স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও আমাদের বাজেট

প্রকাশ | ২১ মে ২০২০, ০৯:২৭

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ

করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যর্থতার বিচার একদিন আগামী প্রজন্ম করবেই। আজ আমাদের উদাসীনতা, অসহযোগিতা, দায়িত্বহীনতা ১৬ কোটি মানুষের মনে যে অবর্ণনীয় চাপ সৃষ্টি করছে তা নানাভাবে একদিন প্রকাশিত হবে। কারণ, নিউটনের তৃতীয় সূত্র আমাদের জানিয়ে দেয়, প্ৰত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত  প্রতিক্রিয়া আছে।

নিউটন গতির আরও সূত্র দিয়েছেন। যদি অন্য কোনো বাধা না থাকে তবে একটি গতিশীল বস্তু অবিরাম চলতে থাকবে। করোনাভাইরাস আক্রমণ করে চলছেই। সে নিজের থেকে থামছেন না। তাকে থামাতে হবে। আর সেজন্য তার গতিপথে বাধা দিতে হবে। কিন্তু আমরা সরকার কর্তৃক জারিকৃত লক ডাউন একটি খেলা হিসাবে নিয়েছি যেন। যেন বিড়াল আর ইঁদুরের খেলা। পুলিশ, সেনা সদস্য আসছে আমরা পালাচ্ছি, আবার তারা চলে গেলে আগের মতো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছি না। এই খেলার পরিণতি কোনোভাবে ভালো হতে পারে না। যখন প্রিয়জনকে হারাবেন তখন বুঝবেন সকলে!

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আমাদের খেলা শেষ। তখন আমরা অমুক তমুককে দোষ দেব। সরকারের পিন্ডি চটকাবো। আরও অনেক কিছু। আমরা হয়তো শেষমেষ চাইনিজদেরকে দোষারোপ করে হয়তো থামবো। আর অনেকে এখানেও থামবে না।  তারা আল্লাহর সৃষ্টি ও রহস্য জানতে চেষ্টা করবো। 

আমরা বার বার ভুল করবো আর আল্লাহ আমাদের তওবা কবুল করবেন!

এর মাঝে আমরা বিভিন্ন পেশার মানুষসহ ডাক্তার, বরেণ্য অধ্যাপকদেরকে হারিয়েছি। কিন্তু তবু আমাদের হুশ নেই। বরং ডাক্তারদেরকে নানা তীর্যক অভিযোগে অভিযুক্ত করে চলেছি। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা বরাবরই প্রাইভেট। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আমরা বিদ্যুৎ নিয়ে, খাম্বা নিয়ে অনেক কৌতুক করেছি। আজ আমরা সেই সেক্টরে সফলতা অর্জন করেছি। এর অর্থ হলো আমরা পারি।

আমরা চাইলে করোনাভাইরাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারি।  আমরা অনেক আগে একটি বিজ্ঞাপন দেখতাম "সবার জন্য স্বাস্থ্য"। আমরা সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ এর “রেফারাল সিস্টেম” চালু করবার প্রচেষ্টা দেখেছি। আমরা দেখেছি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর ঐক্যমতের সরকারকে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করতে। আবার জাতীয়তাবাদীরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে আমাদের অনৈক্য। এই অনৈক্য নিয়ে যায় ধ্বংসের কিনারায়। আমরা তাড়াহুড়া করে লকডাউন চালু করলাম, আবার অর্থনীতির কথা বলে সেটিকে অকার্যকর করে দিলাম। বিপদকে এভাবে মাথায় নিয়ে চলতে চলতে একদিন মাথাটা নুয়ে যেতে পারে কিন্তু! সেদিন আফসোস করা ছাড়া আর কিছু থাকবে কি?

করোনাভাইরাস একটি অদৃশ্য শক্রু। আর তাকে নির্মূলের জন্যই বিশ্ববাসীর লড়াই। সে লড়াই করবে সকলে। এটি কেবল সরকার বা সুনির্দিষ্ট বাহিনীর দায় নয়। এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ইস্যু। আমাদের প্রথম ভুল ছিল আমাদের সীমান্তকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা। ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং পুলিশের অন্যান্য অঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ছিল যথেষ্ট। তাদের একটি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন সকল সমস্যাকে সমাধান করে দিতে পারতো! তাদের সেই ভুলের খেসারত তাদের অনেকেই দিচ্ছেন। এটি অভিযোগ নয়। ভুলকে তুলে ধরা যাতে আর ভুল না হয়। এখন তাদের কাজ ট্রেসিং আউট করা। এবং আক্রান্তদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখা। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায় টেস্টিংয়ের মধ্য দিয়ে ট্রেসিং আউট করতে সহায়তা করা। এর বিকল্প নেই। এখানে আমাদের সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। করোনাকে পরাজিত করতে হলে ট্রেসিং এন্ড টেস্টিং সবচে উপযুক্ত।

করোনাযুদ্ধ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখবার আছে। স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল। সুতরাং আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় যে বাজেট করছেন তাদেরকে ভাবতে হবে; উৎপাদন বাড়ানোকে উন্নয়ন ভাবলে আর চলবে না। উন্নয়ন হবে স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে। সুতরাং, মনে রাখতে হবে আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাজেট অনুমোদন করবেন। আর এটি মাননীয় স্পিকার মহোদয়ের সভাপতিত্বে উপস্থাপিত হবে।  আশা করি সকলে স্বাস্থ্য সেবার মানউন্নয়নের বিষয়টির জোরালোভাবে বলবেন যাতে মাননীয় সাংসদরারস্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবার মতো একটি উপযুক্ত বাজেট পাশ করেন।

আজ প্রণোদনা দিচ্ছি বাঁচার জন্য, আজ চীন সারা বিশ্বে চাপের মুখে- এমন বিপদ যেন কারো জীবনে না আসে। আজ বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে। আর এটা হয়েছে স্বাস্থ্যকে অবহেলা করবার জন্য। চীনের উহান থেকে যে সমস্যার উৎপত্তি তা ওই স্বাস্থ্যকে অবহেলার ফল। তারা স্বীকার  করছে ওই কাঁচা বাজারটির পরিবেশ দায়ী করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য; বিশ্ব স্বাস্থ্যের বিদ্যমান হুমকি জন্য।  বিশ্ব আজ নতুন করে উপলব্ধি করলো স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কেবল কোনো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ এর বেলায় প্রযোজ্য নয়, রোগ, দূষণের মতো সীমানা বিহীন। তারা যদি মনে রাখতো এই স্বাস্থ্যের জন্য কাঁচা বাজার হুমকি স্বরূপ তাহলে তারা সেখানে অর্থ বরাদ্দ করতো। আমাদের বাজারগুলো কেমন সে তো  কারো অজানা নয়। সেগুলোর উন্নয়ন দরকার।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আ হ ম মোস্তফা কামাল টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন। কারণ এখন টেকসই উন্নয়ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্য। এখানে পরিবেশ ও প্রকৃতি গুরুত্ব পায়। এবার আপনার কাছে জনগণের আশা স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সামরিক, উন্নয়ন ও শিক্ষার বাজেট তৈরি করবেন।

ট্রাম্প সাহেব ওবামা কেয়ার বাতিল করেছিল। তার ভয়াবহ পরিণাম তিনি দেখছেন। তিনি এখন রোগ হওয়ার আগেই ওষুধ খাচ্ছেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস ছিল তিনি বাজেট করবেন স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সেটি হয়নি। এবার যেন সেখানে কোনো ঘাপলা না হয়।

প্রণোদনা হোক এমনভাবে যাতে করে ডাক্তার যেন একটি মোটরসাইকেল পান, যাতে করে রোগীর কাছে দ্রুত যেতে পারেন। আপনি উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে একটি গাড়ি দিয়েছেন। এবার যেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একটি গাড়ি পায়। এবার যেন একজন ডাক্তার ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কিনতে পারে। এবার যেন হাসপাতাল ওষুধ, টেস্টিং ল্যাবরেটরি, ভেন্টিলেটর, আই সি ইউ পায়। 

আর এই কেনাকাটার দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে যেন দেন। প্রতিরক্ষা বাজেট নয়, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা হোক আমাদের মূল বাজেট ভাবনা।

বাংলার আরেক সূর্য সন্তান অমর্ত সেন এর Development as Freedom বইটি পলিসি মেকারদের পড়ে দেখা দরকার। সেনের উন্নয়নতত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে আরেক বাঙালি সূর্য সন্তান অভিজিৎ ব্যানার্জিও নোবেল পেয়েছেন।

আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের  ও আড়াই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাইলে এবার স্বাস্থ্যকে বাজেট ও নিরাপত্তা ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে। সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনায় পদ্মা সেতুর মতো স্বাস্থ্য নিরাপত্তা যেন স্থান পায়। “বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি” যদি আপনাদের রাজনৈতিক স্বপ্ন হয়ে থাকে, তবে বাজেটএ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সকলের উপরে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। ভারত-পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকের পারমাণবিক বোমা আছে, আরও আছে অনেক আধুনিক মারণাস্ত্র, সাবমেরিন, ফাইটার জেট। কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসছে না এখন। আমরা যেন পুরোনো ভুল আর না করি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা হোক সকলের প্রতিজ্ঞা।

হাসপাতাল ও ডাক্তারদের লিগ্যাল ও মোরাল রেসপনসিবিলিটি আছে। আমরা লক্ষ্য করছি সেটা উপেক্ষিত। বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতি যদি কিছু কেস দয়া করে নেন এবং মাননীয় বিচারকরা যদি রায় দিয়ে হাসপাতাল ও ডাক্তারদেরকে আইনের আওতায় আনেন, তাহলে খুব ভালো হতো। সরকারতো দিনের পর দিন মানুষের স্বাধীনতাকে সীমিত করে রাখতে পারে না। একদিকে স্বাস্থ্য অপরদিকে অর্থনীতি, স্বাধীনতা। এ দুয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ। এটা করতে গিয়ে সরকার নিজ দলের উপর সমালোচনার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। তাতে করে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে। 

আমরা জানি সরকার অনেক সময় আইনগত সাহায্য দিয়ে নাগরিকদেরকে সাহায্য করে। স্বাস্থ্য আইন ও গবেষণার জন্য যদি কিছু বাজেট বরাদ্দ মাননীয় অর্থমন্ত্রী করতেন তাহলে জাতি উপকৃত হবে। মাননীয় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি অনেক আগেই স্বাস্থ্য আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়কে করে দিয়েছেন। পরিতাপের বিষয় আজও সেই খসড়া আইনে রূপান্তরিত হয়নি। যদি স্বাস্থ্য আইন পাস হয় তবে ডাক্তাররা দায়িত্ব পালনে আরও মনযোগী হবেন। নাগরিকরা এর সুফল পাবে।

মাননীয় আইনমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কি ভাবছে জানি না। আশা করি এরকমভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়টিও এবার অতিরিক্ত বাজেট আশা করতে পারে যদি স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়