চালচোরদের জন্য বন্দুকযুদ্ধ নীতি, এবং...

প্রকাশ | ০৪ মে ২০২০, ১৩:২৭ | আপডেট: ০৪ মে ২০২০, ১৩:৪৬

আরিফুর রহমান দোলন
আরিফুর রহমান দোলন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে বাংলাদেশে ত্রাণের পৌনে তিন লাখ কেজি চালের হদিস নেই। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য সরকারের নেওয়া খাদ্য কর্মসূচির বেহাত হওয়া এই চালের অর্থমূল্য প্রায় ৭ কোটি। একটি বিশ্বাসযোগ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে এই ধরনের নেতিবাচক খবর দেখে মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু অবাক হইনি মোটেও। দুর্নীতির মহামারি... শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, রোমানিয়া, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনার কথা বলা আছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চাল কেলেঙ্কারির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বড় লজ্জা। তবুও বিস্মিত হই না আর।
প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে চাল চুরির জন্যে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, পৌরসভার কাউন্সিলর বরখাস্ত হচ্ছেন। দুদকের মামলার আসামি হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু চাল চুরি কি থেমে আছে? ১ মে একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টালে একটি খবর দেখে চোখ আটকে যায়। ‘চাল কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ইউএনও প্রত্যাহার।’ মনে শুধু প্রশ্ন জাগলো এক যাত্রায় দুই ফল? চাল কেলেঙ্কারিতে জড়িত অন্যরা মামলার আসামি হলে একই কারণে কর্মকর্তা শুধু বদলি শাস্তি পাবেন? মনের মধ্যে জেগে ওঠা এই প্রশ্ন মনেই থাকলো। রাতেই নতুন করে টেলিভিশন আর অনলাইন পোর্টালে দেখলাম, অভিযুক্ত ইউএনওর বদলি আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মোটেও অবাক হইনি। বরং প্রত্যাশিতই ছিল। চাল কেলেঙ্কারির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তৃণমূল স্তরের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্রত্যাহার প্রশাসনসহ সব মহলে কতটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, বদলি আদেশ স্থাগিতের পেছনে সেই বিবেচনাও কাজ করতে পারে। কারণ, কান পাতলে সর্বত্রই শোনা যায় সরকার অতিমাত্রায় প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই চাল কেলেঙ্কারির বোঝা মাঠ পর্যায়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার মাথায় সরাসরি চাপিয়ে দেওয়া হয়তো সমীচীন মনে করেননি সরকারের চালিকা শক্তিরা।
সরকারের চালিকাশক্তিরা যা খুশি ভেবেই পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলুক না কেনো ত্রাণের চাল নিয়ে ছন্দপতনের ঢেউ নানাভাবেই বাজছে। যত দিন গড়াচ্ছে দরিদ্র, কর্মহীন মানুষের হাঁসফাঁস বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে যারা এই মুহূর্তে দুমুঠো ভাতের জন্য সরকারি ত্রাণের জন্য এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছেন তারা দিন দিন মারমুখী হয়ে উঠছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসছে খাদ্য সামগ্রী সহায়তার দাবিতে অনেক জনপ্রতিনিধি ঘেরাও হচ্ছেন। মানুষের এই রোষানল শেষমেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি ভবিষ্যতই বলে দেবে। কিন্তু যেসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সরকারি কর্তা বাহাদুর কার্যত মহামারীর সম্মুখে পড়া আধপেটা খাওয়া মানুষের অন্ন নিয়ে আখের গোছানোর তারে ব্যস্ত তাদের অপরাধ কি ক্ষমার যোগ্য। দেশের প্রচলিত আইনে এদের বিচার হওয়া কি যথেষ্ট হবে? না-কি প্রয়োজন চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়া? যাতে যে কোনো দুর্যোগ- মহামারিতে ভুলেও কেউ গরিবের অন্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সাহস না পায়।


ঢাকা টাইমসের একজন জেলা প্রতিনিধি তার সাম্প্রতিক কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে খানিকটা ফুঁসে ওঠেন। তার ভাষ্যমতে, একজন ইউপি চেয়ারম্যান সরকারের খাদ্য বণ্টন কর্মসূচির প্রকল্পে আজগুবি আর ভুয়া নাম ঢুকিয়েছেন সমানে। এইভাবে সরকারের যত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সব কটাতেই কাল্পনিক নামের ছড়াছড়ি। আদতে কাল্পনিক এসব নামের আড়ালে প্রকৃত সুবিধাভোগী এই চেয়ারম্যান আর তার সহযোগীরা। ভুক্তভোগীরা যাতে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের অভিযোগ না করেন সেজন্য হুমকি-ধামকি লেগেই থাকে। তবে সম্প্রতি প্রশাসন চড়েচড়ে বসেছে। এটি মোটেও কোনো খন্ড চিত্র নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের একাংশ এভাবে বানরের রুটি ভাগে ব্যস্ত-অভিমত ওই সংবাদকর্মীর। হ্যাঁ, তিনি মোটেও ভুল বলেননি, বরং কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার টেটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ২৮ এপ্রিল পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ১৫ টন চাল আত্মসাতের অভিযোগে ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে পেকুয়া থানায় মামলা করেন। মামলার পর থেকে চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী পলাতক রয়েছেন। মামলার বাদী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, হতদরিদ্রদের বিতরণের জন্য ১৫ টন চাল উত্তোলন করেছিলেন টেটং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। কিন্তু বিতরণ না করে চেয়ারম্যান আত্মসাত করায় মামলা করা হয়েছে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে পটুয়াখালী উপজেলায়। রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন পরিষদের জুগির হাওয়া ৬ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মাসুদ তালুকদার ও জুগির হাওলা গ্রামের আইয়ুব আলী ব্যাপারী ত্রাণের চাল আত্মসাতের অভিযোগে মামলার আসামি হয়েছেন। আইয়ুব আলী ব্যাপারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও পলাতক রয়েছেন ইউপি সদস্য মাসুদ তালুকদার। নড়াইল জেলার নড়গাতী থানার জয়নগর ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন ত্রাণের চাল আত্মসাতের মামলা খেয়েছেন এবং যথারীতি পলাতক আছেন। সরকারি ত্রাণের ২৮০ কেজি চাল আত্মসাতের অভিযোগে গত ২১ এপ্রিল নড়াগাতী থানায় মামলা করেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জয়নগর ইউনিয়নে ত্রাণের প্রথম দফা ৩ টন চাল এর অল্প কিছু বিতরণ করেন চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন। এরপর ২০ এপ্রিল সোমবার এক ট্রাক চাল নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নিজের নামে কিছু বিতরণ করেন। অবশিষ্ট চালের জন্য ভুয়া মাস্টাররোল তৈরি করে খাদ্য বিভাগে জমা দেন। ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তদন্তেও তা প্রমাণিত হয়। এরপরই নড়াগাতি থানায় মামলা করা হয়, পরে মামলা পাঠানো হয় দুদকে। অন্যদিকে ৪১ টন ভিজিডি চাল আত্মসাতের ঘটনায় একই থানার পিরোলী ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ত্রাণের চাল চুরির ঘটনায় রাজনৈতিক দলের নেতা, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যের জড়িয়ে পড়া, গ্রেপ্তার হওয়া কিংবা মামলার পর পালিয়ে যাওয়ার এরকম খবর খুব স্বাভাবিক ঘটনা যেন। বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না কারো কারো। অনেকেই অস্বাভাবিকভাবে ভয়ডরের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। হাবভাবে, কথাবার্তায় এমন আচরণও করছেন কোথাও কোথাও কেউ। যেন সাপের পাঁচ পা দেখেছেন। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ডজনখানেক মামলা করেছে দুদক। তবু টনক নড়ছে না কারো কারো। উল্টো ত্রাণ চাওয়ায়, তালিকায় নাম না থাকায় কিংবা স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনায় প্রবীণ নাগরিকের গায়ে হাত উঠানোর অভিযোগও কোনো কোনো স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে উঠছে। এটা যেন মগের মুল্লুক। যেসব জনপ্রতিনিধি মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তারা নিশ্চয়ই সাধুবাদ পাবেন। কিন্তু যারা নয়ছয় করছেন তারা কি এইভাবে পালিয়ে বেঁচে যাবেন? কিংবা বুক ফুলিয়ে উঁচু গলায় কথা বলবেন?
সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে তিনি বলেছেন, দুর্যোগকালীন দুর্নীতিবাজদের চরম শিক্ষা দেবে দুদক। সারাদেশে দুদকের নজরদারি রয়েছে। গোয়েন্দারা কাজ করছে, দুর্নীতিবাজরা রেহাই পাবে না। গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন দুদক চেয়ারম্যান। দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহযোগিতার জন্য চাল চুরির ঘটনা যারা ঘটাচ্ছেন তারা দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। এদের ছাড়া হবে না।
দুদক চেয়ারম্যানের কথা আর কাজে আমরা মিল পাই বলে আমরা আশান্বিত হই। নিশ্চয়ই দুর্যোগকালীন দুর্নীতিবাজরা কঠিন শাস্তির আওতায় আসবেন এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বার বার দ্বার্থহীন ভাষায় ত্রাণ বিতরণ ও ওএমএস কার্যক্রমের চাল বিক্রির অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও চাল নিয়ে দুর্নীতি ও আত্মসাতের খবর মিলছে প্রতিনিয়ত। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে চাল চোরদের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্তা নেওয়া হচ্ছে তা কি আসলে যথেষ্ট? মোটেও না। মোবাইল কোর্টের টুকটাক জরিমানায় আর নিয়মিত মামলা দিয়ে চাল চোরদের নিবৃত্ত করা যাবে না। প্রয়োজন ইস্পাত কঠিন নীতি। অন্য অনেক অপরাধীদের ধরতে পুলিশ, র‌্যাব তাদের পিছু নেয়। এরপর দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। শেষমেষ হয় বন্দুকযুদ্ধ। অতঃপর অপরাধীর অসহায় আত্মসমর্পণ গল্প আমরা শুনি। চাল চোরদের জন্য এই নীতি নিলে মন্দ কী। আমরা চাই এমন ভীতির সঞ্চার হোক যাতে চাল চোরদের মধ্যে, চুরির পরিকল্পনাকারী আর তাদের দোসরদের মধ্যে প্রাণ ভীতি আসে। পাশাপাশি প্রবল সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
অনেকেই বলছেন, ত্রাণ ও ওএমএসের চাল বিতরণের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গলদ আছে। এই ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। কিছু পরিবর্তন চুরি, শুভঙ্করের ফাঁকি ঠেকাতে সহযোগিতা করবে এমন মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ত্রাণ ও ওএমএস ব্যবস্থার ওপর নজরদারি রাখতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলছেন অনেকেই। এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে সামগ্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় বের করতে হবে। টাস্কফোর্সের আওতায় সশস্ত্রবাহিনী, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করে ত্রাণ বিতরণের একটা স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারেও অনেক বিশেষজ্ঞ মত আছে।
ত্রাণ বিতরণে অধিকতর অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কঠিনতম পদক্ষেপ নিয়ে এখনই এসব অনিয়ম দমন করতে হবে।
লেখক: সম্পাদক, ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এই সময়।