একজন মাইক্রোবায়োলজিস্টের চোখে বায়োসেফটি ও বায়োহ্যাজার্ড

তানিয়া আক্তার ঝুমা
| আপডেট : ১৬ মে ২০২০, ১৮:০৮ | প্রকাশিত : ১৬ মে ২০২০, ১৭:২২

যেকোনো গবেষণা বা জটিল ছোঁয়াচে রোগ নির্ণয়ের জন্য বায়োসেফটি এবং বায়োহ্যাজার্ড দুটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোভিড-১৯’র এই সময়ে এর তাৎপর্য কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষ অনুভব করছেন। বায়োহ্যাজার্ডের ভয়াবহতা আর বায়োসেফটির গুরুত্বকে মাথায় নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত। বর্তমানে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ে যেসব ডাক্তার, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট কিংবা স্বেচ্ছাসেবীরা যুক্ত আছেন, তাদের প্রত্যেককেই মাথায় রাখতে হবে এ দুটি বিষয়। না হলে ঘটে যেতে পারে ছোট কিংবা বড় দুর্ঘটনা। করোনা যুদ্ধে এ সকল ফ্রন্টলাইন কর্মী ও আগ্রহী পাঠকদের জন্য এ বিষয় সম্পর্কে কিছু বিষয় শেয়ার করছি।

যখন গবেষণাগারে কঠিন সব ভাইরাস নিয়ে কাজ হয় তখন সবার আগে ভাবা উচিত নিজের সুরক্ষা এবং কাজের জায়গার সুরক্ষা। শুধু ভাইরাস নয়, ব্যাকটেরিয়াসহ অন্য অনেক অণুজীব এর বেলায়ও নিয়মটি একই। অণুজীব না বলে, জীববিজ্ঞানের কেতাবি ভাষায় শব্দটি হবে ‘Specimen’। ক্ষতিকারক অনুজীব হতে এ সুরক্ষার ব্যাপারটিই জীববিজ্ঞানের ভাষায় ‘বায়োসেফটি’। যেসব জিনিস থেকে নিজেকে ও পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে, তাকে বলে ‘বায়োহ্যাজার্ড’।

একজন মাইক্রোবায়োলজিস্টকে কাজ করতে হয় ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ আরো অনেক অনুজীব নিয়ে। যারা ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজিস্ট তারা কাজ করেন ক্লিনিক্যাল স্যাম্পল নিয়ে। ভাইরোলজিস্ট কাজ করেন ভাইরাস নিয়ে। এগ্রিকালচারাল মাইক্রোবায়োলজিস্ট কাজ করেন এগ্রিকালচারাল স্যাম্পল নিয়ে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজিস্ট কাজ করেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্যাম্পল নিয়ে। এমন আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। এরা মূলত ল্যাবরেটরিতে কাজ করে।

প্রশ্ন হলো, সবার ল্যাবরেটরির সেট আপ কি এক ধরনের? সবার কি এক রকম সুরক্ষা দরকার? এখানেই বায়োসেফটি কথাটির আগমন। সবার বায়োসেফটি এক রকম হবে কি না তা বোঝার জন্য চলতি সময়ের একটা উদাহরণ দেয়া যাক। করোনাভাইরাসের যখন আগমন হলো, ভেবে দেখুন তো লক্ষণগুলো কী ছিল? সর্দি, কাশির মত নেহায়েত সামান্য কিছু লক্ষণ। যাদের খারাপ অবস্থা ছিল তাদের শ্বাসকষ্ট। এরকম লক্ষণগুলো তো কোভিড-১৯ এর পূর্বেও অনেক রোগীর ছিল। এরকম অনেক রোগী পূর্বেও হাসপাতালে বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেন। তখন কি তাদেরকে ডাক্তাররা পিপিই পরে বা মাস্ক পরে চিকিৎসা সেবা দিতেন? নিশ্চয়ই না। সুতরাং এখন নিশ্চয়ই কিছু একটা রিস্ক বা ঝুঁকি আছে, যার কারণে ডাক্তারদের আলাদাভাবে সুরক্ষার প্রয়োজন পড়েছে। অর্থাৎ সেফটি শব্দটার সাথে আরেকটা শব্দ জড়িয়ে আছে, সেটা হলো ‘রিস্ক’।

যখন কোনো ল্যাবরেটরিতে রিস্কি কোনো প্যাথোজেন বা অনুজীব নিয়ে কাজ করবেন, তখন সে অনুজীব হ্যান্ডেল করার জন্য কিছু সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। সে সুরক্ষা হতে হবে আপনার ও আপনার সাথে যারা ল্যাবরেটরিতে কাজ করবেন তাদের জন্য এবং আপনি যেই ল্যাবরেটরিতে কাজ করছেন তার পরিবেশের জন্য। এটাই মূলত বায়োসেফটি।

এই বায়োসেফটির রয়েছে চারটি লেভেল: বায়োসেফটি লেভেল-১, বায়োসেফটি লেভেল-২, বায়োসেফটি লেভেল-৩ এবং বায়োসেফটি লেভেল-৪। এগুলো সিডিসি (সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) দ্বারা সংজ্ঞায়িত। ল্যাবে জীবাণু হ্যান্ডেলিংয়ে রিস্ক লেভেল বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বায়োসেফটি লেভেলও বেড়ে যায়। এখানে ল্যাবরেটরির রিস্ক নির্ভর করে তিনটি জিনিসের উপর- ইনফ্যাক্টিভিটি, ট্রান্সমিশন এবং কোনো ধরনের কাজ করা হচ্ছে। যেই ক্ষতিকারক জীবাণু নিয়ে কাজ হচ্ছে, তার ইনফেকশন বা সংক্রমণ করার সামর্থ্য কেমন, তার একজন হতে আরেকজনে ট্রান্সমিশন হওয়ার সামর্থ্য কেমন এবং আসলে অণুজীব এর কী নিয়ে কাজ হচ্ছে এসবের ওপর রিস্ক নির্ভর করে।

যেসব বায়োলজিক্যাল জিনিস মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ তাদের বায়োহ্যাজার্ড বলে। এটা কোনো অণুজীব যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা তাদের দ্বারা নিঃসৃত কোনো বিষ হতে পারে। বায়োসেফটির পুরো বিষয়টিই নির্ভর করে বায়োহ্যাজার্ড এর ওপর। যখন স্যাম্পল নিয়ে কাজ করবেন, তখন চিন্তা করতে হবে, কাজের ধরনটি কোন ধরনের বায়োহ্যাজার্ড? সে অনুযায়ী ল্যাবরেটরির বায়োসেফটি লেভেল আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। বায়োহ্যাজার্ডের লেভেল নিশ্চিত হতে হলে জানতে হবে কয়েকটি বিষয়।

এক, যে স্পেসিম্যানটি নিয়ে কাজ করছেন তার সংক্রমণ করার সামর্থ্য। দুই, স্পেসিম্যানটির ভাইরুলেন্স ক্ষমতা কেমন, যা রোগের তীব্রতা দেখে বোঝা যায়। তিন, স্পেসিম্যানটি দ্বারা সৃষ্ট রোগটির জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে কি না। চার, বায়োহ্যাজার্ডটির কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন: ট্রান্সমিশন পথ, সংক্রমণের ডোজ, পরিবেশে এটি কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে। কোন ধরনের পোষকে টিকে থাকে ইত্যাদি। এবার জেনে নেই কোন ধরনের বায়োসেফটি লেভেলে কী ধরনের কাজ হয়।

বায়োসেফটি লেভেল-১. এটিকে বায়োসেফটির সর্বনিম্ন স্তর বলা হয়। এখানে এমন সব অণুজীব নিয়ে কাজ করা হয় যেগুলো সাধারণত মানুষকে সংক্রমিত করে না। এ সব ব্যাকটেরিয়া আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়। যেমন: ই. কোলি ব্যাকটেরিয়া, যা পাকস্থলীতে সর্বদাই বসবাস করে। এক্ষেত্রে বায়োহ্যাজার্ড এর জন্য খুব বেশি সতর্কতার প্রয়োজন নেই।

বায়োসেফটি লেভেল-২. এ লেভেলের আওতায় বায়োহ্যাজার্ডগুলো ল্যাবরেটরির পরিবেশ ও কর্মীদের জন্য কিছুটা হুমকিস্বরূপ। এগুলো সাধারণত দুর্ঘটনাবশত ত্বকের মাধ্যমে, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কিংবা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে থাকে। যেমন: হেপাটাইটিস এ, বি, সি ভাইরাস, টাইফয়েড এর জীবাণু ইত্যাদি। এ লেভেলে থাকা বায়োহ্যাজার্ডগুলো নিয়ে কাজের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হবে। যেখানে সেখানে কাজ করা যাবে না। প্রয়োজন হবে বায়োলজিক্যাল সেফটি ক্যাবিনেটের এবং যথাযথ ম্যানুয়ালের। বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়ের জন্য ক্লিনিক্যাল স্যাম্পলের কাজ বায়োসেফটি লেভেল-২ করা হয়। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য করা আরটিপিসিআর টেস্ট এই লেভেলের ল্যাবরেটরি গুলোতেই করা হচ্ছে।

বায়োসেফটি লেভেল-৩. এ লেভেলের ল্যাবরেটরিতে বায়োসেফটি লেভেল- ১ ও ২ এর পাশাপাশি আরও বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এই লেভেলের অধীনে থাকা বায়োহ্যাজার্ডগুলো মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে, তবে তার জন্য অবশ্যই চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ভ্যাক্সিন রয়েছে। যেমন: অ্যানথ্রাক্স, সারস ভাইরাস, মারস ভাইরাস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। এই লেভেলের ল্যাবরেটরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাতাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ যাতে করা। যাতে ল্যাবরেটরির বাইরের বাতাস ভেতরে ঢুকতে না পারে। করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য এ ধরনের ল্যাবরেটরিগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বায়োসেফটি লেভেল-৪. এই লেভেলের ল্যাবরেটরিগুলো সর্বোচ্চ মানের বায়োসেফটি দিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ল্যাবরেটরি বেশ দুর্লভ। এই লেভেলের ল্যাবরেটরিগুলো সাধারণত আইসোলেটেড জায়গাতে হয় এবং বায়োসেফটি লেভেল- ১, ২ ও ৩ এর সকল সুবিধাসহ আরো কিছু সতর্কতা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা যোগ করা হয়। এই ল্যাবরেটরিতে এমন সব বায়োহ্যাজার্ড নিয়ে কাজ করা হয়, যেগুলো মানুষের জন্য বিপদজনক এমনকি প্রাণঘাতীও হয়ে থাকে। এদের জন্য কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ভ্যাক্সিন ও নেই। সব থেকে বিপদজনক হলো এই বায়োহ্যাজার্ডগুলো সংক্রমণের পথ বিষয়ে প্রকৃত ধারণা নেই। যেমন: ইবোলা ভাইরাস, লাসসা ভাইরাস ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল হ্যাজার্ড নিয়ে কাজ করার সময় পজিটিভ প্রেশার যুক্ত পোশাক পরিধান করার পাশাপাশি বায়ু সরবরাহের আলাদা ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক।

আশা করি আলোচনাটুকু যারা এখন গবেষণা ও করোনা রোগ নির্ণয়ে কাজ করছেন তাদের ক্ষানিকটা হলেও তথ্যগত ধারণা দেবে। পাশাপাশি এ সময়ে যারা অণুজীববিজ্ঞানের গবেষণা ও কাজের পরিবেশ নিয়ে জানতে আগ্রহী তাদেরকেও সাহায্য করবে। বায়োসেফটি এবং বায়োহ্যাজার্ড বিষয়ক জ্ঞানের দৈন্যতা বা অসেচতনতার জন্য কোন ডাক্তার, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট কিংবা স্বেচ্ছাসেবীরা ঝুঁকিতে না পড়েন , এই হোক আমাদের প্রার্থনা। সকলের নিরলস পরিশ্রম সার্থক হোক। জয় হোক বিজ্ঞানের ও মানবতার।

লেখক: গবেষণা সহকারী, এনজাইম ও মাইক্রোবিয়াল বায়োটেকনোলজি ল্যাবরেটরি, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :