দেবেশ রায়: সাহিত্যের সারথি

হামীম কামরুল হক
| আপডেট : ১৫ মে ২০২০, ১৫:৫৮ | প্রকাশিত : ১৫ মে ২০২০, ১২:২৩

দেবেশদা নেই! জলের মিনার জেগে উঠল! শামীম রেজা খবরটা দিয়েছিল ১টা ৩৮ মিনিটে। আমাদের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতির ছাত্রী দিলশাদ চৌধুরী-ও জানিয়েছিল ১টা ৪৪-এ। দুটোই আমি পেলাম সকালে ঘুম থেকে উঠে। বলতে গেলে ভোরবেলায়ই ফেড্রিশ হোল্ডারলিনের কবিতার বই পড়তে ইন্টারনেটে হানা দিতে গিয়ে ফেসবুকটাও খুলি আর বজ্রাপাতের মতো লাগে এই খবরটা।

গতকাল আনিসুজ্জামান, আজ দেবেশ রায়ের মৃত্যুসংবাদ। ---কী লিখব বুঝতে পারছি না!

দেবেশ রায় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক কি গবেষক--- তাঁর মতে, অন্যরা তাঁকে যেভাবে নেবে তিনি তা-ই হবেন তাদের কাছে। এটা নিয়ে তাঁর কোনো মাথা ব্যধা নেই।

তাঁর লেখা কখনোই আরামদায়ক নয়। আলাপে জেনেছিলাম, নিজের সমসাময়িকদের মধ্যে তিনি পছন্দ করতেন মতি নন্দীর লেখা। সুনীল ও সন্দীপনও নিজেদের বন্ধু মতি নন্দীর লেখা তেমনটাই পছন্দ করতেন। বাংলাসাহিত্যের আরেকজন নন্দী, জ্যোতিরীন্দ্র নন্দীর প্রসঙ্গ এসেছিল তাঁর সঙ্গে আলাপে। দেবেশ রায় তখন বলেছিলেন, "জ্যোতিদা বেঁচে থাকতে তাঁর প্রতি তেমন সুবিচার করতে পারিনি, অথচ লেখক হিসেবে অনেক বড় ট্রিবিউট পাওয়া উচিত জ্যোতিদার।"

বহুবার দেখা হয়েছে। কত কী কথা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কথা বললে মনে হতো যেন কথা বলছি বাংলাসাহিত্যে সব কিংবদন্তির সঙ্গে। তাঁকে ছুঁয়ে যেন ছুঁয়েছি মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিকে। তিনি বলেছেন, বিভূতিকে তিনি আগে পড়লেও আবিষ্কার করেছেন পরে।

আমাদের ইনস্টিটিউটের জার্নালের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন একটি লেখা--- ‘‘সাহিত্য ও সংস্কৃতির তুলনামূলক পাঠ।’’ সেখানে কী নির্মমভাবে ভেঙে দিয়েছিলেন কয়েকটি বিষয়। এলেখা বোধ করি চূড়ান্তভাবে নস্যাৎ করে দিতে পারে পাশ্চাত্যের প্রতি সব মোহমুগ্ধতা। বলেছেন, যুক্তি তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে-- কেন গার্সিয়া মার্কেস বিভূতিভূষণের স্তরের লেখক, ততটাই তিনি বঙ্কিম কি কমলকুমারের মতো। উল্টে দিলেন তিনি। বিভূতিভূষণ পশ্চিমা কারো মতো নন, বরং তাঁর মতো কেউ কেউ আছেন। লিখেছেন, মার্কেসের মতো লেখকরা আমাদের বিভূতি কমলকুমার স্তরের লেখক। এবং ওই লেখার শেষ বাক্যটি ছিল---‘মার্কেস একজন বাংলা ভাষার লেখক।’ অদ্ভুত!

বাংলা উপন্যাস ও গল্পে নিজের স্থান বহু আগেই পোক্ত করেছিলেন। বাংলায় উপন্যাস চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি এখন অব্দি একক। অসীম রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার ও হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাস নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন, কিন্তু আস্ত বই লেখার কথা চিন্তা করেননি। সেখানে দেবেশ রায় তিনটি বই লিখেছেন, যেগুলির উপজীব্য হলো বাংলা উপন্যাসের সংকট এবং বইকটিতে দেখানো হয়েছে বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনাগুলিও।

ভেবেছেন বাংলা গদ্যের আদি অন্ত ও বর্তমান নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবনমিত ছিলেন চিরদিন। দিনে ১৫ ঘণ্টা পড়তেন, লিখতেন। একই বাসায় তিন জায়গায় তিন রকমের লেখা লেখার জায়গা ছিল বলে শুনেছি। ডাক্তারের নির্দেশে লেখাপড়া কমিয়ে আনলেও সেটি ১০ ঘণ্টার নিচে বলে নামানো সম্ভব হয়নি। পড়া কি পড়া--- পড়তেন মানে পড়ে শুষে ফেলতেন।

রুশ সাহিত্যের সব মাস্টার ছিলেন তাঁর পরমপ্রিয় পুশকিন, গোগল, তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্তি, তলস্তয়, চেখভ, শলোখভ আরও কত নাম। কেবল বিশ্বসাহিত্য নয়, সমস্ত ধরনের জ্ঞান বিদ্যায় আগ্রাসী আগ্রহ তাঁর। বলতেন,"সব ব্যাপারেই তো সাহেবদের চেয়ে পিছিয়ে আছি, তাই বলে জগৎ জীবন বোঝার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকব?"ফলে জগতের যেখানে যেকোনো ভাষার কোনো ভালো বই লেখা বেরিয়েছে জানলে সেটির ইংরেজি অনুবাদ বেরুনোর অধীর অপেক্ষায় থাকতেন, আর বের হওয়া মাত্র তা জোগাড় করে পড়ে শুষে ফেলতেন।

কত বিষয়ে আলাপ শুনেছি তাঁর। পরোক্ষভাবেও কত। আর পড়ার চেষ্টা করেছি তাঁর গল্প উপন্যাস আর গদ্যের বইগুলি। তিনি আমাদের সাহিত্যচেতনার অংশ। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্তত আমার নিজের সাহিত্যযাত্রার কথা কল্পনাও করি না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও গবেষক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :