করোনা ভাইরাস পূণর্বাসন কার্যক্রমে প্রবীণদের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করুন

মিজানুর রহমান জুয়েল
| আপডেট : ১৩ মে ২০২০, ১৯:৫৩ | প্রকাশিত : ১৩ মে ২০২০, ১৮:২৩

সারা পৃথিবীতে বিরাজমান কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস থেকে প্রবীণ জনগোষ্ঠিকে সুরক্ষার কাজ করছে আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল’। হেল্প এইজের সিইও, জাস্টিন ডার্বিসায়ারের সম্প্রতি প্রকাশিত এই লেখায় ফুটে উঠেছে বিশ্বব্যাপী প্রবীণদের সুরক্ষা ও পূণর্বাসন কার্যক্রমের এই জনগোষ্ঠির অন্তুর্ভূক্তি নিশ্চত করণের বিষয়টি।

বাংলাদেশের কক্সবাজারের উপকূলে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বাস করেন ৬২ বছরের জাফর আলম। স্বাভাবিক সময়গুলিতে চা ও বিস্কুট বিক্রি করে দৈনিক ৫০০ টাকা উপার্জন করেন জাফর, কিন্তু দেশে এপ্রিল মাসে লকডাউন জারি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও উপার্জন করতে পারেননি।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে বয়সের ভারে ন্যুজ্য জাফর বলে উঠে “করোনায় আক্রান্তের পূর্বে না খেয়েও আমরা মরতে পারি, আমাদের কি বেঁচে থাকবার অধিকার নেই”

দৈনন্দিন উপার্জনের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও অপ্রাপ্যতা তার নিত্য দিনের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকাংশে। লকডাউন শুরু হবার পূর্বে জাফর তার পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারেনি আর তাই কিভাবে বর্তমানে স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনের খাওয়ার ব্যবস্থা করবে তা নিয়ে সে ভীষণ উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত।

লক-ডাউনের ফলে উন্নত দেশগুলোতে নিম্ন-আয়ের মানুষদের অর্থনৈতিক ঝুঁকি বেড়েছে পক্ষান্তরে স্বল্প-আয়ের দেশগুলোর প্রবীণ জনগোষ্ঠির জন্য লকডাউন বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে দেখা দিয়েছে। যদিও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য এ সময় তাদের ঘরে থাকার কথা, কিন্তু জীবিকার তাগিদে ও প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহের জন্য তাদের ঘরের বাইরে বের হতে হচ্ছে।

জাফরের মতো এমন সংগ্রামের গল্প করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা পৃথিবীতেই শোনা যাবে। এটা সত্য যে, বয়স্ক জনগোষ্ঠি সর্বদাই স্বল্প-আয়ের দেশগুলোতে ঝুঁকিতে থাকে কিন্তু কোভিড-১৯ পূর্বে বিরাজমান বৈষম্য, বঞ্চনা, বৃদ্ধ জীবনের জীর্নতাসহ মানবিক সহায়তা পাবার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সমূহ বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের গত মাসের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ অতি দরিদ্রের সীমানায় পৌছাবে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যাদি বিশ্লষণ পূর্বক হেল্প এইজ মনে করছে যে, শুধুমাত্র সাব-সাহারার আফ্রিকান দেশগুলিতে এই মহামারির কারণে ১.৬ থেকে ২.৩ মিলিয়নের অধিক প্রবীণ জনগোষ্টি কর্মহীন ও নি:স্ব হয়ে পড়বে।

প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, যে সকল প্রবীণ জনগোষ্ঠি ‘প্যানশন’ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা হয়তো কোভিড-১৯ এর কারণে আর কখনও তাদের আয়ের ও জীবন যাত্রার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে না। বাজার-ঘাট বন্ধ থাকার ফলে যে সকল প্রবীণ জনগোষ্ঠি ফুড ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে তাঁরা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের উৎকন্ঠা বেড়ে গেছে যে, তারা কি তাদের সন্তানদের ভরণ-পোষণ করবে নাকি বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাঁচাবে। এতে পরিবারে বসবাসরত বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মানসিক চাপ, উৎকন্ঠা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধ পিতা মাতা পরিবারে নিজেদেরকে বোঝা মনে করছে।

সম্প্রতি হেল্প এইজ ইন্ডিয়ায় কর্মরত আমাদের এক সহকর্মী খাবার প্যাকেট বিতরণকালে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা তুলে ধরেন। খাবার গ্রহনের সময় একজন প্রবীন নাগরিক বলেন, “প্রথমবারের মতো অনেকদিন পর আমার পরিবার আমাকে ভালভাবে গ্রহণ করবে। উপার্জন করতে না পারায় আমাকে পরিবারে ‘বোঝা’ হিসেবে মনে করা হয়”।

বৈশ্বিক এই সংকটে পরিবারে বয়স্কদের প্রতি সহিংসতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। হেল্প এইজ ইন্ডিয়ায় হেলফ লাইনে কর্মরত স্টাফরা জানান, তারা আগের চেয়ে বেশি পারিবারিক সহিংসতার কল পাচ্ছেন।

স্বল্প-আয়ের দেশগুলোতে বয়স্ক জনগোষ্ঠির দারিদ্রতা বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বেশি যেটি কাজ করছে তা হলো ‘সোশ্যাল প্রটেকশন’ বা ‘সামাজিক নিরাপত্তার’ অভাব। বিশেষ করে অনেক দেশেই তা অনুপস্থিত।

সাব-সাহারা দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ২২ ভাগ সরকার এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ২৩ ভাগ সরকার প্রধান জনগোষ্ঠিকে ‘পেনশন সুবিধা’ প্রদান করে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো পৃথিবীর অনেক দেশেই কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রবীণ জনগোষ্ঠির জন্য কোনো কর্মসূচী গ্রহণ করেনি।

আমরা এমনও খবর পাচ্ছি যে, অনেক দেশে প্রবীণ মানুষেরা মোবাইল ফোন অথবা ইন্টারনেট সুবিধার অভাবে তাদের প্রাপ্য ‘সামাজিক ভাতা’ এবং ইমার্জেন্সী ক্যাশ ট্রান্সফার সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না। এমনকি লক-ডাউনের কারলে ব্যাংকে গিয়ে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না।

করোনা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠি স্বল্প-আয়ের দেশগুলোতে তাদের সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করেছে যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু প্রবীন জনগোষ্ঠি অনেক ক্ষেত্রেই এ সহায়তা পাচ্ছে না, যদিও তারা সর্বোচ্চ ঝুকিতে রয়েছে। আমরা যদি বৈশ্বিকভাবে সকলের জন্য পেনশন সুবিধা নিশ্চিত না করতে পারি এবং কোভিড-১৯ পুনর্বাসন কার্যক্রমে প্রবীণদের অন্তর্ভূক্ত না করতে পারি তাহলে লক্ষ লক্ষ প্রবীণ জনগোষ্ঠি দারিদ্রতা, নি:সঙ্গতা আর মৃত্যু ঝুঁকিতে উপনীত হবে।

এটা কোভিড-১৯ নয়, যা তাদের জীবনহানি ঘটাবে। বরং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবার অভাব, খাদ্য সঙ্কট, অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা এবং দাতব্য সংগঠনগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া- এ বিষয়গুলো তাদের মুত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।

মূলঃ জাস্টিন ডার্বিসায়ার, সিইও, হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল

ভাষান্তরঃ মিজানুর রহমান জুয়েল, উন্নয়ন কর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/১৩মে/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :