স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত কি খাদের কিনারায় নিয়ে যাবে আমাদের?

প্রকাশ | ১০ মে ২০২০, ১১:১১

আরিফুর রহমান দোলন

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত প্রচুর রোগী সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছেন। সংশ্লিষ্ট সকল চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে এক্ষেত্রে। এর পাশাপাশি কারোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ রেমডিসিভির উৎপাদন করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যাল। যা আমাদের আরও বেশি আশান্বিত করছে। এঁদের সবাইকে শত কোটি অভিনন্দন। তবে আক্রান্ত বাড়ছে। মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। লকডাউনের এই পর্যায়ে এসে সারা দেশে করোনা পরিস্থিতি যথেষ্টই অস্থির। কারণ নতুন নতুন এলাকায় সংক্রমণ হচ্ছে। যে উদ্বেগ দানা বেঁধেছে তার নিরসন সহজ হচ্ছে না। চিন্তিত সরকারি প্রশাসন। শঙ্কিত জনগণ।

সরকারের রক্তচাপ এবং সাধারণ মানুষের ভয় আরও বেড়ে যাওয়ার কথা চারপাশের নানা খবরে। গণমাধ্যম ও সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নানা খবর, ছবি। সরকারি নির্দেশনা মানছে না হাসপাতাল। ঘুরে ঘুরে রাস্তাতেই মারা যাচ্ছে রোগী। এগুলো কতখানি সত্য, তার বিচার-বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই দরকার আছে। কিন্তু যা রটে, তার কিছু না কিছু বটে- এই প্রবাদ মনে রাখলে সব উড়িয়ে দেওয়াও সঙ্গত হবে না। এসব সূত্রেই ক্রমশ যেটি প্রকাশ্যে আসছে তাহলো একাধিক করোনা হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালের পরিষেবায় বড়সড় গলদ রয়েছে।

বড় কোনো কাজ সবকিছু নিখুঁত, পরিপাটি, ছিমছাম হওয়া কার্যত অসম্ভব। করোনা মোকাবিলার মহাযজ্ঞে এটি আরও বেশি প্রযোজ্য। সর্বোপরি এরকম পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনও অভিজ্ঞতা না থাকায় আগাম যুৎসই প্রস্তুতির সুযোগও ছিল না। বাংলাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বের জন্যই এটি সত্য।

কিন্তু সরকারি কিছু সিদ্ধান্ত এমনভাবে নেওয়া হচ্ছে যেখানে পারস্পারিক স্বার্থের সংঘাত খুবই দৃশ্যমান। সিদ্ধান্তগুলো অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধী। আর এই স্ববিরোধী সিদ্ধান্তগুলোই করোনাকাণ্ডে আমাদের খাদের কিনারায় নিয়ে যেতে পারে।

সরকারিভাবে ছুটি বলবৎ আছে ১৬ মে পর্যন্ত। সারাদেশে জাতীয়ভাবে ও জেলা পর্যায়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী সরকার মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ করছে বার বার। বলা হচ্ছে মে মাস আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকির মাস। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমে সরকার সিদ্ধান্ত দিল সীমিত পরিসরে গার্মেন্টস খোলা যাবে। শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি মানতে হবে। করোনার হট স্পট খ্যাত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ আর গাজীপুরের গার্মেন্টস রাতারাতি খুলেছে। শারীরিক দূরত্বের সীমানাকে থোড়াই কেয়ার করে সারা দেশের গ্রামগুলো থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার যে দৃশ্য আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি তা অভাবনীয়। ঈদে বাড়ি থেকে ফেরার দৃশ্যকেও হার মানায় এসব দৃশ্য। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও তাঁর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন গার্মেন্টস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। করোনাকাণ্ডে সরকারের গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন, গার্মেন্টস খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যখন এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর তখন আরো দুটি ঘোষণা এলো সরকারের পক্ষ থেকে। সামাজিক দূরত্বের শর্ত মেনে মসজিদে নামাজ পড়া যাবে। আর ১০ মে থেকে ঈদ ও রোজা উপলক্ষে বিপনী বিতানও খোলা যাবে।

একদিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান আরেকদিকে বিপনী বিতান খুলে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার উৎসাহ। এই স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত কেন? এ যেন রীতিমতো বজ্র আটুনি ফসকা গেরো নীতি!

দেশের বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ অধিক পরিচিত মসজিদগুলোতে শারীরিক দূরত্ব মেনে নামাজ পড়ার দৃশ্য দেখলেও অধিকাংশ মসজিদে বিপরীত দৃশ্য আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। মাস্ক পরে গার্মেন্টস কর্মীরা কাজে যাচ্ছেন বটে। কিন্তু যেভাবে তারা দল বেঁধে সারিবদ্ধভাবে চলাফেরা করছেন তাতে গায়ে গা ঠেসে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখে চিকিৎসকরা গভীরভাবে চিন্তিত। সামাজিকভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঠিক তখনই সবকিছু এইভাবে শিথিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতখানি যৌক্তিক এ নিয়ে নানা প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে আছে। বাজার হাত ছাড়া হওয়ার ভয় দেখিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা যেভাবে কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বাধ্য করলো এবং সরকারও নতজানু হয়ে সব মেনে নিলো তা নজিরবিহীন।

অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক যেভাবে মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করে সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার সুযোগ কার্যত নেই। তাই তাদের কেউ একজন কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে মুহূর্তের মধ্যে গোষ্ঠী সংক্রমণ নিশ্চিত-এই আশঙ্কা অমূলক নয়। এ নিয়ে ভীতি সব মহলে। আরও কটা দিন দেখে ঈদের ছুটির পর গার্মেন্টস খোলা যেতোনা? তাতে কি সত্যিই বাজার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়তো?

ঈদ মানে তো খুশি। সেই খুশির আমেজ এখন আছে? না-কি সার্বক্ষণিক এক ভীতি, শঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করছি আমরা। সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকাটাই এখন মুখ্য। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে ঈদের নাম করে বিপনী বিতান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের মানে খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। সরকারি ছুটি বহাল রেখে মানুষকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার এই কৌশলী আহবান কী প্রমাণ করে? কোভিড-১৯ থেকে দূরে থাকতে নাগরিকদের সামাজিক দূরত্বে রাখার নীতি নেওয়ায় সরকারের অবস্থান স্ববিরোধী। আর সরকারের এই নীতি করোনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে, এমনটাই মনে হচ্ছে।

এর মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের একাধিক সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালে ভর্তির ডামাডোল থেকে শুরু করে রোগীদের পরিচর্যার বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অভিযোগ ও সমালোচনা ক্রমশ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে প্রশাসনের পক্ষে তা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। এসবের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন, চক্রান্ত, ভুয়ো রটনাসহ যে তত্ত্বই দেওয়া হোক না কেনো অধিকাংশ মানুষকেই তা মানানো যাবে না। ফলে সরকারের বহুমুখী প্রয়াস, সদিচ্ছাকে ছাপিয়ে নেতিবাচক ধারনা সমান্তরালভাবে কাজ করছে। এক সময় বিরোধীরা এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে।

সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের অসন্তোষ দীর্ঘকালের। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একাংশের বিরুদ্ধেও অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনেবৃত্তি, চিকিৎসায় অবহেলা, দুর্ব্যবহার ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। যদিও বর্তমান সরকারের গত কয় মেয়াদে সরকারের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নানাভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু চেহারা বদল হলেই স্বভাব কি রাতারাতি বদলায়! ত্রুটিপূর্ণ পিপিই, মাস্কসহ নানা দুর্বলতার কথা কান পাতলেই যে শোনা যাচ্ছে। আর এসব নিয়েই আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা!

করোনা সংকটে হাসপাতাল নির্ভরতা সর্বাধিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বহুগুণ বেড়েছে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ওপর। মরা বাঁচা যাদের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল, যে রোগ থেকে মুক্তির সুনির্দিষ্ট রাস্তা এখনো অজানা সেখানে হাসপাতালগুলোকে সাধারণ মানুষ আঁকড়ে ধরবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিষেবা নিয়ে যা শোনা যাচ্ছে তাতে সন্তুষ্টির জায়গা কতখানি?

এটা যে কেউই মানবেন, যে কোনো সরকারই চায় না তার আমলে মানুষ মরুক দলে দলে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজস্ব পরিকাঠামোর সর্বোচ্চটাই সরকার কাজে লাগাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যবস্থার ভেতরে যদি ফাঁকফোঁকর, গলদ, অদক্ষতা, সিদ্ধান্তহীনতা বা স্ববিরোধিতা থাকে? সদিচ্ছা তখন ধাক্কা খাবেই।

ক্ষমতায় থাকলে দায় নিতে হয়। তাই পক্ষে-বিপক্ষে যা হবে সরকারকে সেটি মানতে হবে। মানুষের ক্ষোভ, অভিযোগ অনুযায়ী সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেন, নেবেন।

এই পরিস্থিতিতে আমরা যারা ‘জনগণ’ তাদের ভূমিকাও প্রনিধানযোগ্য। বিরোধিতা এবং পারস্পরিক সমালোচনায় আমরা যতখানি সরব, সক্রিয়-নিজেদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কি ততখানি সচেতন আমরা? করোনা যুদ্ধে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছি তো?

হাসপাতালের বেহাল দশায় আমরা ক্ষুব্ধ। চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করছি। সরকারের বিপরীতমুখী নীতি নিয়েও কঠোর সমালোচনা করছি। কিন্তু নিজের কর্তব্য ঠিকমতো করছি তো! লকডাউনকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে দলে দলে কেনাকাটায় বেরিয়ে যাচ্ছি এই আমরাই। অবরোধ আর প্রতিবাদ সভা হচ্ছে, মুখে মাস্কের বালাই নেই। কে রুখবে আমাদের! ফেরিঘাটগুলোতে যে হাজারো মানুষের ভিড়, সামাজিক দূরত্বের সব নিয়ম নীতি শিকেয় তুলে যা খুশি, যেভাবে খুশি চলাফেরার প্রবণতা এ ও এক ধরনের অপরাধ।

প্রতিদিন ঝুঁকির বহর বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের জনগণেরও সমান দায় আছে। লকডাউন চলাকালীন এসব খন্ডচিত্রই আগামীতে নানা অশনিসংকেত ঘটনার ইঙ্গিতবাহী। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে আমরা যে এখনো খুবই দায়সারা মনোভাব দেখাই পদে পদে সেই প্রমাণও মিলছে। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সব মানাতে হবে, এই নীতিও কিন্তু দীর্ঘ সময়ে ভালো ফল দেয় না, দেবে না। সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তে যেমন স্ববিরোধিতা আছে তেমনি স্ববিরোধিতা আছে আমাদের জনগণের মধ্যেও। দু’পক্ষেই দরকার আরও বেশি সচেতনতা, সতর্কতা। নাহলে এই স্ববিরোধিতাই আমাদের আরও খাদের কিনারায় নিয়ে যাবে।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।