কোভিড- ১৯ পরবর্তী শিক্ষা যুগের সূচনায় একলব্যদের উত্থান

ড. দেবর্ষি মুখার্জী
 | প্রকাশিত : ১৬ মে ২০২০, ১৯:৪৪

বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, "স্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকলে, তা হচ্ছে লোকেরা যা শুনতে চায় না তা বলার অধিকার”। এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ভয় ও হতাশার অতল প্রান্ত থেকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে নিদারুন ভাবে লড়াই করছে, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতি নিরুপন করার চেষ্টা করছেন, তখন গবেষনা ও শিক্ষাই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে।

কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি চিকিৎসক, প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কর্মীগণ প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে পৃথিবীকে রক্ষা করে থাকেন তবে শিক্ষকগণও কম নন, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রশিক্ষিণ দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে চলেছেন। আমি গত কয়েকদিন বিভিন্ন গ্রুপ এন্ড সোশ্যাল মিডিয়াতে লক্ষ্য করছি যে, সমাজের কিছু লোক এই লকডাউনের সময়ে অনলাইন ক্লাস ও অন্যান্য কার্য্যক্রমকে তীব্র সমালোচনা করে শিক্ষকদের এই সাহসী পদক্ষেপকে বানচাল করার চেষ্টা করছেন।

অনেকের ধারনা পাঠদান একটি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা নয়, লকডাউনের সময় পাঠদান বন্ধ রেখে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আবার চালু করা উচিৎ। কিছু অভিভাবকও এর থেকে আলাদা নন, তারা মনে করেন অনলাইন ক্লাস শুধু মাত্র সেমিষ্টারের ফিস গ্রহণ করার একটি প্রক্রিয়া। এই যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য? অনেকেই পাঠদানকে খাদ্য ও অষুধের মত অত্যাবশ্যকীয় মনে করেন না। তাদের চিন্তা চেতনা যদি বিপরীতমুখী হতো, তবে আমরা বর্তমানের তুলনায় আরো উন্নত অবস্থায় থাকতাম।

আবহাওয়াবিদগণও ভ্রকুটি ভরে বলে সমগ্র ভারতজুড়ে গরম, শীত ও বৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে এবং পাঠদান পুরোপুরি ব্যাহত হয়। মজার বিষয় হল, ভারতের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই প্রযুক্তিগত উন্নতি ও অনলাইন পাঠদানের দিকে মনোযোগী হয়নি বা নিরুৎসাহিত করেছে যার জন্য শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। সারা ভারতজুড়ে পাঠদানের জন্য শিক্ষকের শারীরিক উপস্থিতিকেই এখনও বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়।

কানাডার মতো দেশ যেখানে তেমন ঘন বসতি নয় এবং তুষারপাত ও খারাপ আবাহাওয়ার কারণে প্রায়সই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, ঘানার মত দেশ যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক খুবই কম তারাও কয়েক দশক আগেই অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছে। সাধারণ লোকেরা কেবল চীনের সাথে নিজেদের তুলনা করতে পারে, চীনে’ই আইপিই ২০১৮ সালে ১.৫৪ মিলিয়ন পেটেন্টের জন্য আবেদন করা হয়েছে যা ইউএসএ (৫৯৭১৪১০), জাপান (৩১৩,৫৬৭), কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের (২০৯,৯৯২), এবং বিশ্বব্যাপী মোট ৪৬ শতাংশ। ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস (ইপিও,১৭৪,৩৯৭) (ডাব্লুআইপিআই,২০১৮)। একই সময় ভারতে যেখানে প্রায় ৪৭,৮৫৪টি আবেদন ফাইল করেছে সেখানে ভারতীয় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ১৫,৫৫০ (জিওআই বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১৭-২০১৮)।

অনুরূপ পরিসংখ্যান ডিজাইন ও ট্রেডমার্কের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করার মতো যে ভারত গবেষণা ও উন্নয়নে প্রায় ১৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে যা জিডিপির ০.৭ শতাংশ যেখানে চীন (২.১শতাংশ, মার্কিন $ ৩৩৩.৪ বিলিয়ন), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (২.৮শতাংশ, মার্কিন $ ৫১১.১ বিলিয়ন) এবং ইজরাইলে ৪.৬শতাংশ। এই পরিসংখ্যানগুলো উন্নয়নের কি ধারা নির্দেশ করে?

প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয়ে ভারত যেখানে তার জিডিপির ৪.৬শতাংশ (২০২০) ব্যয় করছে, সেখানে চীন তার জিডিপির প্রায় ৮শতাংশ (২০১২-২০১৭) ব্যয় করছে এবং তাও আবার টানা পাঁচ বছর ধরে। যদিও সামাজিক-রাজনৈতিক বা গনমতামতের কোন বাধ্যবাধকতার কারনে বিপরীত যুক্তিতর্ক ও পরিসংখ্যান থাকতে পারে কিন্তু এই মুহুর্তে আমি অনুরোধ করছি গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রকে সর্বোচ্চ অগ্রাধীকার দেওয়া হোক। পরিসংখ্যান ছাড়াও যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক তা হ'ল প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং তৃতীয় স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পুনর্গঠনের উপর গুরুত্ব না দেওয়া।

কভিড-১৯ পরবর্তী যুগে জীবন আর কখনও পুর্বের মত হবে না, তাই আমাদের অবশ্যই নতুন চ্যালেঞ্জগুলি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সময় খুব বেশি দূরে নয়, যখন শ্রেণিকক্ষ গুলি ছোট হবে আর শিক্ষা প্রচারের ক্ষেত্রটি আরও বিস্তৃত হবে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ শ্রেণির শিক্ষার ভবিষ্যত পাঠ্যক্রম ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সর্বব্যাপী টেকসই কাঠামোতে রূপান্তরিত হতে চলেছে। আমরা এটি পছন্দ করতে পারি বা নাও পারি যেমন স্ব্যাম, এনপিটেল, দীক্ষা অথবা স্যাম্প্রভা প্রভৃতি শিক্ষা পোর্টাল শিক্ষার্থীদের জন্য আর ঐচ্ছিক থাকবে না বরং তা স্বল্প মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে একটি উল্লেখযোগ্য অংশে অবদান রাখতে চলেছে এবং পরবর্তীকালে দীর্ঘ মেয়াদে স্কুল শিক্ষায় স্থান করে নিতে চলেছে।

ইন্টারনেট ক্লাসরুম টেকনোলজির মধ্যে মাইক্রোসফট টিম , গুগল থেকে শুরু করে মুডলের ক্লাউড লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সকলেই ডাটা ব্যবস্থাপনা ও তথ্য প্রচারের জন্য চমকপ্রদ উন্মুক্ত ব্যবস্থা চালু করেছে। শিক্ষার্থীরা সিলেবাসের কিছু অংশ অনলাইন কোর্সের উপর ভিত্তি করে ক্রেডিট ট্রান্সফার সিস্টেম এর মাধ্যমে কি ক্রেডিট অর্জন করতে পারে? ঠিক তাই, হতে পারে। এটিই সঠিক ভবিষ্যত, যেখানে একজন বিদ্যার্থীকে স্বাধীন এবং পরিপক্ক শিক্ষার্থী হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং ইন্টারেক্টিভ ই-লার্নিং এর বিষয়বস্তুগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়, যেখান থেকে শিক্ষার্থী নিজেরাই নিজের বিষয়বস্তু খুজে নিতে পারে।

যদি শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হয় তবে প্রযুক্তি ব্যবহারের এই বড় কৌশলগত সুযোগকে অবশ্যই উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর (এইচ ই আই’স) তুচ্ছ না করে বরং গ্রহণ করা উচিত যা কিনা শিক্ষা নীতি কাঠামোর ইতিহাসে এবং মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতিতে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসাবে পালন করতে পারে। আমরা যদি আজ শিখতে না ভুলে যাই তবে প্রতিটি শেখার ক্রিয়াকলাপ অসম্পূর্ণ থাকে যাবে।

যারা মুখস্থ বিদ্যায় বিশ্বাস করবে তারা সময়ের রাজ্যে ডাইনোসর হয়ে যাবে। তদুপরি,আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে পাঠদান এবং শেখার প্রক্রিয়াতে অপ্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে যেখানে ব্যক্তিগত এবং সুরক্ষিত নেটওয়ার্কগুলোর মাধ্যমে বক্তৃতা ও জ্ঞান ভাগাভাগি করে সম্প্রচার করলে একাডেমিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এডুকেশন ৪.০ শিক্ষা মানের ভিত্তিতে ডিজিটাল অবকাঠামোগত বিকাশ শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষের সীমা থেকে মুক্ত করবে এবং শেষ পর্যন্ত এক নতুন উচ্চতায় উন্নত করবে যেখানে ইকালিয়াস একটি সমান্তরাল প্ল্যাটফর্মে অর্জুনার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য উত্থিত হবে।

এখনি জনসাধারনের শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিৎ অন্যথায় গবেষণা ফলাফলটি ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তে স্থবির হয়ে পরে থাকবে। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দৃড়তার সাথে গবেষণা ও উন্নয়নের সীমা বাড়াতে সমান ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি আমাদের সকল নিত্যপন্য দ্রব্য ব্যবহার করি অথবা শীর্ষ কোম্পানীগুলোর নাম আমাদের মাথায় ঢুকাতে পারি তাহলে আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারব যে আমাদের সামনে একটি দীর্ঘ পথ চলা উচিৎ।

এই মহামারিটি ভয়, বিহ্বলতা ও শোকের পাশাপাশি একটি বিস্তৃত সুযোগের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে যাতে করে আমরা নতুন পথের সন্ধান পেতে পারি এবং দৃড়তার সাথে এই মহামারির সমাধান খুজে নিতে পারি। আর একটা সহজ কথা আমরা সবাই জানি যে, যদি আমরা বেশি স্কুল তৈরি করতে পারি তাহলে হয়তো অনেক কম হাসপাতাল তৈরি করতে হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগ,ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, আগরতলা,ভারত

ঢাকাটাইমস/১৬মে/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :