দেশের উন্নয়নে সৎ ও মেধাবীদের মূল্যায়নের বিকল্প আছে কী?

মো. রিয়াজুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ১৮ মে ২০২০, ১৫:৩৯

গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ৩৭৫ খৃ:পূর্বাব্দে ‘দি রিপাবলিক’ নামক গ্রন্থটি লিখেছিলেন। গ্রন্থটি সমসাময়িক কালেও সমানভাবে জনপ্রিয়। প্লেটো তাঁর ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেছেন ‘একটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শরাষ্ট্র গঠন করতে হলে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের মতো করে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সমাজে যার যতটুকু যোগ্যতা সেই অনুযায়ী প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে।

ন্যায় হচ্ছে বন্ধুর প্রতি বন্ধুত্ব, শত্রুর প্রতি শত্রুতা’- এই অংশটুকু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্লেটো মূলত: যোগ্য লোকদের যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের কথা বলেছেন, একজন উচ্চ শিক্ষিত লোককে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী যেমন মূল্যায়ন করা দরকার, তেমনি একজন নিরক্ষর শ্রমিককেও তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন অতি জরুরি।

সমাজের মানুষ যদি যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য বুঝে পাই তাহলে ঐ সমাজে সামাজিক বিভাজন ও দ্বন্দ্বের পরিমান থাকেনা বললেই চলে, সমাজে একে অপরের কর্ম ও শ্রমের মূল্যায়ন করতে কার্পণ্য করেন না। একজন সৎ ও মেধাবী লোক সব সময় যে বড় পদধারী কর্মকর্তাই হবেন সেটা নয়।

সৎ লোক যেকোন পদে চাকরি করলেই তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে পারেন আবার একজন অসৎ লোক বড় পদে চাকরি করলেও সে দেশকে কয়েক বছর পিছিঁয়ে দিতে পারেন, মূলত: একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে সৎ ও মেধাবী ব্যক্তির উপর, কোনো পদের উপর নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে একজন (অফিসার) কর্মচারীর কর্মদক্ষতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আরও ভেবেছিলাম, বোধ হয় পাসপোর্ট পাওয়া যাবে না।

যা হোক, যাওয়ার মাত্র একদিন পূর্বে বন্ধুবর ইয়ার মোহাম্মদ খান (তৎকালীন আওয়ামী লীগের ট্রেজারার), যিনি আওয়ামী লীগের ট্রেজারার, আমাকে বললেন, আজই দরখাস্ত করো। চেষ্টা করে দেখা যাবে। যা হউক, তার ও আতাউর রহমান সাহেবের কথায় দরখাস্ত করলাম। কিন্তু পরে আবার জানতে পারলাম আমার দরখাস্ত পাসপোর্ট অফিসে পৌছে নাই। মহা বিপদ! পাসপোর্ট অফিসার জনাব শুকুর সাহেব খুব ভালো লোক। ব্যবহারও চমৎকার, আর কাজও করতে পারেন।

তার মতো কর্মচারী হলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য’ (সুত্র, আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান)। গ্রন্থটির এই অংশটুকু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানে ‘ব্যবহার ও কাজ করতে পারা’ কে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। কাজ যিনি করতে পারেন তিনি নিশ্চয় মেধাবী এবং ‘এমন কর্মচারী হলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য’ অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তিনি সৎ ও মেধার প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। আবার অনেকেই আছেন যারা বড় বড় পদে চাকরি করেন কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অসৎ। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বড় পদধারী চাকরিজীবীদের ভালো ও মন্দ দুই’টি দিকের কথাই উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়, ‘আবার এমন ডাক্তার দেখেছি যারা জেলখানায় পানিও মুখে দেয় না, ঘুষ তো দূরের কথা। রোগীদের ভালভাবে চিকিৎসা করে, রাতদিন পরিশ্রম করে। আবার এমন ডাক্তার জেলে দেখেছি, সুন্দর চেহারা, মুখে দাড়ি, নামায পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে-দেখলে মনে হয় একজন ফেরেস্তা। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদি রোগীদের ডাইট থেকে ডিম, গোস্ত, রুটি খুব পেট ভরে খান, আর ঔষধও মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে বিক্রি করেন’ (সুত্র, কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান)। এই অংশটুকু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বড় পদধারীদের মধ্যেও যেমন ভালো লোক আছেন, তেমনি মন্দ লোকও আছেন।

মেধাবী মাত্রই যে সৎ নয় সেটা বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ পাঠ করলে বোঝা যায়, আর নামায-কালাম পড়লেই যে একজন সৎ হবেন, ভালো কাজ করবেন, সবার উপকার করবেন, দেশের উন্নতির কথা ভাববেন, সেটা সঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর লেখনির ম্যাধমে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন দেশ গড়ার ক্ষেত্রে সৎ ও মেধাবী লোকের কোনো বিকল্প নেই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থগুলো পড়লে অনেক অজানা বিষয় জানা যায়, যা আমাদের সৎ ও সাহসী হতে প্রেরণা জোগায়।

২. ১৯৬৫ সালের ৬ই আগষ্ট সিংগাপুরকে যখন মালয়েশিয়া আলাদা করে দেয় তখন সিংগাপুর ছিলো অশিক্ষিত লোকে ভরপুর একটি দেশ। যে দেশের ছিলোনা কোন প্রাকৃতিক সম্পদ, উঁচু উঁচু দালাল-কোঠা, কিংবা বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীতে সিংগাপুরই একমাত্র দেশ, যে দেশটি স্বাধীনতা চায়নি। ১৯৬৫ সালের ৯ই আগষ্ট একবুক হাহাকার নিয়ে প্রেসিডেন্ট লি কুয়ান ইউ সিংগাপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েই তিনি দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য বাছাই করেন সৎ ও মেধাবী কিছু মানুষ, যাদের কাছে দেশের সেবা ও উন্নয়নই ছিলো মূল বিষয় (সুত্র, উইকিপিডিয়া)।

এই মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘোষণা করেন দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিকল্পনা ও ২৪ ঘন্টা আইনের শাসন। লি কুয়ান শুরু থেকেই তিনটি বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন যথা: সততা, শিক্ষা ও মেধা। সিংগাপুরের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে তিনি সততার বীজ গভীরভাবে রোপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লি কুয়ানের সেই সততা নামক বীজের ফসল এখনও পাচ্ছে এবং ভবিষৎতেও পাবে সিংগাপুরবাসী। প্রাথমিকভাবে সেইসব মেধাবী লোকগুলোর সততা ও মেধার মাধ্যমে আজ সারাবিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে সিংগাপুর নি:সন্দেহে অন্যতম। একসময় যে দেশটির মানুষ খেতে পেতনা, শুধু মাছ শিকার করেই যাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে হতো।

এখন সেই দেশটি বিশ্বের কাছে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। সিংগাপুরের শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা সারাবিশ্বে নামকরা, আইনের প্রতি সিংগাপুরের প্রতিটি নাগরিক শ্রদ্ধাশীল। আজকের আধুনিক সিংগাপুরের আশ্চার্যজনক উন্নয়নের পিছনে যাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য তারা হলেন সৎ ও মেধাবী মানুষ। যাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা ছিলো অকৃত্রিম ও অন্তরের গহীনে গ্রোথিত। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ হয়, পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পে এবং সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতির খবর জানতে পাই।

সরকারের উচ্চ মহল যদি এই সব প্রকল্পে এবং সরকারি ক্রয়ে সিংগাপুরের মতো বাছাই করা কিছু মেধাবী ও সৎ লোক দিয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রতিটি কাজে তদারকি করার ব্যবস্থা করতেন তাহলে হয়তো দেশে দুর্নীতি অনেকাংশে হ্রাস পেতো। বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকুরীতে যোগদান করেন, তাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই মেধাবী কিন্তু সৎ কীনা এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। সরকারী চাকরি হোক কিংবা বেসরকারি চাকরি সততা নির্ণয়ের মাপকাটি বের করা খুব কঠিন তবে জাপানিজ দের মতো ছোট বেলা থেকেই যদি সততার বীজ বপন করে দেয়া যায় তাহলে হয়তো পরবর্তিতে কেউ অসৎ হতে চাইবেনা।

পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই জাপানিজরা তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই তিনটি জিনিস শিক্ষা দেয়- ন্যায়-অন্যায়, সামাজিকতা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা (সুত্র, ৮ই জানুয়ারী, ২০২০, দৈনিক যুগান্তর)।

শিশুকালের এই শিক্ষা জাপানিজদের হৃদয়ে এমনভাবে গ্রোথিত হয় যে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা এটার সঠিক ও সফল প্রয়োগ করেন, যেকারণে জাপানে দুর্নীতি নেই বললেই চলে, চুরি-ডাকাতি জাপানিজদের সাথে বড় বেমানান। বাংলাদেশের শিশুদের মনে যদি এই তিনটি শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই ভালো-মতো দেয়া যায় তাহলে হয়তো বালিশ দুর্নীতি, হাসপাতালের পর্দা ক্রয় দুর্নীতির মতো দুর্নীতির খবর আমাদের আর পত্রিকার পাতায় বা খবরের কাগজে দেখতে হবেনা।

দেশ গঠনে এবং দেশের উন্নয়নে এখন সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সৎ লোকদের খুঁজে বের করে তাদের দায়িত্ব দেয়া কিংবা দায়িত্বে থাকলে তাদের মেয়াদ আরো বৃদ্ধি করা। এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার সৎ ও মেধাবী লোক রয়েছেন, এই সব লোকদের মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি, আর অসৎ লোকদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সময়ের দাবি, কেননা দেশের উন্নয়নে সৎ ও মেধাবী লোকের বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

ঢাকাটাইমস/১৮মে/এসকএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :