানুষদেরকে একটু ভিন্ন জগতের বাসিন্দা ভেবে ভেবে ক্যারিয়ারে হাতেখড়ি নিয়েছে, তার সামনে একজন কর্পোরেট লিডার মাসরুর আরেফিন সেই অভেদ্য কাচের দেয়াল ভেঙে ছাতুছাতু করে দিয়ে আলথুসারকে সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীর বাস্তব প্রতিচ্ছবি হিসেবে সত্যিই বিরলভাবে উপস্থাপন করেছেন। যা পাঠক হিসেবে আমাকে রীতিমত বিস্মিত করেছে। মানুষের দৈনন্দিন কর্মজগৎ আর ভাবনার দুনিয়ার মধ্যে যে এতোটা পার্থক্য থাকতে পারে আলথুসারের লেখক মাসরুর আরেফিন তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

লেখক মাসরুর আরেফিন নিজেই এই উপন্যাসের নায়ক। কিন্তু তিনি সুকৌশলে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে আড়াল করেছেন নানান ছুঁতোয়। লেখক আলথুসারের নায়ককে কখনো পৃথিবী বাঁচানোর লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এক্সটিংশন রেবেলিওনের একজন স্পোকপার্সন হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন আবার নায়কের প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশের প্রিয় ধানসিড়ি বাচানোর লড়াই শামিল হওয়ার জন্য লন্ডনের রঙ্গীন চাকচিক্য থেকে বার বার বরিশালের দুর্গম জনপদে ফেরত নিয়ে এসেছেন, এক গভীর মায়াজালে নায়কের স্মৃতিজাগানিয়া জন্মভূমিকে আঁকড়ে ধরেছেন বাধভাঙ্গা জীবনের ব্যতিক্রমী সব অধ্যায় রচনা করার মাধ্যমে।

এসব ঘটনার উপস্থাপনা, ক্ষুদ্রক্ষুদ্র বিষয়গুলোকেও গভীরতম জায়গা থেকে বিস্তরভাবে খতিয়ে দেখার বর্ণনা, প্রাসঙ্গিক বিষয়ের নাড়ে ফিরে যাওয়া; যুতসই, শক্তিশালী ও সাবলীল ভাষার ব্যবহার মাসরুর আরেফিনকে আলথুসারের নায়কের ভূমিকা থেকে আড়াল করতে পারেনি কোনোভাবেই, যার ফলশ্রুতিতে আলথুসার স্বমহিমায় খুব দ্রুততারসহিত পরিপূর্ণতা লাভ করতে পেরেছে।

আমরা অনেকেই যারা কর্পোরেট দুনিয়া থেকে নিজেদের চাল-চলনে টোটালী আলাদা থাকার চেষ্টায় মগ্ন থেকে তৃণমূল মানুষের ভাবনার অন্তরালের ভাবনাকে তুলে আনি বা আনতাম, শোষিত ও নিপিড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আন্দোলনে শামিল হই বা হতাম, পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ লড়াইয়ে গ্রীণহাউস গ্যাসের ভবিষ্যৎ ধ্বংসলীলা নিয়ে যেভাবে গণমানুষের ভয়েস রেইজ করি বা করতাম তার অনেক কিছুই কোনো না কোনোভাবে আলথুসার উপন্যাসে শক্তভাবে রেখাপাত করেছেন লেখক মাসরুর আরেফিন। অথচ আপাত দৃষ্টিতে মাসরুর আরেফিনকে সহজে এই পৃথিবী বাচানোর চেতনায় উজ্জীবিত কোন ক্যারেকটার, পুজিতন্ত্রের বিরোধিতা করা মার্কসীয় মূল্যবোধের একজন প্রাকটিশনার বা প্রকৃতির কবি জীবনান্দ দাশের সেই মায়াভরা ধানসিড়ি বাচানোর লড়াইয়ে শামিল হওয়া একজন অ্যাক্টিভিস্ট এর কোনটিতেই ফেলতে পারবেন না কেউই। কিন্তু আলথুসার পাঠে অনেকের ধারণা পাল্টাবে, এই উপন্যাসের লেখক ও বিশিষ্ট ব্যাংকার মাসরুর আরেফিনকে বৃত্তের বাইরে থেকে নিশ্চিতভাবে নতুন করে জানবার বা চিনবার সুযোগ করে হবে পাঠকদের।

একজন সাবেক সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেন (সিএসও) এর কর্মী হিসেবে বেশকিছু জায়গায় পদচারণার সুযোগ পেয়েছিলাম বিশেষ করে ফাস্ট হাই লেভেল ফোরাম থেকে উৎপন্ন ২০০৩ সালের ‘রোম ডিক্লারেশন অন হারমোনাইজেশন’ এবং সেকেন্ড হাই লেভেল ফোরাম থেকে উৎপন্ন ২০০৫ সালের ‘প্যারিস ডিক্লারেশন অন এইড ইফেক্টিভনেস’ এর প্রিন্সিপলগুোলো সম্পর্কে জানতে গিয়ে উন্নত, অনুন্নত, ও স্বল্পোন্নত দেশের দায়-দায়িত্ব বা সম্পর্ক কেমন, দাতা রাষ্ট্র ও গ্রহিতা রাষ্ট্রের মধ্যে কেমন ভাব বিনিময় হবে এবং সেখানে সিএসওদের ভূমিকা কেমন হবে এ বিষয়গুলোতে কিছু জ্ঞান অর্জিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে ঘানার রাজধানী আক্রায় অনুষ্ঠিত থার্ড হাই লেভেল ফোরামে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ‘আক্রা এজেন্ডা ফর অ্যাকশন (এএএ)’ প্ল্যান তৈরীর প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ হয় যার যে প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অনুষ্ঠিত ফোর্থ হাই লেভেল ফোরামে অংশগ্রহণ করি যেখানে তৈরি হয়ে ‘বুসান পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট’ যার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যায় দাতা-গ্রহিতা রাষ্ট্রের মধ্যে এইড প্রিন্সিপালগুলো কি হবে সেখানে আমাদের মতো সিএসওরা কি ভূমিকা পালন করবে আর সিএসওই বা আসলে কারা। মানে সিএসওরা কি ‘এক্সটিংশন রেবেলিওন’ মতো কোনো কিছু দেখিয়ে মাঠ গরম করবে নাকি সত্যিকার ও স্থায়িত্বশীল কোন পরিবর্তনের অংশ হিসেবে ভূমিকা পালন করবে? করলে তাদের কাঠামো, কর্ম-পরিধি ও আইনগত ভিত্তি কেমন হবে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মিমাংসা হয় এই এই দির্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আলথুসারের অন্যতম চরিত্র প্রফেসর স্যামুয়েলকে দিয়েও লেখক সিভিল সোসাইটি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে খুব জোরালোভাবে নির্দেশ করেছেন, যেটি লেখকের সময়োপযোগী ভাবনা ও দুরদর্শীতাকে স্পষ্ট করেছে। নিজেকে এখনো খুব গর্বিত মনে হয় যে আমার ভাগ্যে এমন কিছু কিছু বিষয়ে সামান্য জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়েছিলো যা কখনো আমার চিন্তায় আসেনি।

ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে প্রবেশ করার পর বেশ ক’বছর হয়ে গেলো তথাকথিত পৃথিবী বাঁচানোর আন্দোলন থেকে অনেকটা দূরে অবস্থান করছি। আলথুসারে লেখকের ধানসিঁড়ি বাঁচাও আন্দোলনের পরিকল্পনা আবার অতীতকে মনে করিয়ে দিলো। একজন নিরাপদ ক্যারিয়ারের মানুষ হয়ে এতোবড় অনিরাপদ দুনিয়ার চিন্তা করার দরকার কি? এসব আমরা যারা ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোর তাগিদে, রুটি-রুজি বা করে খাওয়ার তাগিদ থেকে সেই কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন, ভবদহ বাঁচাও আন্দোলন, সেভ সুন্দরবন ক্যাম্পেইন, ময়ুরী নদী বাঁচাও আন্দোলন, গড়াই নদী বাঁচাও আন্দোলন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন ইত্যাদি করি বা করেছি তাদের জন্য কিছুটা প্রযোজ্য হতে পারে। আমার এই ধারনাটি অমূলক নয় কারণ জীবনের একটি সময় কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে, এনএফআই ও আএফআইদের অযাচিত হস্থক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতাম, এমনকি আমরা ম্যানিলাতে এডিবি’র সদর দপ্তরে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে বলে এসেছিলাম যে ৬২.৭ মিলিয়ন ডলারের কেজেডিআরপি প্রকল্পের ক্ষতিপূরণ না দিলে ওদেরকে বাংলাদেশে আর কোনোদিন কাজই করতে দেওয়া হবে না। এডিবির ৭৭.৫ মিলিয়ন ডলারের এসবিসিপি প্রকল্পতো বন্ধই করে দেওয়া হলো আমাদের তুমুল বাধার মুখে। কারণ ওরা বলেছিলো সুন্দরবনের প্রান্তসীমার লোকজনই নাকি সুন্দরবন ধ্বংস করছে। কি ব্যাক্কল ওদের চিন্তা-ভাবনা! তাহলে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ঐ এলাকার লোকজন সুন্দরবনকে জীবন-জীবিকার উৎস তথা নিজের ‘মা’ মনে করে পূজো করে আসতেছে তার কি হবে? সুন্দরবন ধ্বংস করা আর ওদের মায়ের গাঁয়ের গোস্ত কেটে খাওয়া কি এক নয়? আলথুসারে উঠে আসা পৃথিবীর সম্ভব্য সময়সীমা হাল্কা ভেবে উড়িয়ে দেবার মতো নয়, কারণ সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ যদি সুরক্ষার নামে কর্পোরেট জায়ান্টদের হাতে বীনা লড়াইয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে এই পৃথিবী একটি সত্যিকার পৃথিবী হিসেবে বারো বছর টেকার প্রশ্নই আসে না, সাহারা মরুভূমি হিসেবে হয়তো আরো কয়েক শতাব্দী টিকলেও টিকতে পারে।

যাইহোক, সে অনেক কথা, কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আলথুসারের লেখক মাসরুর আরেফিনের মতো হাই প্রোফাইল কর্পোরেট লিডারের মননে এক্সটিংশন রেবেলিওন’ এবং ‘ধানসিঁড়ি বাঁচাও’ আন্দোলনের বাসা বাধাটা সত্যিই ব্যতিক্রম এক ঘটনা। কারণ বড়ো একজন ব্যাংকারের লেখালেখির শখ থাকতেই পারে কিন্তু লেখার মূল বিষয় এসব বাঁচাও টাচাও মনে হয় খুব একটা মানায় না, বর্তমান দুনিয়ার ধ্বংসপ্রায় পরিবেশ তা বলে না। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে যেখানে ঠাঁই পাওয়ার কথা বড়ো বড়ো কর্পোরেট চুক্তি সেখানে তিনি পৃথিবী বাঁচানোর অংশ হিসেবে এক্সটিংশন রেবেলিওনের রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সামাজিক চুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। উপন্যাসের নায়ককে এই আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য একটি বিরাট এলাকার দায়ভারসহ একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে সবকিছুতে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে ‘মানুষ’ হিসেবে দায়িত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ করেছেন, পাশাপাশি একজন সচেতন নাগরিককে যে কোন সামাজিক দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নভাবে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

পরিশেষে একটি বড় ব্যাংকের এমডি ও একজন লেখক মাসরুর আরেফিনের মাথায় এই পৃথিবী বাঁচানোর চিন্তা আসাটা আমাকে বেশ কৌতুহলী করে তুলেছে। যেখানে ওয়ার্ড ব্যাংক, এডিবিসহ সকল আইএফআই প্রধানদের বেশিরভাগই তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সেফ গার্ড পলিসি ফলো করে না (এজন্য সারা দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষ পরিবেশ আন্দোলনকারীদের মাধ্যমে ওদেরকে অভিশাপ দেয়) সে হিসেবে একজন মাসরুর আরেফিনের তো হওয়ার কথা তাদেরই কোনো উত্তরসূরি, অন্তত তিনি যদি পুরোদমে একজন ক্যারিয়ারিস্টিক মানসিকতার হন। কিন্তু আলথুসার পড়ে মনে হলো মাসরুর আরেফিন ওগুলোতে সুযোগ পেলেও আর যেতে চাইবেন না, আবার যেতে চাইলেও ওরা নিতে নাও চাইতে পারে, কারণ এই মাসরুর আরেফিন সত্যিই যদি পৃথিবী পরিবর্তনের ডাক দেন, যদি জি-৭, জি-২০’র পরবর্তী আলোচনায় আলথুসারের অভিজ্ঞতা স্থান পায়, বৈশ্বিক ধান্দা বাদ দিয়ে যদি জীবনানন্দ দাশের ধানসিড়ি বাচানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যদি ওয়ার্ড ব্যাংক বা এডিবি বাস্তবায়িত প্রকল্প এলাকায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ পাশ করা হয়, তাহলেতো ওদের লাভের ধন সব পিঁপড়াতে খেয়ে নেবে।

আলথুসার, সত্যিই অসম্ভব সুন্দর ও বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরিখে এক অসাধারণ সৃষ্টি যা আলথুসারের আড়ালে মাসরুর আরেফিনকে অনেক অনেক বছর বাচিয়ে রাখবে। এই উপন্যাস থেকে অন্যতম শিক্ষা গ্রিক শব্দ ‘পারহেসিয়া’ যা মিশেল ফুকোর উদ্বৃতি থেকে চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে যেখানে আন্তরিকতার সাথে সকল ভয়কে উপেক্ষা করে সমালোচনার তোয়াক্কা না করে দায়িত্ববোধে অটল থেকে ‘সত্য’ বলতে হবে তাতে যত বিপদই আসুক না কেনো। আলথুসারের মাধ্যমে এই লেখককে বিস্তরভাবে জানার সুযোগ হল বলে পাঠক হিসেবে গর্বিত বোধ করছি।

বুক রিভিউ: এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংক কর্মকর্তা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :