‘ভয় নয় সচেতন হতে হবে’

প্রকাশ | ০৪ মে ২০২০, ১৬:৩১ | আপডেট: ০৪ মে ২০২০, ১৭:১৭

মরিয়ম আক্তার মীম

আমি মরিয়ম আক্তার মীম। ঢাকার কদমতলী থানার শ্যামপুর বহুমুখী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে অন্যান্য স্কুল-কলেজের মতো আমাদের স্কুলও বন্ধ দেয়া হয়েছে। ১৭ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ। তারপর থেকে ঘরেই আছি। আর দিন গুণছি কবে স্কুল খুলবে। আমার স্কুলে যেতে খুব ভালো লাগে।

আগে যখন সবার জীবন স্বাভাবিক ছিল তখন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম। তড়িঘড়ি স্কুলে যেতাম। আমি মনিং শিফটের। স্কুল শুরু হতো সাতটায়।

আমার বাসা শ্যামপুরের আলী বহর। সেখান থেকে পনোরো মিনিট হাঁটলেই আমার স্কুল। এই পথটুকু যেতে যেতে কলকারখানার ব্যস্ততা দেখতাম। কারণ আমার স্কুলের পথেই অনেকগুলো কারখানা। ওসব কারখানার বেশির শ্রমিক শিশু।  আমি তখন মনে ভাবতাম, আমি কত ভাগ্যবান। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ওসব শিশুরা এই অল্প বয়সেই রোজগার করতে কতই না খাটছে! 

এসব ভাবতে ভাবতে স্কুলের ফটকে এসে পৌঁছতাম। ক্লাশে ঢুকেই আমার জন্য নির্ধারিত আসনে ব্যাগ রাখতাম। বলে রাখছি, আমাদের স্কুলের নিয়ম ক্লাশের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীদের বসার আসন নির্ধারিত। আমি যেহেতু অষ্টম শ্রেণিতে তৃতীয় তাই আমার বসার স্থানও নির্ধারিত। সেখানে ব্যাগ রেখে সহপাঠীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে দৌঁড়ে অ্যাসেম্বেলিতে অংশ নিতাম। 

এরপর সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একটানা ক্লাশ। তারপর আধাঘন্টার বিরতি। বিরতিতে কখনো বাসা থেকে আম্মুর দেয়া টিফিন খেতাম। কখনোবা স্কুলের ক্যান্টিন থেকে টিফিন কিনে খেতাম। সহপাঠীদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করতে কার্পণ্য করতাম না। এরপর ক্লাশ চলতো ১২ টা পর্যন্ত। 

স্কুল ছুটি হলে বাড়ি এসে হাতমুখ ধুয়ে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিতাম। বইখাতা টেবিলে গুছিয়ে গোসল, দুপুরের খাওয়া সেরে কোচিং যেতাম। বিকালে বাসায় ফিরে মাঠে বা ছাদে গিয়ে খেলতাম। সন্ধ্যায় নাস্তা সেরে পড়তে বসতাম। সন্ধ্যার পর বাসায় গৃহশিক্ষক পড়াতে আসতেন। তিনি চলে গেলে স্কুলের বাড়ির কাজ করতাম। রাতের খাবার খাওয়ার পরেও আমি রুটিন অনুযায়ী পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম। ১১ টার আগে কখনোই ঘুমাতে যেতাম না। এই ছিল আমার রোজকার রুটিন।

ছুটির দিনগুলো খুব আনন্দে কেটেছে। অথচ এখন রোজই ছুটি। ছুটির ঘণ্টা যে শেষই হচ্ছে না। ছুটি আর ছুটি। কিন্তু তারপরও আমি খুশি না। কারণ স্কুল বন্ধ, সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা নেই। এবছর আমার জেএসসি পরীক্ষা। কিন্তু হোম কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন পড়াশোনা খুব বেশি একটা হচ্ছে না। প্রত্যাহিক রুটিন এক ঘেয়েমিতেপূর্ণ। বিকালে মাঠে খেলতে যেতে পারি না। আত্মীয়-স্বজনদের কতদিন দেখা নেই। তাদের বাড়ি কত দিন যাওয়া হয় না। 

এখন আমার ঘুম ভাঙে নয়টায়। আগে যেখানে ছয়টার আগেই বিছানা ছাড়তাম এখন সকালে আলস্য যে আমাকে ছাড়েই না। সকালে নাস্তা খাওয়ার রুচি নেই যেনো! স্কুল, কোচিং বন্ধ, তাই পড়াশোনায়ও চাপ নেই। ধীরে সুস্থে পড়ি। দিনের একটা বড় অংশ কাটে আমার আম্মুকে ঘরের কাজে সহযোগিতা করে। এতে খানিকটা সময় ভালো কাটে। কাজের মধ্যে থাকলেই দ্রুত দিন ফুরায়। আগে যেখানে কোথা দিয়ে দিন কেটে যেতো তা বুঝতেই পারতাম, আর এখন দিন যেনো কাটছেই না। তাই তো কিছু সময় টেলিভিশন দেখি। 

কয়েকদিন আগে আমার এক মামা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি সংসদ টেলিভিশনে সম্পচারিত ক্লাশ গুলোয় অংশ নেই কিনা? তার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। আমাকে কেই কিছু বলেনি। আমার শিক্ষকদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। সহপাঠীদের সঙ্গেও। কারণ আমার কারো মোবাইল ফোন নম্বর জানা নেই। আমাদের স্মার্টফোন নেই। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগও মেলে না। ফলে টেলিভিশনে এতদিন যে ক্লাশ হচ্ছিল সেটা জানা ছিল না। এখন যেহেতু জেনেছি, এখন থেকে রোজ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ক্লাশগুলোয় অংশ নিবো। 

করোনার কারণে প্রতিবেশিরাও আমাদের বাসায় আসে না। অনেকটা বন্দি জীবন সবার। তবে যাদের বাসা আমাদের বাসার একদম লাগোয়া তাদের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়। আমি প্রতিবেশিদের আমার বয়সী কিংবা ছোট ছেলেমেয়েদের সব সময় বলি হাত ধুতে, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে। আমার ছোট ভাইকেও আমি যত্ন নেই। আমি তাদের বলি ভয় নয় সচেতন হোন। করোনাকে সচেতনতা দিয়েই জয় করতেই হবে।

আমি আবার স্বপ্ন দেখি, পুরোনো রুটিনটা আবার ফিরে পাবো। রোজ স্কুলে যাবো, বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলবো। মুক্ত আকাশে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিবো। জীবন চলবে স্বাভাবিক ছন্দে।
 

অনুলিখন: আসাদুজ্জামান

(ঢাকাটাইমস/৪মে/এজেড)