বাংলাদেশকে বাঁচাতে এবারও বুক চিতিয়ে অপেক্ষায় সুন্দরবন

প্রকাশ | ২০ মে ২০২০, ০৯:৩৬ | আপডেট: ২০ মে ২০২০, ০৯:৪৪

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

কালাপাহাড়ের মতো যুগের পর যুগ বাংলাদেশেকে আগলে রেখেছে সুন্দরবন। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটির কারণেই আইলা-সিডর আরও প্রলয়ংকরী হতে পারেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়ংকর আক্রমণের মধ্যে সুন্দরবনই প্রধান ভরসা উপকূলের মানুষদের। এই সুন্দরবনের কারণেই বারবার বাঁচে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও সম্পদ। অসংখ্য শিশু, নারী, পুরুষ বেঁচে থাকার সুযোগ পান। প্রায় ৬ দশমিক ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরী-গেওয়াসহ নানা বৃক্ষের মজবুত বেষ্টনী আর অসংখ্য নদীনালা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে বাংলাদেশের ‘ফুসফুস’ খ্যাত এই ম্যানগ্রোভ বনটি।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ২৬০ কিমি/ঘন্টা বেগে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল, যার ফলে ৩৫০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকার প্রচুর ক্ষতিসাধন হয়। তবে সুন্দরবন না থাকলে এই ক্ষয়ক্ষতি আরও ভয়াবহ হতো। 

একইভাবে, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করেছিল। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’কে ঠেকিয়ে দেয় সুন্দরবন।

এবারও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সুপার সাইক্লোন আম্পান বাংলাদেশের লোকালয়ে আঘাত হানার আগেই তার প্রবল শক্তি হ্রাস করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এই সুন্দরবনই কমিয়ে দিতে পারে। প্রতিবারের মতো এবারও প্রলয়ংকরী এই ঝড়ের সামনে মায়ের আঁচলের মতো ঢাল হয়ে আবারও নিজের বুক পেতে বাংলাদেশকে বাঁচানোর অপেক্ষায় আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটি।

গতকাল আবহওয়া অফিস সূত্র জানিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড়টি যদি তার গতি অব্যাহত রাখে এবং দেশের উপকূলে আছড়ে পড়ে তবে তা সিডরের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। পরে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আম্পানের শক্তি সামান্য কমেছে। পাশাপাশি এর গতিমুখও সামান্য পূর্বে সরে গেছে। ঝড়ের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, ভারত ও বাংলাদেশ উপকূলজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের ওপর এটি আছড়ে পড়তে পারে। এর কারণে হয়তো সুপার সাইক্লোনটির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে পারে সেই সুন্দরবনই।

বুধবারের আবহাওয়ার বার্তায় বলা হয় বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা সুপার সাইক্লোনটির গতি কিছুটা কমেছে। গতি কমার পর উপকূলের কাছাকাছি আসতে আসতে কিছুটা দিক পরিবর্তন করেছে ‘আম্পান’। তাই শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আঘাত হানতে পারে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, সুন্দরবন এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ যেটা কোনো কারণে ধ্বংস হলে সেটি আর আমরা তৈরি করতে পারব না। এই বন বাংলাদেশকে মায়ের মতো আগলে রাখে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাক থেকে আমাদের রক্ষা করে। এবারও বাংলাদেশকে বাঁচাতে প্রস্তুত সুন্দরবন।

পরিবেশবাদী উন্নয়ন সংগঠন ‘জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট’ ক্লীনের প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, ‘সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ভয়াবহতা এবারও সুন্দরবন ঠেকিয়ে দেবে। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের গাছ বাতাসের গতি রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। এ গাছগুলো বাতাসের ধাক্কায় একে-অপরের সঙ্গে মিশে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। যে কারণে বাতাসের প্রবল চাপ কমে যায়।’  

এদিকে আজ সকালে আবহাওয়ার বিশেষ বার্তায় বুধবার সকাল থেকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের পরিবর্তে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এই দুটি বন্দরের আশপাশের অঞ্চলও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় (১৯.৭ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭.৪ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি আজ সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিঃ মিঃ দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৪৫ কিঃ মিঃ দক্ষিণপশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯০ কিঃ মিঃ দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৪১০ কিঃ মিঃ দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বুধবার বিকাল/সন্ধ্যার মধ্যে সুন্দরবনের নিকট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিঃ মিঃ এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ২০০ কিঃ মিঃ যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিঃ মিঃ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।

আম্পানের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় নিচু এলাকায়গুলোয় স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতায় বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় এবং দ্বিতীয় পক্ষের চাঁদের সময়ের শেষ দিনের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে থেকে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

সতর্ক সংকেতে আবহাওয়া অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোও এই ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। তবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ৬ নম্বর বিপদ সংকেতই দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কি.মি. বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হওয়া বয়ে যেতে পারে বলে আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

ঢাকাটাইমস/২০মে/এমআর