স্থপতি ইকবাল হাবিবের নকশায় আইসোলেশন চেম্বার ‘নির্ণায়ক’

প্রকাশ | ১৭ মে ২০২০, ১২:২৩ | আপডেট: ১৭ মে ২০২০, ১২:৪৫

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে চিকিৎসকদের প্রায় সব ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ। হাসপাতালগুলোতেও সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা মিলছে না সহজে। করোনা আতঙ্ক আর পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে চিকিৎসকদের অনেকে বহির্বিভাগে রোগী দেখছেন না। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ‘আইসোলেশন চেম্বার’ নকশা করেছেন দেশের বিশিষ্ট নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। সঙ্গে ছিল তার প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের’ দক্ষ স্থপতিরা।  নকশা মেনে তৈরিও হয়েছে প্রযুক্তিগত সুবিধা সম্বলিত বুথটি।  সহযোগিতায় ছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসওএস। আইসোলেশন চেম্বারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নির্ণায়ক’।

স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, করোনা মহামারির সময় তার নকশা করা এই চেম্বারটি চিকিৎসকদের সুরক্ষার পাশাপাশি রোগীদের সেবা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে, স্বাস্থ্যকর্মীরা এই বুথ ব্যবহার করে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা সংগ্রহ করতে পারবেন। বড় সুবিধাটি হচ্ছে, রোগী দেখা কিংবা নমুনা সংগ্রহে নিয়োজিত কাউকেই পিপিই ব্যবহার করতে হবে না। এতে যেমন শারীরিক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি লাঘব হবে। যে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবেন। কমবে পিপিই জন্য ব্যয়ও।

ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমি মনে করি, এই সময়ে এরকম কাজের মধ্য দিয়ে যার যা ক্ষমতা আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ওই কথাটির মতো, ‘যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।’ আমাদের ছোট ছোট জ্ঞান থেকে যদি কিছু সাহায্য হয়, সেই ভাবনা থেকেই কাজটি করেছি।’

কেন প্রয়োজন আসোলেশন চেম্বার?

ইকবাল হাবিব বলেন, ‘প্রথমত কোভিড বা সংক্রামক ব্যাধিযুক্ত রোগীদের আইসোলেট করা প্রাথমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমরা সবাই বুঝি কারণ আক্রান্তরা যদি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায়, হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে পড়ে তখন কিন্তু প্রতিরোধ করলেও দেরি হয়ে যাবে। একারণে আমরা এমন একটা চেম্বার বা বুথ করতে চেয়েছি যেটি দুয়ারে অর্থাৎ ঠিক আঙিনায় বাইরে আলাদা থাকবে। এর বিদ্যুৎ সংযোগ বা সব কিছু আলাদা থাকবে।’

প্রয়োজন হবে না পিপিই:

বিশিষ্ট এই স্থাপতি বলেন, ‘দ্বিতীয় যে বিষয়টি হচ্ছে, আরও যারা বুথ তৈরি করেছে, আমরা দেখেছি পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) পরে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা সেগুলোতে সেবা দেন।

মনে রাখতে হবে যারা জীবনে একবার পিপিই পরেছেন, আধাঘণ্টার পর পিপিইটা অসহ্য বিষয়ে পরিণত হয়। কারণ এর মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকভাবে নিতে পারে না। আমাদের এই গরমের দিনে পিপিই পরে আধাঘণ্টা বা একঘণ্টার বেশি থাকা কঠিন। অস্বস্তির মধ্যে থাকলে কাউকে সেবা দেওয়ার সময় মনোযোগ, মনোনিবেশ কোনোটাই থাকবে না। আমরা সে কারণে এমন একটা চেম্বার তৈরি করলাম যেটি নিজেই একটা পিপিই। অর্থাৎ এই চেম্বারের ভেতরে বাতাস চলাচল সম্পূর্ণ পরিশীলিত।’

নিরাপদ বাতাস নির্গমণ ও প্রবেশ:

ইকবাল হাবিব বলেন, ‘চেম্বারটিতে প্রায় সাড়ে আট ফুট উপর থেকে চিমনির মাধ্যমে বাতাস সংগ্রহ করা হয়। বাঙালি একজন গবেষক আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে বের করেছেন আমাদের হোসিয়ারিতে যে গেঞ্জি তৈরি হয় তার দুই পরতের গেঞ্জির কাপড় দিয়ে তৈরি মাস্কে ৯৯ শতাংশ ড্রপলেট বা জলীয়কণা আটকে দেয়। আমরা যখন কাশি বা হাঁচি দিই, সেখান থেকেই দূষণটা ছড়ায়। আর তো কোনোভাবে ছড়ায় না। কাশি বাতাসের মধ্যে জলীয় বাষ্পের যে কণা তৈরি করে তা শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র, চোখ-নাক বা মুখ দিয়ে দেহে প্রবেশ করে তখনই আমি কোভিড আক্রান্ত হবো। সেই কারণেই আমরা বাতাসটি সাড়ে আট ফুট উপর থেকে নিয়ে ওর ভেতরে একটা কম্পেসার সাকশ্যন বের করেছি। কম্পেসার সাকশ্যন মানে এগজস্ট ফ্যান। এই এগজস্টটা ইনলেট হিসেবে কাজ করে। তার মুখে আমরা লেয়ার অব স্ক্রিনিং (হোসিয়ারি গেঞ্জির ডাবল লেয়ার) লাগিয়ে দিয়েছি। ফলে যদি সাড়ে আট ফুট উপরেও ড্রপলেট ওঠে সেটিও আটকে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এইখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, একজন মানুষ যখন হাঁচি দেয় তখন তার জলীয়কণাগুলো বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়, তখন বাতাসটা ভারী হয়ে যায়। সেটা ছয় ফুট বা সাড়ে ছয় ফুটের উপরে ওঠে না। এটা নিচের দিকে থাকে। ফলে আমরা সাড়ে আট ফুট উপর থেকে বাতাসটি সংগ্রহ করি। নিচের থেকে না।’

ভেতরে পরিবেশ থাকবে নাতিশীতোষ্ণ:

অত্যাধুনিক চেম্বারটির বিভিন্ন কারিগরি দিক তুলে ধরে ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমরা এই চেম্বারটিতে দুই স্তরের ছাদ করেছি। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটা নিচের স্তরে, অর্থাৎ কাঠামোর সাথে যে স্তর সেখানে একটা এগজস্ট ফ্যান।এখানকার গরম বাতাসটা বের করে দিচ্ছে। আমরা নিশ্চয়ই জানি, আবদ্ধ জায়গায় গরম বাতাস উপরে উঠে যায়। আর ঠাণ্ডা বাতাস নিচে থাকে। ফলে আমরা বাতাসটি প্রবেশ করাই হাঁটুর নিচের উচ্চতায়। আর বের করে দিই উপরের উচ্চতায়। উপরে যে আরেকটা ছাদ আছে, তার উদ্দেশ্য দুটো। একটা হচ্ছে, প্রখর সূর্যের আলো মূল কাঠামো পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। মাঝখানে যে গ্যাপ আছে সেখানে যে বাতাস বয়ে বেড়াতে পারে, তার ফলে গরম বাতাসটা চলে যাবে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঘরের কার বা ফলস সিলিংয়ের স্থাপত্য থেকে এই আইডিয়াটা নেওয়া। দ্বিতীয়ত বৃষ্টি থেকেও মূল অবকাঠামোকে রক্ষা করবে। এই পদ্ধতি ঘরের ভেতরে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া রাখবে।’

স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবেন চিকিৎসক:  

চেম্বারটির ভেতরে যে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আবদ্ধ জায়গাটার ভেতরে একজন চিকিৎসক যেন বসতে পারেন এবং একটা ল্যাপটপ রেখে প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চেম্বারের ভেতর থেকে কয়েকটা সেবা তিনি দিতে পারবেন। পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার একজন মানুষকে ধরার মতো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একটা স্টেথোস্কোপ আছে। একটা থার্মোমিটার আছে। একটা উভয় দিকে শব্দ শোনার জন্য স্পিকার আছে। ভেতরের ল্যাপটপের সঙ্গে বাইরে রাখার মতো একটা ছোট ওয়াইফাই প্রিন্টার আছে। প্রিন্টার রাখার তাকটা চাইলে উঠিয়ে রাখা যায়। আবার প্রিন্টারও রাখা যায়। একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী প্রথমে একজন রোগীর চেস্ট দেখেন। স্টেথো ধরলে তার ফুসফুসের কার্যকারিতা কেমন তা বুঝতে পারেন। এরপর তিনি রোগীর পিঠেও স্টেথো রেখে দেখতে পারেন। রোগীর শরীরের তাপমাত্রা মাপতে পারবেন। হাত দিয়ে ধরে তার চোখ এবং জিহবা দেখতে পারবেন। একই সঙ্গে সামনের তাকটা যদি খুলে রাখি এবং ওখানে কৌটা সাজানো থাকে, তাহলে তিনি করোনা আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগীর নমুনাও সংগ্রহ করতে পারবেন। পরে কৌটাটির মুখ বন্ধ করে রেখে দিলে সংগ্রাহক এসে পরে কৌটাটি নিয়ে যেতে পারবেন।’

তিনি জানান, এই পুরো কাজটা তিনি করতে পারবেন টি-শার্ট বা গেঞ্জি পরে বসেই। তাকে চেম্বারের ভেতরে বসে পিপিই পরার দরকার হবে না। কারণ এর মধ্যে সামান্যতম ছিদ্র নেই। প্রত্যেকটি জোড়া নিঃছিদ্রভাবে আটকানো আছে।

চেম্বারটি তৈরিতে যা ব্যবহার হয়েছে:

সনামধন্য স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এটি বানানো খুবই সহজ। এটা স্থানীয়ভাবে বানানো যায়। আমরা এর নকশা, প্রয়োজনীয় মালামালের তালিকা এবং একটা নমুনাসহ আমার প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড’ সবকিছু বিনাশর্তে দান করে দিয়েছে।

আমরা এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। চেম্বারটি তৈরিতে এমএস স্টিল অ্যাঙ্গেল দিয়ে কাঠামোটা তৈরি করতে পারবে। চারপাশে দেয়াল দিতে হবে এমডিএফ বোর্ড দিয়ে। এই বোর্ড সহজে পাওয়া যায়। দেশে অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান এসব বোর্ড বানায়। আর লাগবে গ্লাস এবং অ্যাক্রাইলিক শিট। সবই স্থানীয় জিনিসপত্র।’

কোথায় রাখা যাবে এই চেম্বার?

আমরা চাই প্রতিটি পোশাক কারখানায়, শহরের বিভিন্ন জায়গায় শপিংমলে ঢোকার পথে, স্কুল-কলেজে ঢোকার পথে অথবা প্রতিটি হাসপাতালের প্রবেশ মুখে এটা স্থাপন করা যেতে পারে। এই বুথের মাধ্যমে যদি রোগীদের পরীক্ষা করা যায়, তাহলে অন্যদের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে। অসুস্থ রোগীকে দেখে প্রেসক্রিপশন দেওয়া যাবে। অন্যদিকে, এখন যেখানে করোনা আক্রান্ত সন্দেহভাজনদের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখানে অনেক বড় লম্বা লাইন চোখে পড়ে। আপনি যদি পাঁচটি বুথ বানিয়ে দেন, তাহলে মানুষ পাঁচ ভাগ হয়ে গেল। আমরা যদি কম খরচে ছোট একটি মডিউল বানাতে পারি, তাহলে নমুনা সংগ্রহে বিভিন্ন বুথ করে মানুষের সামাজিক দূরত্ব সহজে নিশ্চিত করতে পারব।

ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমি মনে করি, এই সময়ে এরকম কাজের মধ্য দিয়ে যার যা ক্ষমতা আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ওই কথাটির মতো, ‘যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।’ আমাদের ছোট ছোট জ্ঞান থেকে যদি কিছু সাহায্য হয়, সেই ভাবনা থেকেই কাজটি করেছি।’

বাস্তবায়নে কাজ করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসওএস:

স্থপতি ইকবাল হাবিবের নকশায় বক্সটি তৈরিতে কাজ করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসওএস। সংগঠনটির অন্যতম সংগঠক সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন, মাসুদুল ইসলাম মাসুমসহ বেশ কয়েকজন এটি তৈরিতে নিরলস সহায়তা করেছেন। এতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব এক ব্যবসায়ী মো. শামস ও তার প্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন বলেন, ‘স্থপতি ইকবাল হাবিব দেশের দুর্যোগে তিনি তার দল নিয়ে মেধা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।’

শোভন বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে সরকারকে আমরা উপহার হিসেবে দিতে চাই। এটি ব্যবহারে একটি গাইডলাইনও তৈরি করা হয়েছে। যেটি অনুসরণ করে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। সঠিক নিয়মে রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে এটি একটা সময় অকেজো হয়ে পড়তে পারে।’

এই স্বেচ্ছাসেবী জানান, আরও কয়েকটি বক্স তৈরি করে তারা বিনামূল্যে হাসপাতালগুলো দিতে চান। সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন।

(ঢাকাটাইমস/১৭মে/এইচএফ)