এমপিদের কোণঠাসা করার চেষ্টা কার ইচ্ছেয়? কার লাভ?

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২০, ১৩:১৬ | আপডেট: ১৬ মে ২০২০, ১৫:৫৭

আরিফুর রহমান দোলন

জাতীয় সংসদের সদস্যদের (এমপি) কি হঠাৎ করে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হচ্ছে? রীতিমতো কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে? করোনাকাণ্ডের পর একের পর এক ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তাদের দাপট যতখানি দৃশ্যমান ঠিক ততটাই ম্রীয়মান করে দেওয়া হচ্ছে এমপিদের ভূমিকা। বিষয়টি কতখানি পরিকল্পিত তার চেয়েও বড় কথা হলো জাতীয় দুর্যোগে এমপিদের ভূমিকা খুব বেশি কার্যকর নয় জনসম্মুখে এই ধারনা দেওয়া হচ্ছে সরকারি নীতি নির্ধারণের মাধ্যমেই।
 
প্রথম অ্যান্টি ক্লাইমেক্স শুরু হয় জেলায় জেলায় সচিবদের ত্রাণ বিতরণ কর্মকাণ্ড সমন্বয় আর তদারকির দায়িত্ব দিয়ে। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, মন্ত্রী মর্যাদার চিফ হুইপ, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার হুইপ থাকা সত্ত্বেও জেলা পর্যায়ে সচিবদের এই দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বহীন করে দেখানো হয়। দ্বিতীয় অ্যান্টি ক্লাইমেক্স হলো, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ভাণ্ডার থেকে এমপিদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া ঈদের পোশাক বিতরণ করবেন জেলা প্রশাসকেরা এই সিদ্ধান্ত দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে চিঠি লিখে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট এমপিদের।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই মনে করেন, এমপিদের সাংগঠনিক দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে এভাবে পাশ কাটানো বুমেরাং হতে পারে। কারণ সরাসরি নির্বাচিত ৩০০ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০ সবমিলিয়ে ৩৫০ জন এমপির মধ্যে অধিকাংশ এমপি সক্রিয় এবং স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকায় তাদের রাজনৈতিক জমিও পাকাপোক্ত। নির্বাচিত তিনশ এমপির মধ্যে অন্তত শ’খানেক যারা রাজনীতির বাইরেও স্ব স্ব পেশায় জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও যথেষ্ট পরিচিতি। কিছু নিস্ক্রিয়, অনভিজ্ঞ এবং নেতিবাচক ভাবমূর্তির এমপি সাহেবদের শিক্ষা দিতে গিয়ে গড় পরতায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী, দাপুটে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে চলার এই প্রবণতা আদতে বিরাজনীতিকরণ তত্ত্বের কুশলীদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কোন অংশ কি-না এনিয়েও নানামুখী আলোচনা এখন শুরু হয়েছে।

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স উপেক্ষা, লঙ্ঘন করে রীতিমতো এমপিদের ‘তুচ্ছ’ করার যে প্রয়াস এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার পরিনাম বোধকরি সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা এখনো আঁচ করে উঠতে পারেননি। শুধু এটুকু বুঝতে পারা উচিত, সন্দেহ, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতার একটি পরিবেশ তৃণমূল পর্যায়ে দ্রুত সৃষ্টি হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে চলছে দোষারোপের পালা। জনপ্রিয়, দক্ষ, অভিজ্ঞ, যোগ্য অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্ব হতাশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন, বাধ্য হয়ে এবং নীতিনির্ধারকদের উপর্যুপরি উপেক্ষায়। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, সামগ্রিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় কারা আছেন এই প্রথম বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সরকারের ভেতর রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে অন্য কোনো শক্তির প্রভাব অধিকতর বেশি কি-না সেই প্রশ্নই এখন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দানা বেঁধেছে।
 
পদ, পদাধিকারীদের মর্যাদা, অবস্থান কি তা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স দ্বারা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী এমপিদের অবস্থান ১৩ নম্বরে। আর সচিবদের অবস্থান ১৬ নম্বরে। আর এই ১৩ নম্বরে অবস্থানকারী এমপিদের অনেকে একাধিকবারের জাঁদরেল মন্ত্রী, একাধিকবার নির্বাচিত এবং নানা ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে অভিজ্ঞও বটে। সেটি ভিন্ন কথা। রাষ্ট্র যেখানে সুস্পষ্টভাবে মর্যাদাক্রমে সচিবদের কয়েক ধাপ ওপরে এমপিদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে সেখানে প্রকাশ্যে এর ব্যতয় কোন যুক্তিতে? নির্বাচিত এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনেই কিন্তু সরকার গঠন হয়। সমসংখ্যক সচিবের সমর্থনে নিশ্চয়ই নয়। তাহলে এমপিদের এই অবহেলা, অবমূল্যায়নের হঠাৎ কারণ কি?

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। করোনাকালে মানিকগঞ্জ জেলার ত্রাণ বিতরণ কর্মকাণ্ড সমন্বয় ও তদারকির দায়িত্ব পেয়ে পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার কিভাবে সার্বভৌম সংসদের সদস্যদের কৌশলে হেয় করেছেন সেই বিষয়টি আর গোপন নেই। পানিসম্পদ সচিব জেলায় যে সমন্বয় সভা করেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যেখানে একটি ব্যানার করা হয়। ব্যানারে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে সর্বপ্রথম নামটি লেখা হয় সচিব কবির বিন আনোয়ারের। তার নিচে বিশেষ অতিথি হিসেবে সাংসদ নাইমুর রহমান দুর্জয় ও মমতাজ বেগমের নাম। অপর সাংসদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নাম আর ব্যানারে স্থান পায়নি।

চোখে আঙুল দিয়ে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিদের কি এটাই বুঝিয়ে দেওয়া যে এমপিরা মর্যাদারও তুচ্ছ সচিবের তুলনায়! কি বার্তা আসলে দেওয়া হচ্ছে? এর মাধ্যমে কি প্রকৃত সংগঠক, জননেতা, স্থানীয়ভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিটির মন খারাপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? আর এই মন খারাপ থেকে যদি অধিক সক্রিয়, উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিস্ক্রিয়, আধা নিস্ক্রিয় হয়ে যান তাহলে লাভ কার? নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যতটুকু ক্ষতি তার সিংহভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের। এই স্বেচ্ছায় নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়া নেতৃত্বের কিছু জায়গায় যথোপযুক্ত স্থানপূরণও কিন্তু অত সহজ হবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর সরাসরি সংস্পর্শে এসে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পেশাগত কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে নেতৃত্বের এই পর্যায়ে আসা ব্যক্তিত্বরা সব সময়েই আমাদের সম্পদ। উপযুক্ত মর্যাদা, পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতাকে কাজে লাগানোটাই বোধকরি যথার্থ।

কিন্তু হঠাৎ কি এমন হলো যে উপযুক্ত আর কম উপযুক্ত এমপিদের এক কাতারে নিয়ে আসা হলো এবং নানাভাবে উপযুক্তদের অপরিহার্যতাকে গৌন করে দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে। এতে শেষ বিচারে কতটুকু সুবিধা সরকার বা সরকারের মধ্যে যে রাজনৈতিক চালিকাশক্তি পাবে জানি না। কিন্তু এটুকু বেশ বুঝতে পারছি যে নিজ নিজ পেশায় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জনকারী যারা নিজের পেশাকে গৌন করে রাজনীতিকেই পরমব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন তারা অসহায়বোধ করছেন। এই অসহায়ত্বকে মানতে না পেরে নিজ নিজ অঙ্গনে স্বনামখ্যাত এই ব্যক্তিরা রাজনীতিবিমুখ হলে তাতে রাজনীতির কোনো লাভ হবে না।
 
আমাদের আমলাতন্ত্র নিশ্চয়ই যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সচিবরাও উপযুক্ত, দক্ষ। এসব নিয়ে কোনো সংশয় প্রকাশ করছিনা, করবোও না। কিন্তু নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজ সামলে জেলায় জেলায় ত্রাণ বিতরণ সমন্বয় ও তদারকির কাজটি তাদের জন্যও তো বোঝার ওপর শাকের আঁটি। চাইলেও কি জেলায় অবস্থান করে সচিবরা তাদের ওপরে আরোপিত দায়িত্ব সামলাতে পারছেন? একবার দু’বার জেলা সফর করে পুরো তদারকির কাজটি তাদের করতে হচ্ছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। লম্বা সময় জেলা, উপজেলায় অবস্থান করার সুযোগ আছে এমপিদের। গুটিকয়েক এমপি এই দুঃসময়ে চুপচাপ থাকলেও অধিকাংশ এমপিই কিন্তু নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয়। নিজস্ব উদ্যোগ ও বিত্তশালী শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় খাদ্য সামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে মানুষের পাশে আছেন এই রাজনৈতিক নেতৃত্বরাই। অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। প্রতিদিন গণমাধ্যমে কিছু খণ্ডচিত্র ফুঁটে উঠছেও।
 
একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। ৬৪ জেলার সমন্বয়, তদারকি, সার্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কি ৬৪ জন এমপি নাই? উত্তর, অবশ্যই আছে। প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক এমপি আছেন যারা সবভাবে যোগ্য। কিন্তু হঠাৎ করে এসে মনে হচ্ছে সার্বিকভাবে এমপিদের যোগ্যতা, দক্ষতায় বোধহয় ঘাটতি আছে এবং এক্ষেত্রে অধিকতর এগিয়ে সচিবরা। এমপিদের এভাবে নিস্ক্রিয় করে দিয়ে প্রকারন্তরে একটি সন্দেহ, অবিশ্বাসের সম্পর্ককে উসকে দেওয়া হয়েছে বুঝে অথবা না বুঝে। সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আমলাদের সুসম্পর্কের মাঝে হঠাৎ সন্দেহের এই দেওয়াল তৈরিতে কি কারো হাতে আছে?

তাই যদি না হবে তাহলে জেলায় জেলায় ত্রাণ বণ্টন সমন্বয়, তদারকিতে এমপিদের পরিবর্তে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ঈদ পোশাক বিতরণেও জেলা প্রশাসকদের একচেটিয়া প্রাধান্যের হেতু কি? এতদিন যে কাজটি এমপিরাই করে আসছেন সেখানে তাদের এভাবে সাইডলাইনে ফেলে দেওয়া কি খুব স্বাভাবিক ঘটনা? মোটেও না। এমপিরা কি দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করছেন না-কি তারা সবাই নিস্ক্রিয় হয়ে গেছেন? কোনোটিই না। বরং এমপিরা দায়িত্ব পালন করতে চাইছেন। কিন্তু নানাভাবে তাদের অবহেলা করার সুস্পষ্ট নজির পাওয়া যাচ্ছে। এটি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। যোগ্য এমপিদের বেশি করে কাজে লাগানো হোক। অযোগ্যদের সাইডলাইনে রাখা যেতে পারে। আর এভাবে প্রকৃত টিমওয়ার্ক গড়ে উঠুক। তাহলে তৃণমূল পর্যায়ে সংকট মোকাবিলা অধিকতর সহজ হবে। আর যদি কোনো বিরাজনীতিকরণের সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচিত সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধি এমপিদের দৃশ্যমানভাবে দুর্বল করে দেওয়া কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হয় তাহলেও সরকারের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক চালিকাশক্তিকেই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

যেভাবে যা হচ্ছে চারিদিকে তাতে স্পষ্ট বুঝতে পারছি এমপিদের মন ভালো নেই। ভাঙা মন নিয়েও অধিকাংশ এমপি এলাকায় পড়ে আছেন। দীর্ঘদিন তাদের মন খারাপ থাকা কোনো ভালো ফল দেবে কি?

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।