ঈদে প্রাইভেটকারে গ্রামে যাওয়া এবং...

প্রকাশ | ২২ মে ২০২০, ১৬:৪৮ | আপডেট: ২৩ মে ২০২০, ১৩:৪৯

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

মা প্রাইভেটকারে চড়তে পারেন না। দম নাকি বন্ধ হয়ে আসে। জানালা খুলে রাখলে ভালো লাগে। বাতাস লাগে গায়ে। আরাম হয়। যতবারই ভাড়া-গাড়িতে ঢাকার বাইরে মাকে নিয়ে গেছি ততবারই গ্লাস নামিয়ে রাখতে হয়েছে। শীত-গরম যাই হোক। ঢাকার ভেতরেও খানিকের জন্য উবারে চড়লেও তিনি গ্লাস নামিয়ে রাখেন। এতে যা হয়, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে একগাদা ধুলো পলেস্তারার মতো গায়ে লেপ্টে থাকে। মুখের ওপর প্রলেপ পড়ে ধুলোর। চুলের রঙ বদলে যায়। তাতেও মা খুশি।

একবার মাকে বললাম, যদি কোনোদিন নিজেদের একটা গাড়ি কেনার মতো টাকা হয়, তখন তো বিপদ হবে। তুমি তো প্রাইভেটকারে চড়তে পারো না। আর চড়লেও গ্লাস নামিয়ে রাখতে হয়।

মা জবাবে বললেন, বড় গাড়ি কিনবি। ছোট না।

রসিকতা করে বললাম, বাস না ট্রাক?

মা ধমক দিয়ে বললেন, কেন, বাস-ট্রাক ছাড়া বড় গাড়ি নেই? মাইক্রোবাস কিনবি। কত নতুন নতুন গাড়ি আছে, বড়। ছোট গাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে।

ছোটবোন ছিল পাশেই। সে বলল, এক কাজ করিস ভাইয়া একটা মাহেন্দ্রার ট্রাক্টর কিনিস। বড় বড় চাকা আছে। ছাদও খোলা। আম্মার অসুবিধা হবে না। হিহিহি।

এই রসিকতায় মা’ও কম যান না। বললেন, হ্যাঁ সমস্যা কী? ট্রাক্টর যদি নিজেদের হয় তাহলে সেটা ব্যক্তিগত পরিবহনই তো। তাকে প্রাইভেটকার বলতে দোষ কী!  

শুক্রবার (বাইশ মে) ঘুম থেকে উঠে দেখি, ঈদে প্রাইভেটকারে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে প্রাইভেটকার আটকানো হচ্ছে না। কেউ নিজের গাড়িতে চড়ে বাড়ি যেতে চাইলে বাধা নেই।  

মাকে বললাম, দেখছো প্রাইভেটকার কত ভালো?

মা বললেন, কেন, কী হয়েছে?

‘এই যে প্রাইভেটকারে করোনার ঝুঁকি নেই। প্রাইভেটকার যাদের আছে তারাও ঝুঁকিমুক্ত। তারা উহান থেকে আসুক আর ঢাকা থেকেই যাক, করোনা সংক্রমণের ভয় নেই।’

মা কপাল কুচকে বললেন, কীসব বলছিস। কে বলেছে এসব?

আমি মুঠোফোনের পর্দায় খবরটি মেলে ধরে বললাম, এই দেখো ঈদে প্রাইভেটকারে বাড়ি যাওয়া যাবে। কোনো সমস্যা নেই।

মা কিছুটা সময় নিয়ে খবরটি পড়লেন। বললেন, যতসব আজগুবি কাজ।

বললাম, আজগুবি হবে কেন? তোমার কি মনে হয় যারা অনুমতি দিয়েছেন তারা তোমার-আমার চেয়ে কম বোঝেন? নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

মা বললেন, তাহলে যারা এত কষ্ট করে ফেরিতে, ট্রলারে, লঞ্চে  চড়ে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল তাদের এত ভোগান্তিতে ফেললো কেন?

বললাম, তাদের তো প্রাইভেটকার নেই। তারা তো ভোগান্তিতে পড়বেই।

‘ও তাদের প্রাইভেটকার নেই বলে তারা যেতে পারবে না? ফাজলামো করিস আমার সাথে?’ মা এবার খানিকটা চটে গেলেন মনে হচ্ছে।

‘ফাজলামো কেন মা? যারা ফেরিতে, লঞ্চে করে বাড়ি যাচ্ছে তারা যে করোনা আক্রান্ত নয়, কী করে বলবে? তাদের অনেকে তো পোশাক কারখানায় কাজ করে। ঢাকায় চলাফেরা করতে হয়েছে। সংক্রমণ হলে তো আর সাথে সাথে ধরা পড়ে না। তারা যদি গ্রামে যায়, অন্যদের সাথে মেশে, তাহলে তো ছড়াতে পারে। এইজন্য সরকার তাদের বাড়ি যেতে বারণ করেছে।’

মা এবার দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, তুই কী করে সাংবাদিকতা করিস আমি বুঝি না। এত কম আক্কেল-জ্ঞান নিয়ে সাংবাদিকতা হয়? আমি তো জানতাম এই পেশা বিচক্ষণ লোকজনের। যাদের চোখকান খোলা। তোর মতো গাধাও আছে!’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কথা হচ্ছিল বাড়ি যাওয়া নিয়ে, সেখানে আমাকে গাধা এলজাম দেওয়ার মানে কী! মন খারাপ করে বললাম, কেন মা আমাকে দেখতে তোমার গাধা মনে হয়? আমি কি চার পায়ে ভর দিয়ে হাঁটি?

‘চার পায়ে হাঁটলেই গাধা হয় না। তোর মতো দুই পায়ে হাঁটা গাধাও হয়।’

মা!

কী?

আমি কি ঘাস-লতাপাতা খাই?

‘খাস না তাতে কী? গাধা হলেই ঘাস খেতে হবে? গাধাকে ভাত দিলে গাধা তাও খাবে।’

কথা বলতে বলতে কখন যে আমার হাত দুটো কানের কাছে চলে গেছে বুঝতে পারিনি। মা খেয়াল করলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ ভালো করে দেখ। কী, কান বড় হচ্ছে না?’

চকিতে হাত দুটো সরিয়ে নিলাম কান থেকে। মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, সত্যি সত্যিই কানদুটো বড় হয়ে খাড়া হয়ে আছে গাধার মতো।

আমার গাধা গাধা মুখ দেখে মায়ের বোধ হয় মায়া হলো। বললেন, শোন, কার শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আছে তা তো কেউ জানে না। তারা যদি গ্রামে গিয়ে করোনা ছড়ায়, এই ভয়েই তো বাড়ি যেতে না করছে তাই না?

বললাম, ‘হ্যাঁ তাই তো। তারা তো গিয়ে সবার সঙ্গে মিশে যাবে। তখন তো ঢাকার বাইরেও খারাপ অবস্থা হবে।’

মা হেসে বললেন, ‘তাহলে যারা প্রাইভেটকার নিয়ে যাবে, তারা যে করোনার জীবাণু নিয়ে যাচ্ছে না, তা কী করে নিশ্চিত হবি? আর তারা গিয়ে কি প্রাইভেটকারেই থাকবে? মানুষের সঙ্গে মিশবে না? প্রাইভেটকারে চড়ে এমন লোকেরাও তো অনেক আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন।’

আমি মাথা চুলকে বললাম, তা তো ঠিক। কিন্তু...

‘কিন্তু কী?’

‘প্রাইভেটকারে যারা যাবেন তারা তো গাদাগাদি করে যাবেন না। গাড়িটাও তুলনামূলক নিরাপদ। বাইরের লোকজন তো আর চড়ে না তাতে। তাই হয়তো যেতে দেওয়া হচ্ছে।’

মা এবার হেসে বললেন, ‘আমরা যে মাঝেমধ্যে প্রাইভেটকার নিয়ে গ্রামে যাই, কী করে? আমাদের তো গাড়ি নেই।’

আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রশ্ন কমন পড়ার মতো চটঝলদি উত্তর দিলাম, ‘কেন ভাড়ায় গাড়ি নিয়ে যাই।’

‘হ্যাঁ, ভাড়ায়। যাদের গাড়ি নেই তারা তো এখন গাড়ি ভাড়ি করে নিয়ে যাবেন। তখন?’

‘তখন কী?’

‘তখন তো আরও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। এক গাড়িতে কত মানুষ চড়বে ভেবে দেখেছিস? এই দুদিনে তো প্রাইভেটকারও গণপরিবহন হয়ে যাবে! একদল নিয়ে রেখে আসবে। আবার যাত্রী নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসবে। আবার ঢাকা থেকে অন্যদের নিয়ে যাবে গ্রামে। এর মধ্যে যদি কেউ একজন করোনা আক্রান্ত থাকেন, তাহলে সে কতজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াবেন, হিসাব করে দেখেছিস?’

অংকে আমি বরাবরই দুর্বল। মায়ের মুখে হিসাবের কথা শুনে আরও কেমন দুর্বল লাগছিল নিজেকে। মাথা ঘোরানোর ভাব হলো। আমি চাঁদিতে হাত বোলাতে বোলাতে বসা থেকে উঠে গেলাম।

মা বললেন, কীরে কোথায় যাচ্ছিস?

বললাম, বাথরুমে।

কেন?

মাথায় পানি দিতে হবে। চাঁদিটা কেমন গরম হয়ে গেছে।