‘যুদ্ধটা’ প্রতুষ্যেই শুরু করেন ডা. প্রত্যুষ

আলাউদ্দিন আলিফ, বান্দরবান থেকে
| আপডেট : ০৯ মে ২০২০, ১৪:২৯ | প্রকাশিত : ০৯ মে ২০২০, ১৩:৩৮

নামের সঙ্গে অবিচার করেননি ডা. প্রত্যুষ পল ত্রিপুরা। প্রতিদিন প্রত্যুষেই ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। এরপর শুরু হয় তার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ অজানা এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে। পার্বত্য জেলা বান্দরবানে করোনা মোকাবেলায় গড়ে তোলা ১০০ শয্যার আইসোলেশন বিভাগের প্রধান তিনি। জেলা সদর হাসপাতালের জুনিয়র এই কনসাল্টেন্ট এখন বান্দরবানে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সেনাপতি। চিকিৎসা সামগ্রীসহ সকল ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কখনো জেলা পরিষদ, কখনো সিভিল সার্জন কার্যালয়, কখনো পৌরসভায় নিজ উদ্যোগে ছুটে গেছেন তিনি। রোগীদের সুবিধার কথা ভেবে নার্সিং কলেজের দ্বিতীয় তলাতেই ব্যবস্থা করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের। তাদের থাকা-খাওয়াসহ সার্বিক বিষয়ে খেয়াল রাখছেন প্রতিনিয়ত। কখনো কখনো নিজের পকেটের টাকায় কিনে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সন্দেহজনক কোন রোগীর কথা শুনলে ছুটে যাচ্ছেন নিজেই।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি কাজে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। তবে করোনার সম্মুখ যোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীরাই। পর্দার আড়ালে কাজ করে যাওয়া এই করোনা যোদ্ধাদের মধ্যে দুএকজন আছেন যারা নজির স্থাপন করে চলছেন। তেমনই একজন বান্দরবান সদর হাসপাতালের চিকিৎসক প্রত্যুষ পল ত্রিপুরা। তিনি বান্দরবানে করোনা রোগীদের জন্য তৈরি করা ১০০ শয্যার আইসোলেশন বিভাগের প্রধান। এই আইসোলেশন বিভাগ তৈরির পর থেকে টানা এক মাস ধরে হাসপাতালেই অবস্থান করছেন এ যোদ্ধা। করোনার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগী, কভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীসহ আইসোলেশন বিভাগে কর্মরত সকল চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে সামনে থেকে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন ডা. প্রত্যুষ।

বান্দরবান হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ সীমিত সরঞ্জাম দিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একরকম শূন্যহাতে বান্দরবান হাসপাতালের চিকিৎসকরা শুধু সাহস আর সেবার মনোবল নিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ পার করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগী আইসোলেশন ফ্লু কর্নার এ চিকিৎসা নিয়েছেন।

হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ১০৪ জন সন্দেহভাজন রোগীর করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা ২১ জন চিকিৎসা সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। বর্তমানে নার্সিং কলেজের আইসোলেশনে ভর্তি আছে ৪ জন। এর মধ্যে দুজন করোনা আক্রান্ত। বান্দরবান জেলায় এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ জন।

করোনা সংক্রমন শুরু হওয়ার পর বান্দরবান হাসপাতাল সংলগ্ন নার্সিং কলেজকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ১০০ শয্যার আইসোলেশন বেড তৈরি করা থেকে শুরু করে রোগীদের পরিচর্যা খাবার চিকিৎসক, সেবিকা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখাশোনা, যাতায়াত থেকে শুরু করে সবকাজ একাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে করে যাচ্ছেন ডা. প্রত্যুষ পল।

সবাই যখন করোনার আতঙ্কে পরিবার পরিজন নিয়ে বাসায় অবস্থান করছেন ঠিক তখন পরিবার পরিজন ছেড়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালের করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ডা. প্রত্যুষ পল জানান, করোনা বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করেছে। এটা একটা নতুন ধরনের ভাইরাস। এর সাথে সবাই পরিচিত নয়। ইতোমধ্যে অনেক চিকিৎসকরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাই সবাই শঙ্কায় দিন পার করছেন। অনেকের আসলে এটা সম্পর্কে ধারণা নেই যে, কীভাবে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিবে। আমি আইসোলেশন ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছি। করোনা সম্পর্কে ট্রেনিং নিয়ে এসেছি। তাই সবাইকে এটা সম্পর্কে ধারণা দিতে হচ্ছে। চিকিৎসক, সেবিকা, এমনকি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কর্মীকেও শিখিয়ে দিতে হচ্ছে কীভাবে আক্রান্ত রোগীর সাথে মিশতে হবে, খাবার বা ওষুধ দিতে হবে। তাদের সাহস দেয়ার জন্য আমি নিজে সব করেছি যাতে তারা ভয় না পায়।

এতকিছু করেও এটাকে অতিরিক্ত কিছু মনে করেন না এই চিকিৎসক। এটাকে নিজের দায়িত্বই মনে করেন তিনি। তার কথায়, ‘আমরা চিকিৎসক। সেবার জন্য আমাদের কাছে আসবে । তাই আমরা আমাদের সাধ্যমত সেবা করার চেষ্টা করছি। ১০০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরী করেছি। এখানে করোনা আক্রান্ত রোগী রয়েছে। তাই কীভাবে নিজেদের রক্ষা করে রোগীদের সেবা করবে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী (পিপিই) কীভাবে পরবে সেগুলো তাদের দেখিয়ে দিচ্ছি। কোন রোগীদের খাবারের সমস্যা হলে তা জোগাড় করার চেষ্টা করছি। মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমার নিজের কোন ভয় নেই। তবে পরিবারের জন্য ভয় হয়, তাই তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাসায় হাসপাতালেই থাকছি।

এই চিকিৎসকের প্ররিশ্রমের কথা জানেন বান্দরবান সিভিল সার্জন ডাক্তার অংশৈ প্রু মার্মাও। জেলা সদর হাসপাতালে পর্যাপ্ত জনবল ও চিকিৎসা সামগ্রী নেই তা স্বীকার করে নিয়েই তিনি বলেন, ‘যেটুকু আছে সেটুকু দিয়ে আমার চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। করোনা রোগীদের নিয়ে ডা. প্রত্যুষ পল এবং ডা. আলমগীর উদয় অস্ত নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। যখনই রোগীর আগমন হচ্ছে তখনই প্রত্যুষ হাজির হচ্ছেন। শুধু প্রত্যুষ ই নন, ডা. আলমগীরও বেশ প্রশংসনীয় কাজ করছেন। করোনা সন্দেহের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে রিপোর্ট পাঠানো পর্যন্ত সব কাজ সম্পাদনে তারা বেশ আন্তরিক।

চিকিৎসকরা সবাই ফ্রন্টলাইনে থেকে যুদ্ধ করছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তবে আইসোলেশন ওয়ার্ডে যেহেতু করোনা আক্রান্ত রোগী আছেন সেহেতু চিকিৎসকরা সেখানে অধিক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। সব চিকিৎসকরা সাত দিন ডিউটি করার পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকছেন কিন্তু প্রত্যুষ পল নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি কোন ছুটি নিচ্ছেন না।’

পরিবার-পরিজন ছেড়ে করোনামোকাবেলায় হাসপাতালে এভাবে সময় দেয়ার জন্য ডা. প্রত্যুষ এবং ডা. আলমগীরকে সাধুবাদও জানালেন ডা. অংশৈ প্রু মার্মা। সঙ্গে মৌখিক ‘প্রশংসাপত্র’, তারা (ডা. প্রত্যুষ এবং ডা. আলমগীর) খুবই পরিশ্রমী। কভিড-১৯ রোগীদের সেবায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। সম্মুখ সাড়ির এই যোদ্ধারা একদিন যুদ্ধ জয় করে পরিবারের কাছে ফিরবেন, তখন হয়তো এই ‘প্রশংসাপত্র’ই হবে তাদের ভবিষ্যতে চলার পথে পাথেয়।

(ঢাকটাইমস/৯‌মে/এ‌জেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

স্বাস্থ্য এর সর্বশেষ

ঔষধি গাছ থেকে তিন শতাধিক ওষুধ তৈরি হচ্ছে ইরানে

কণ্ঠের সব চিকিৎসা দেশেই রয়েছে, বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই: বিএসএমএমইউ উপাচার্য 

এপ্রিল থেকেই ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম শুরু, মার্চের মধ্যে টিকা নেওয়ার সুপারিশ গবেষকদের

স্বাস্থ্য খাতে নতুন অশনি সংকেত অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ভাতা বাড়লো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের

বিএসএমএমইউ বহির্বিভাগ ৪ দিন বন্ধ, খোলা থাকবে ইনডোর ও জরুরি বিভাগ

তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

বিএসএমএমইউতে বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে: ভিসি দীন মোহাম্মদ

ঈদের ছুটিতে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে যেসব নির্দেশনা মানতে হবে হাসপাতালগুলোকে

কেন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :