পিয়াস মজিদ-এর ‘সাক্ষাৎকার ১৭’

আলোকিত আলাপনের সমৃদ্ধ সমাহার

প্রকাশ | ০৭ মে ২০২০, ১৫:৩০

আবদুল্লাহ আল মোহন

১.

কখনও আত্মতাগিদে, কখনও সম্পাদকদের অনুরোধে প্রিয় কবি, কথাশিল্পী এবং গবেষকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তরুণ প্রজন্মের কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক পিয়াস মজিদ। আপন অবদানের জন্যই আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নিবেদিতপ্রাণ আলোচিত সতের জনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকারের এই গ্রন্থনাগ্রন্থটি আলাপচারীতায় উৎসাহী যে কোন পাঠকের আগ্রহ জাগাবে, বাড়াবে। কারণ নাম তালিকায় রয়েছেন- সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মনজুরে মওলা, শামসুজ্জামান খান, বেগম আকতার কামাল, হাসান আজিজুল হক, হরিপদ দত্ত, ইমদাদুল হক মিলন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, সেলিম আল দীন, দং ইউ ছেন, সাইদুর রহমান বয়াতী এবং কবি শহীদ কাদরী পত্নী নীরা কাদরী। পিয়াস মজিদ-এর ‘সাক্ষাৎকার ১৭’ গ্রন্থের বহুল পাঠ, প্রচার ও আলোচনা কামনা করছি। বইয়ের প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, প্রকাশক : মাওলা ব্রাদার্স, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, মূল্য: দুইশত টাকা মাত্র।

২.

উল্লেখিত সতেরজনের প্রতেককে নিয়ে আলোচনা লেখা সম্ভব কিন্তু পরিসর বৃদ্ধি পাবে বিবেচনায় কয়েকজনের সাক্ষাৎকারের অংশ তুলে ধরে আমার এই আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছি। ‘সব্যসাচী লেখক’ সৈয়দ শামসুল হকের বৈচিত্রময় জীবন ও লেখার পরিচয় পাই পিয়াস মজিদ-এর ‘সাক্ষাৎকার ১৭’ গ্রন্থের প্রথম আলাপচারিতায়।  আমরা জানি, বাংলা সাহিত্যজগতে এককথায় সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় 'সব্যসাচী লেখক' হিসেবে। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং নাটকসহ শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তার লেখনীতে।  সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম (জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ – প্রয়াণ: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬) উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন সৈয়দ হক।  ১৯৫১ সালে ‘অগত্যা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে তার প্রথম প্রকাশিত লেখাটি ছিল একটি গল্প। এরপর তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে। ১৯৬৬ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সৈয়দ শামসুল হক স্কুলজীবন শেষ করেন কুড়িগ্রামে। এরপর ১৯৫১ সালে মুম্বাইতে গিয়ে কিছুদিন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। দীর্ঘজীবনে তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন। তার অনুজ এবং তরুণ লেখকেরা প্রভাবিত হয়েছেন তার লেখায়। সৈয়দ শামসুল হক কবি হিসেবেও পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের জন্য পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ, বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা। আধুনিক সময়ে কোনো কবির এত দীর্ঘ কবিতা বেশ বিরল। তার এই কাব্যগ্রন্থের কারণে তিনি তখন আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। তার আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পরানের গহীন ভিতর’ দিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে উপস্থাপন করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক তার কর্মজীবনের প্রায় সাত বছর কাটিয়েছেন লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের সাথে। বিবিসি বাংলা থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছেন ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে। নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন দারুণ সফল। বিশেষ করে তাঁর রচিত দুটি কাব্যনাট্য ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হকের অবদান শুধু নাটকেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন, এমনকি চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সৈয়দ শামসুল হকের কলম এখন থেমে গেছে, কিন্তু তিনি যে ভবিষ্যৎ লেখকদের-কবিদের-নাট্যকারদের অনুপ্রাণিত করবেন, পথ দেখাবেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। শামসুর রাহমান,হাসান হাফিজুর রহমান,কাইয়ুম চৌধুরী,ওয়াহিদুল হক,আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী,বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান,মাইকেল মধুসূধন দত্তকে নিয়ে নাটক লিখতে চেয়েছিলেন,চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার আগে এই সাক্ষাৎকারে সৈয়দ শামসুল হক জানিয়েছিলেন তাঁর সে ইচ্ছার কথা। আরও বলেছিলেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে- লেখকজীবন,ঘরসংসার,বন্ধুবান্ধব, সাহিত্য-কত কিছুই না এসেছিল সেই আলাপচারিতায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পিয়াস মজিদ। ‘লেখা খাঁটি হলে তা কাল ছুঁয়ে মহাকালকে এমনিতেই স্পর্শ করবে’ শিরোনামের সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরছি।

৩.

পিয়াস: কখনো কি এমন হয় আপনার—নিজের লেখা গল্প-উপন্যাস-নাটকের চরিত্ররা তাড়া করে ফেরে বা সঙ্গ দেয় আপনাকে?

সৈয়দ হক: একেবারে বাস্তবিক উদাহরণ হলো এই যে আমার নাটক নূরলদীনের সারাজীবন লেখা ও মঞ্চায়নের পর একদিন বাড়িতে দেখি নূরলদীনের বংশধর দাবিদার এক নারী এসে হাজির। সরকারের কাছে বলে নূরলদীনের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ তার। আমি তাকে বলি যে আমি নাটক লিখেছি মাত্র, বাস্তবিক নূরলদীনের বংশধরের সত্যাসত্য যাচাই আমার কাজ না। আর নিজের লেখার চরিত্রের সংসর্গ যদি বলি তো শুধু গল্প-উপন্যাস কেন আমি যে সিভি কাবাফির কবিতা অনুবাদ করেছি সে কাবাফির জীবনটাও অনুবাদসূত্রে আমার ভাবনায় ক্রীড়া করে। একজন একলা কবি অন্ধকার নিঃসঙ্গ ঘরে সিঁড়ি ভেঙে উঠছেন, সঙ্গে সঙ্গে উঠছেন তাঁর শব্দ ও বোধি—জনারণ্যে নিজেকেও এমনভাবে উপলব্ধি করে উঠি কখনো সখনো।

পিয়াস: আপনার লেখায় নানাভাবে এসেছে রাজনীতির প্রসঙ্গ। রাজনীতিকে কীভাবে দেখেন?

সৈয়দ হক: রাজনীতি তো সাহিত্য থেকে আলাদা কিছু নয়। আমাদের আনন্দিত বা বিষণ্ন বিধিলিপির নাম রাজনীতি। প্রাঙ্গণে মোর নাট্যদল যে ‘সৈয়দ হক নাট্যোৎসব’ আয়োজন করল, তার মাধ্যমে লিখে ওঠার দীর্ঘদিন পর ধারাবাহিকভাবে নাটকগুলো দেখে নিজেই নিজের দূরত্বে থেকে আবিষ্কার করলাম, কী আশ্চর্য! আমার প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেই এসেছে দেশ, মানুষ, সমাজ ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসিতে যে কাজ করেছি, সেখানে পেশাগতভাবে বাংলাদেশের একটা সংবাদ অন্য দেশের মানুষের কাছে শুধু সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে আর আমাদের বাঙালি কর্মীদের কাছে সেটা ছিল জীবন-মরণ ব্যাপার। গত শতকের উনিশশ বিরানব্বইতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণ-আদালতে অভিযোগ দাখিল করেছি আমরা তিন বন্ধু—আনিস,বোরহান ও আমি। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগটি উত্থাপন করি আমি। আজ সেই গণহত্যার দায়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এই বাংলাদেশে। ভাবতে ভালো লাগছে এই কারণে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার প্রারম্ভপর্বে যুক্ত ছিলাম আমরা—পঞ্চাশের সন্তানেরা;এক অর্থে ভাষা আন্দোলনের মোহনা বেয়ে যারা বেড়ে উঠেছি।

পিয়াস: সমালোচনাকে কীভাবে গ্রহণ করেন আপনি?

সৈয়দ হক: সমালোচনা হচ্ছে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আলোচনা। আর নতুন যা হওয়ার অপেক্ষা তা হচ্ছে সৃষ্টি। আমার সমস্ত আগ্রহ সেই সৃষ্টিকে ঘিরে। তাই আমার সাহিত্যকর্ম নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক কোনো আলোচনায় আমার খুব একটা আগ্রহ নেই। যদিও নিন্দামন্দের সমান্তরালে সাহিত্যজীবনের প্রথম প্রভাতেই পেয়েছি রশীদ করীমের মতো অগ্রজ লেখকের মূল্যায়ন। তিনি অনতিতরুণ আমাকে নিয়ে লিখেছেন মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদকীয় পাতায়। একজন লেখক সেদিন বলল, আপনার সমস্ত বইয়ের প্রথম সংস্করণ একসঙ্গে গুছিয়ে রাখা দরকার। আমি বললাম,কী দরকার? হয়তো কয়েকশ বইয়ের ভিড়ে ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ কথাটা শুধু টিকে থাকবে। কিংবা হয়তো তা-ও থাকবে না। মানুষের পাঠে থাকছি কি না, বোধিতে থাকছি কি না, তা-ই মুখ্য। এসব সংরক্ষণশীলতায় কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না সাহিত্যের। ফলে দেখবে আমার উপন্যাস-গল্প-কবিতা-নাটকের সংকলনের তথ্যসূত্র হিসেবে কোনো সনতারিখের ধারাবাহিকতা থাকে না। লেখা খাঁটি হলে তা কাল ছুঁয়ে মহাকালকে এমনিতেই স্পর্শ করবে।

পিয়াস: আপনার বিবেচনায় ভাষা কীভাবে ধরা দেয়?

সৈয়দ হক: ভাষা হচ্ছে লেখকের নির্বাচন করা ব্যবহার্য রঙের মতো। এই রঙের ছাপই একজন লেখকের যেকোনো লেখাকে আলাদা করে চেনাবে।

পিয়াস: শিল্পের নিজস্ব শৈলী সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

সৈয়দ হক: আমি মনে করি কবিতাসহ যেকোনো শিল্পকে তার নিজস্ব মাটিবর্তী অবশ্যই হতে হবে। এ জন্য আমি ওরহান পামুকের চেয়ে তুর্কি শৈলীর নিজস্বতার ব্যবহারের কারণে ইয়াসের কামালের কথাকাহিনিতে আকর্ষণ বোধ করি বেশি। আর আমাদের বাংলা অঞ্চলে একসময়ে কবিতা সুর করে জনজমায়েতে গীত হতো বলে আমি কবিতার শ্রুতিকে খুব মূল্য দিই। বিভিন্ন জায়গায় পাঠ করি নিজের কবিতা। এর মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে কবির সংযোগ আরও নিবিড় হয় যেমন, তেমনি বাংলার কবিতা পাঠের হারানো রেওয়াজ ফিরে আসার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।

পিয়াস: এক জীবন উদ্‌যাপন করলেন লেখার সাধনায়। জীবনের এই প্রান্তে এসে এ বিষয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

সৈয়দ হক: হিন্দি ফিল্মের কাহিনিকার শ্রী রামচন্দ্র বলেছিলেন, ‘নিজের ভালো লেখার পুনরাবৃত্তি কেবলই ব্যর্থ লেখার জন্ম দেয়।’ আমি এখনো একটি নতুন লেখার সময় এ বিষয়ে সচেতন থাকার চেষ্টা করি,যেন পুনরাবৃত্তিতে আটকে না থাকি।

৪.

বেগম আকতার কামালের জন্ম ১৯৫২ সালের ২১ জুলাই চট্টগ্রামে। শিক্ষাজীবন কেটেছে চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর হন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালে ‘বিষ্ণু দের কবিমানস ও কাব্য’ শিরোনামে পিএইচডি গবেষণা করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল তাঁর পেশাজীবন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বেগম আকতার কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সাহিত্যপত্র সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর নিজের লেখা বইয়ের সংখ্যা পনেরোর অধিক, সম্পাদিত ৪। তাঁর কয়েকটি বই বিষ্ণু দের কাব্য: পুরাণ প্রসঙ্গ, বিষ্ণু দের কবিস্বভাব ও কাব্যরূপ, কবিতার নান্দনিকতা: প্রাচীন ও মধ্যযুগ, রবীন্দ্রনাথ যেথায় যত আলো, জীবনানন্দ: কথার গর্বে কবিতা। ২০০৬ সালে পেয়েছেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার। বেগম আকতার কামাল রচিত রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা গ্রন্থটিকে মননশীল শাখায় প্রথম আলো বর্ষসেরা বই -১৪২৩ হিসেবে পুরস্কৃত করে অভিজ্ঞানপত্রে বলা হয়, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণাকর্মের ঐতিহ্য ও উৎকর্ষ সামগ্রিক বিচারে তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এই আকিঞ্চনের মধ্যেও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে গবেষণা নিজ শক্তিতে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে। এমন একটি বিষয় বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র-প্রতিভার বহুমুখিনতাই যে তাঁকে নিয়ে গবেষণার এই বিস্তারকে উৎসাহিত করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেসব গবেষণার আছে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট ফসল। গবেষণার সেই ধারাবাহিকতায় এবার যোগ দিয়েছেন বেগম আকতার কামাল। তাঁর গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনাতে দেখা যায় রবীন্দ্রদর্শনের একেবারে কেন্দ্রভূমি নিয়ে অনুসন্ধান। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিশ্বাসকে বেগম আকতার কামাল শুধু আধ্যাত্মিকতা ও অধিবিদ্যার নিরিখেই বিচার করেননি, উদ্‌ঘাটন করতে চেয়েছেন এর যৌক্তিক ও সৃজনশীল স্বরূপও। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিশ্বাসকে বোঝার চেষ্টা করেছেন প্রাসঙ্গিক ও কল্পনার যুক্তি দিয়ে। বেগম আকতার কামাল মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিমানসে ব্রহ্মাণ্ড যে প্রতিরূপে ধরা পড়েছে তার সঙ্গে মননশীল বিশ্লেষণের কোনো মৌলিক তফাত নেই। এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে গবেষক ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রতিরোধক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনাকে দাঁড় করান।’ সেই প্রেক্ষিতে গৃহীত সাক্ষাৎকারে বেগম আকতার কামাল বলেছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চেয়েছি বিস্ময়ে, বিচারহীন হয়ে নয়’। পিয়াস মজিদের সাথে সেই আলাপনের কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করছি।

৫.

পিয়াস: রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা কতটা উত্তরাধিকারবাহিত আর কতটা তাঁর মৌলিক চিন্তার ফসল বলে মনে করেন?

আকতার কামাল: তিনি তো উত্তরাধিকারবাহিত অবশ্যই। পিতার কাছ থেকে উপনিষদে দীক্ষা নিয়েছেন। অবশ্য উপনিষদের শাস্ত্রাংশের বদলে নান্দনিক অংশটুকু নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে অন্বিত করেছেন। তিনি নিজেকে চিহ্নিত করেছেন ‘ব্রাত্য, মন্ত্রহীন’ নামে, নিজের ধর্ম আবিষ্কার করেছেন নিজেই। সৃজনশীল সত্তার সঙ্গে আত্মধর্মকে মিলিয়ে পরমের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। ১৫১টি ব্রহ্মসংগীত তাঁর অল্প বয়সের রচনা। ওই অর্থে গীতাঞ্জলির পর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রহ্মসংগীত লেখেননি, তবে তখন ব্রহ্মই এসেছে বন্ধু হয়ে, সখা হয়ে, প্রভু হয়ে—এক রূপক থেকে অন্য রূপকে। আমাদের অস্তিত্বের চারপাশে যে শূন্যতার বিস্তার, তাকে পূর্ণতায় রূপান্তর করতে কেউ ঈশ্বরভাবনার শরণ নেন। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি পর্বে যদিও ঈশ্বর ও প্রেমিকসত্তার উদ্ভাসন ঘটিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তিনি কিন্তু ‘সে’ নামে এক সত্তায় খুঁজে পেয়েছেন জগৎসংসারে যুক্ততার সূত্র। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ‘সে’ বলতে তিনি সৃষ্টিশীলা নারীকেই বুঝিয়েছেন।

পিয়াস: শিক্ষকতা করছেন দীর্ঘদিন, রবীন্দ্রনাথও পড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শিক্ষক ও লেখক—এই দ্বিবিধ সত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন কীভাবে?

আকতার কামাল: এই দ্বিবিধ সত্তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি, আবার জয়ও করি। রবীন্দ্রনাথ পড়াতে গিয়ে শুধু রবীন্দ্রনাথের কথাই তো বলি না, তাঁর সূত্র ধরে নিজের কথাও এসে যায়। ছাত্রছাত্রীদের বলি, বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুটো লাইনও যদি তারা বহন করে নিয়ে যায় এবং তা যদি তাদের জীবনদর্শনে বিন্দুবৎ উজ্জীবন জোগায় তাহলেই আমি সার্থক। না, শিক্ষকতা এবং গবেষকসত্তার মধ্যে কোনো বিরোধ কাজ করে না আমার।

পিয়াস: এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু বলে মনে করেন?

আকতার কামাল: দার্শনিক কান্টের মতো আমিও মনে করি, অধ্যাত্মবোধ চিরমানুষের অন্তর্গত বিষয়। একুশ শতাব্দীতে এসেও একে আধুনিক মানুষের চর্চাবহির্ভূত বিষয় ভাবা যাবে না। আজকের বস্তুবাদী, অশান্ত পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের শান্তিতত্ত্বের কথা বারবার মনে আসে আমাদের। বিশেষত, ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরলে বস্তুভোগ আর প্রাপ্তির ভেতরে পৃথিবীর ভেতরে লুকানো হাহাকার-শূন্যতা টের পাওয়া যায়। তখনই আসে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনার মতো মানববিদ্যার প্রাসঙ্গিকতা।

৬.

চীনের রবীন্দ্র-গবেষক ও অনুবাদক দং ইউ ছেন। চীনা ভাষায় তেত্রিশ খণ্ডে রবীন্দ্র-রচনাবলী অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা ও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসও অনুবাদ করেছেন তিনি। দং ইউ ছেন আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করেন, ‘বাংলা সাহিত্য অত্যন্ত গভীর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ’। ২০১৮ সালে এসেছিলেন বাংলাদেশে। সাক্ষাৎকারে পিয়াস মজিদকে জানিয়েছিলেন সাক্ষাৎকারে নিজস্ব ভাব-অনুভূতি। চীনের রবীন্দ্র-গবেষক ও অনুবাদক দং ইউ ছেনের জন্ম ১৯৩৭ সালে, উত্তর-পূর্ব চীনের জিলিন প্রদেশে। কৃষক পরিবারের সন্তান মৃত্তিকালগ্ন এ মানুষটি হয়তো রবীন্দ্রনাথের ভেতর মৃত্তিকাবর্তিতারই উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস অনুবাদের পাশাপাশি তাঁর মহত্তম কৃতি হিসেবে আমরা পাই চীনা ভাষায় ৩৩ খণ্ডে রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদকর্ম, যা তাঁরই সম্পাদনায় ২০১৫-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে। কর্মজীবনে অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা সাহিত্যের গবেষণাসূত্রে যুক্ত ছিলেন বেইজিং ফরেন স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া গবেষণাকেন্দ্রে। ১৯৬০-এর দশক। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেন্ট পিটার্সবুর্গে অবস্থিত লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে সাড়ে পাঁচ বছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়া করছেন দং ইউ ছেন। এ সময়ই তাঁর হাতে এল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস নৌকাডুবি। এটি পড়ার পর তাঁর হৃদয়নদীতে যেন সৃষ্টি হলো গভীর ভালোবাসার তরঙ্গ। ভাবলেন, পড়াশোনা শেষ করে চীনে ফিরেই এই বইটির অনুবাদের কাজে হাত দেবেন। তত দিনে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি আর গল্পগুচ্ছও তাঁর পড়া শেষ। ১৯৬৫-এর ডিসেম্বরে শিক্ষা শেষ করে দং ফিরে এলেন বেইজিং। এর মধ্যেই তিনি প্রেমে পড়ে গেছেন বাংলা ভাষার। নিত্যদিনের কাজ থেকে বাড়ি ফিরে একটু সময় বের করে মন দিয়ে পড়েন গল্পগুচ্ছ, নোট নেন আর অনুবাদ করেন। ধাপে ধাপে অনুবাদ করেন ‘মহামায়া’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘খাতা’ এমন প্রায় ২৫টির বেশি গল্প। এর মধ্যে হুয়া-ওন্বেন গণপ্রকাশনালয় তাঁর কাছে থেকে নৌকাডুবি উপন্যাসের অনুবাদ আহ্বান করল। প্রায় আট-নয় মাসে শেষ করেন সেটি। তারপর রবীন্দ্রনাথেরই আরেকটি উপন্যাস ঘরে-বাইরে। যদিও তাঁর সবচেয়ে ভালো লাগার উপন্যাস হলো নৌকাডুবি। দং-এর ভাষায়, ‘বাংলা ভাষায় “নৌকা” বলার সময় আমার চোখে আবেগে জল চলে আসে। আমি তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে এক বাক্যে বলি, আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস নৌকাডুবি। নৌকার ডুবে যাওয়ার মতোই মানুষের গভীরে ডুব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাহিনি বর্ণনা করেন সহজ-সুন্দর ভাষায়।’ সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কিছু অংশ উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে তুলে ধরছি।

৭.

পিয়াস: সাধারণ চীনা জনগণ রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে গ্রহণ করেছে?

দং ইউ ছেন: চীনা ভাষায় অনেক বিদেশি কবি-লেখকের রচনা অনূদিত হয়েছে। বিশেষত পশ্চিমের সাহিত্য। রাশিয়ার তলস্তয়, পুশকিন, শোলখভ—এমন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকের রচনা অনূদিত হয়েছে। তবে আমি বলতে পারি, এঁদের সবার তুলনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাই চীনাদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। তার কারণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য যেমন অসাধারণ তেমনি রবীন্দ্রনাথ নামের ব্যক্তিমানুষটিও ছিলেন অসাধারণ। আপনারা জানেন, ১২৯০ বঙ্গাব্দে তরুণ রবীন্দ্রনাথ চীনে মরণের ব্যবসায় নামে প্রবন্ধ লিখে চীনের মানুষকে আফিমের নেশা ধরানোর জন্য পশ্চিমা স্বার্থবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। চীনা জনতা এ জন্য আজও তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। চীনে ১৯৬১-তে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ এবং সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সার্ধশততম জন্মশতবর্ষ সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়েছে।

পিয়াস: রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্যের আর কী কী অনুবাদ করেছেন আপনি?

দং ইউ ছেন: রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের বেশ কিছু লেখা সাহিত্য চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছি। যেমন ইন্দিরা, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, চন্দ্রশেখর ইত্যাদি। অনুবাদ করেছি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসিকা বড়দিদি ও তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস স্বর্ণলতা। রুশ থেকে চীনা ভাষায় ভাষান্তর করেছি মহাভারতের সংক্ষিপ্তসার এবং শ্রীকৃষ্ণের জীবনকাহিনি। লিখেছি দক্ষিণ এশিয়ার কবি রবীন্দ্রনাথ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের একটি জীবনীও। অনুবাদের পাশাপাশি সুখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক জি শিয়েন লিয়ের নেতৃত্বে ‘প্রাচ্যসাহিত্যের ইতিহাস’ শিরোনামে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে লিখতে পেরেছি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অংশটিও।

পিয়াস: ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আর কী কী কাজের পরিকল্পনা আছে আপনার?

দং ইউ ছেন: রবীন্দ্রনাথের মতো কাজী নজরুল ইসলাম আমার খুবই পছন্দের কবি। বিশেষ করে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। নজরুলের সাহিত্য অনুবাদ করার ইচ্ছে আছে। আরও ইচ্ছে আছে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিদের একটি সুনির্বাচিত সংকলন চীনা ভাষায় অনুবাদ করার। আর যদি আরেকটু প্রসারিত জীবন পাই তাহলে আমি বড় পরিসরে বাংলা সাহিত্যের একটি ইতিহাস লিখতে চাই।

৮.

খ্যাতিমান শিল্পী ও গীতিকার সাইদুর রহমান বয়াতী। দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্যরীতির বিভিন্ন আঙ্গিকের পালাকার, নির্দেশক এবং অভিনেতা। এগুলো ছাপিয়ে তার অন্যতম পরিচয় তিনি একজন মরমী সাধক। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান, রাখালিয়া, গাজীর গানসহ প্রায় ৫০ রকমের গান জানা সাধক নিজেও গান লিখেছেন দুই হাজারের বেশি। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পদকসহ একাধিক সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘লালসালু’, ‘লালন’, ‘লিলিপুটরা বড়ো হবে’ এবং ‘রাবেয়া’র মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। ‘নদীর নাম মধুমতি’ তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত করেছে। গুণি এই বাউল সাধক ২০১২ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পদক। তার জীবন দর্শন, সাধনা, সংগীতজীবন, বর্তমান বাউল গান ইত্যাদি বিষয় জানতে -এর পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন পিয়াস মজিদ। ‘গাঁজায় ধোঁয়ায় মুখ ডুবাইয়া থাকলে লালনকে পাওয়া যাইবে না’ শিরোনামের সেই সাক্ষাৎকারটি থেকে জানতে পারি, বাংলা ১৩৩৮ সনে দক্ষিণ মানিকগঞ্জের পুটাইল ইউনিয়নের হাসলি গ্রামে জন্ম সাইদুর রহমান বয়াতীর। ‘আমার বাপ আমার ওস্তাদ’ বাবা জিকির আলী ব্যাপারীও ছিলেন গান পাগল মানুষ। বাবার সাথে ছোটবেলা থেকেই দোতরা বাজিয়ে গান গাইতেন। কবে যে নামের পিছনে বয়াতী বিশেষণটি যোগ হযয়েছে তা তিনি নিজেও জানেন না।

৯.

সাইদুর রহমান বয়াতী মনে করেন, জারি-সারিসহ অন্যান্য ধারার গান, বিলুপ্তপ্রায় পালাগানের ঐতিহ্যবাহী ধারাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। সাইদুর রহমান বয়াতি বাংলাদেশের কবিগানের, পালার গুরু বন্দনা, পাঁচালির রূপবৈচিত্র্য ও পরিবেশনার আঙ্গিকও ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন সময়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গান লিখেছেন, গেয়েছেনও। আবার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছেন। সে সময়কার ভূমিকা বিষয়ে সাইদুর রহমান বয়াতীর ভাষ্য, আমার দোকান হইয়া উঠলো মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র। আবার রাতের আন্ধারে গান বানতাম- মুক্তিসেনার নিশান তোলে/আয় ছুটি বাঙালি ভাই/শিলাবৃষ্টি ঝড়-বাদলের কেনো চিন্তা নাই। কতবার যে পাক আর্মি, রাজাকারদের সামনে পড়ছি। উর্দু জানার কারণে মুক্তি পাইছি। যুদ্ধে আমার পালিত ভাই জামাল শহীদ হয়। অনেকে কইল, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট লইতে, লইলাম না। কী হইব? যখন দেখি রাজাকার, আল-বদর মুক্তিযোদ্ধা বেশে রাস্তা ঘাটে ঘুরাফেরা করে তখন মনে হয় সার্টিফিকেট না নিয়ে দোষ করি নাই। দেহ-মন, জগৎ-সৃষ্টিকর্তা-এই বিষয়গুলো নিয়ে এই মরমী সাধকের ব্যাখ্যাটা এ রকম, দেহ হইলো পুতুল। অর্থাৎ দৃশ্যমান জিনিসটা। যেমন দেহের মধ্যে আছে হাড়, রগ, মগজ, চামড়া, চুল, গোশত। এ ছাড়া আছে আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস। দেহ তৈরি করার জন্য আরো আছে দর্শন, শ্রবণ, অনুভব, আস্বাদন, চলনশক্তি-এগুলো পরমসত্ত্বার অংশ। এই সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠন হয় দেহ। এই যে গঠনগুলোর কথা বললাম এগুলোর যে কোনো একটি বিশ্বাস করলে সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করতে হয়। তাহলে নাস্তিকতা কীভাবে হয়? আসলে নাস্তিকতা বলতে কিছু নাই। আর মন নফসের মাধ্যমে গঠিত হয়। নফস আবার ৫ প্রকার। এক. সৎ পথে পরিচালনা, দুই. অসৎ পথ থেকে দূরে থাকা, তিন. শ্রবণ, চার. হাটানো, পাঁচ. বলন। আবার আরবিতে আছে পঞ্চ আত্মা যেমন নাফাদি, জামাদি, হায়ানি, ইনসান, কুরসি। বাংলায় বলা হয় জীবাত্মা, পরমাত্মা, বোধাত্মা, প্রেতাত্মা, আত্মারামেশ্বর-এগুলো নিয়ে মন। বিচিত্র অভিজ্ঞতাময় জীবনে সাইদুর রহমান বয়াতী কতো কিছুই তো দেখলেন, জানলেন এই দুনিয়ায়। তাঁর জীবনদর্শন হয়ে ওঠে মানবতা। বলছেন, আমি বিশ্বাস করি এক পরমেশ্বরে। তাকে কেউ আল্লাহ বলে, কেউ কয় গড বা যিশু, কেউ কয় হরি, কিন্তু তিনি আসলে একজনই। তাঁর ভাষায়, ‘আমি মনে করি আল্লাহকে পাইতে হইলে আকাশে-বাতাসে ঘুরতে হয় না, নিজেরে চিনতে হয়। আত্মপরিচয়ের দেখা মেলাই বড় কাজ। এই দুনিয়ায় সকলেই ব্যস্ত টাকা-পয়সা লইয়া।’ তিনি আরো বলছেনন, আমি মনে করি মানুষের দেহই তার বড়ো ধন। দেহের নিয়ন্ত্রণ করাটাও সাধনার কাজ। আমি পরমের সন্ধানে আছি। পরমকে পাইতে আকাশে বাতাসে ঘুরতে হয় না। এখন এটা বুঝ্যা গেছি। সবার আগে নিজেরে চিনতে হয়। বলছেন, ‘একটাই আশা গানের মধ্য দিয়া আপনাদের মনের সুখ-দু:খ-হাসি-কান্না ফুটাইয়া তোলা’।

১০.

বাংলা কবিতার অন্যতম কিংবদন্তি কবি শহীদ কাদরী। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান আধুনিক কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত শহীদ কাদরী (জন্ম: ১৪ আগস্ট, ১৯৪২ -  প্রয়াণ: ২৮ আগস্ট, ২০১৬ )। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র কবি শহীদ কাদরী বাংলা কবিতায় নিজম্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করেছেন। শহীদ কাদরী যুগ ব্যবধানে ফুরিয়ে যাননি। বেঁচে আছেন কবিতার শাশ্বত ভাষায়। বেঁচে থাকবেন কবিজীবনের বোহেমিয়ানপনায়। দুরন্তপনায়। শহীদ কাদরী লিখেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু লিখেছেন খুবই অল্প। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চার। এই চারটি গ্রন্থে কবিতা রয়েছে ১৫০টির মতো। আবার গ্রন্থ চারটির প্রকাশকাল দেখেও আমরা বিস্মিত হই। প্রথমটি অর্থাৎ উত্তরাধিকার প্রকাশিত হয় কবির ২৫ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে। দ্বিতীয়টি অর্থাৎ তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় কোথাও কোন ক্রন্দন নেই নামক গ্রন্থ। এর প্রায় ৩০ বছর পরে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হলো আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও গ্রন্থটি। তাঁর কবিতার সংখ্যা, গ্রন্থের সংখ্যা আর এক গ্রন্থ থেকে অন্য গ্রন্থের মধ্যে ব্যবধান আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় কবির প্রতি, সেইসঙ্গে আফসোসও হয়, কবি আরো কেন ভরিয়ে দিলেন না তাঁর সৃজনের উঠোন-বারান্দা। অবশ্য একজন কবির সৃষ্টি-সংখ্যা দিয়ে তাঁর কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তাঁর সৃষ্টিটাই আসল। বিরলপ্রজ কবিদের ধারায় অনন্য সংযোজন বলতে পারি শহীদ কাদরীকে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে সংখ্যার একটা প্রচলিত ব্যাপার থাকলেও শহীদ কাদরী তাতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন লেখকের প্রধান কথাগুলো বলে ফেলবার জন্যে ৫০-৬০টি গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘সাধারণত দেখা যায় কি, লেখকেরা তাদের প্রধান লেখাগুলোর পর সব পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।’ একথা সত্য যে, শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা পুনরাবৃত্তি পাই না। এক গ্রন্থ থেকে আরেক গ্রন্থে থেকেছে চিন্তার নতুনত্ব। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিশেষ বাঁকবদল। বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের একজন শহীদ কাদরী স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। প্রয়াত হন সেদেশেই। সেই প্রিয় কবি শহীদ কাদরীর স্ত্রী নীরা কাদরীর বিনয়ী উচ্চারণ ‘শহীদ এই ভালোবাসার মধ্য দিয়েই বেঁচে রইবেন’। নীরা কাদরী প্রয়াত কবি শহীদ কাদরীর সাথে দেখা হওয়ার স্মৃতির মেঘে ভেসে গিয়ে জানাচ্ছেন, ‘খুব সম্ভবত ২০০৩ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে; শহীদ তখন নিউইয়র্কে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসেছে। আর দশটা মানুষের মতোই সাধারণ মানুষ তিনি। কবি শহীদ কাদরী, আমি যেটা বার বার দেখেছি, অনেক বেশি পড়াশোনার মধ্যে থাকতেন। লেখার চাইতেও পড়াটা গুরুত্ব দিতেন বেশি। সব সময় নতুন কিছু জানার চেষ্টা করতেন। বলতেন, সবই তো লেখা হয়ে গেছে, নতুন কিছু করা বেশ কঠিন। এখন যদি নতুন কোনো ফর্ম আনা যায়, তাহলে সেটা চেষ্টা করতে হবে। তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন; বলতেন, বিজ্ঞানে যদি নতুন কিছু আবিষ্কার হয়, তাহলে হয়ত আমরা তার সঙ্গে নতুন কিছু পাবো। এছাড়া নতুন বিষয়বস্তু আনা খুব কঠিন। চর্বিতচর্বণ করে তো লাভ নাই।’

১১.

নীরা কাদরী বলছেন, ‘শেষদিকে সাহিত্যে নতুন কিছু আনা তাঁর নিত্য সাধনা ছিল। রিপিটেশন একদম চাইতেন না। অনেক কিছু তাঁর মাথায় আসত, তিনি সেটা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতেন; বলতেন, এটা লেখা হয়ে গেছে। খুবই খুঁতখুঁতে এবং সিলেক্টিভ ছিলেন। কবিতা যখন লিখতেন, কোনো কাটাকাটি থাকত না। আমি বলতাম, তোমার কবিতায় কোনো কাটাকাটি নেই যে। তিনি বলতেন, নীরা কবিতা তো কাটাকাটি করলাম মাথায়- সাতদিন ধরে! যেমন শহীদের একটা কবিতা একেবারে নতুন ফর্মে, পাঠক জানেন, শেষ লাইনটা শুধু বলি: জলে পড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন। এটা একেবারে নতুন। আরো অনেক কবিতা আছে পূর্বে লেখা, যেটা তিনি নতুন আঙ্গিকে লিখেছেন।’ নীরা কাদরীর কণ্ঠস্বরে অবিচল উচ্চারণ, ‘বুদ্ধদেবের যে জীবনদর্শন, তাঁর যে সমালোচনা সাহিত্য ও সাহিত্যচোখ এটা দ্বারা প্রভাবিত তো বটেই, তাঁর সমগ্র রচনা দ্বারা প্রভাবিত। ওরা কিন্তু ওদের নিজস্বতা নিয়েই বের হয়ে এসেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা আর শহীদ কাদরীদের কবিতা আলাদা। শহীদ বলতেন, আমাদের কবিতা আলাদা হবেই, কারণ আমাদের আন্দোলনগুলো আলাদা, আমাদের ইতিহাস আলাদা। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের যুক্তফ্রন্ট, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এগুলো আমাদের সাহিত্যকে আলাদা পথে চালিত করেছে।… বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তিনি না থাকলে আমরা আমাদের এই দেশটি পেতাম না। আমাদের কোনো নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি হতো না। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু- এর বাইরে কিছু না। এটা সবসময় শহীদ বলতেন। বলতেন, অনেক কিছু চেষ্টা করা হবে। কোনো লাভ নেই। বঙ্গবন্ধু থাকবেনই।’

১২.

আবারো পিয়াস মজিদ-এর ‘সাক্ষাৎকার ১৭’ গ্রন্থের বহুল পাঠ, প্রচার ও আলোচনা কামনা করছি। আমার মতোন জীবনীর প্রতি সবিশেষ আগ্রহী পাঠকের আগ্রহ, উৎসাহকে ঋদ্ধতর করে তোলা গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য প্রিয় পিয়াস মজিদ-এর প্রতি রইল সবিশেষ কৃতজ্ঞতা, আন্তরিক ধন্যবাদ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।