ধূসর রঙের করোনার দিনগুলো

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২০, ১০:০৫

মৌলি আজাদ

সচরাচর আমি কম্পিউটারেই লিখি। লকডাউনের এ সময়ে হাতে তুলে নিলাম কলম। জানি পত্রিকায় ই-মেইলে লেখা পাঠাতে হলে আবার তা কম্পোজ করতেই হবে। এখনতো পত্রিকায় লেখা পাঠানোর জন্য কোন বাহকও নেই। ডাবল কষ্ট। অসুবিধে নেই। লকডাউনের এ সময়ে সুযোগ-সময় পেয়ে হাতেই না হয় আবার লেখা শুরু করলাম! মন্দ নয়। অনেকদিন পর হাতে লেখার চর্চা, আরকি! 

এরকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যে পড়বো তা আমরা কখনো কেউ ভাবিনি। ফেব্রয়ারি মাসে বই-বইমেলা পাঠক নিয়ে দিব্যি মেতে ছিলাম। বলা যায়, এবারের বইমেলার প্রাঙ্গন সাজানো হয়েছিল লেখক-পাঠকদের মনের মতো করেই। নিজের বইটি হাতে নিয়ে সারা বইমেলায় মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছি। যখনই ঘুরতে ভালো লাগছিল না প্রিয়জনদের নিয়ে চা হাতে বসে পড়েছিলাম স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে লাগোয়া দীঘির বেঞ্চে। নতুন বই-লেখক-বইয়ের কাটতি-নিয়ে কত না আড্ডায় মেতেছিলাম।

সেসময় দু একজনকে চীন দেশে করোনা ভাইরাসের জাঁকিয়ে বসা নিয়ে দু একটা কথা বলতে যে শুনিনি তা নয়। কিন্তু কথাগুলোকে বলা যায় সেসময় তেমন একটা আমলে নেইনি। ভেবেছিলাম, বাংলাদেশ পর্যন্ত এ রোগ বোধহয় ধেয়ে আসবে না। কী ভুলটাই না ভেবেছি! এ যে কোন সাধারণ ভাইরাস নয়। জটিল এক ভাইরাস (বিজ্ঞানীদের ভ্যাকসিন তৈরি করতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে রীতিমত)। 

বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে গুটিগুটি পায়ে আমার দেশেও চলে এসেছে করোনা। যখন থেকে শুনেছি সুদূর চীন দেশ থেকে ঘুরতে ঘুরতে করোনা ভাইরাস আমার দেশে চলে এসেছে তখন থেকেই মনে ভয় কাজ করছিল। অফিস করবো নাকি ছুটি নিবো , ভাবছিলাম । ভাবতেই ভাবতেই পেলাম সাধারণ ছুটি তথা লকডাউন। ছুটি প্রায় দুই মাসের কাছাকাছি চলছে। দীর্ঘ দুই মাস বাসায় বসে থাকবো তা কেউ কখনো ভেবেছি? তবে যখন থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে ভাল রাখার জন্যে সরকার এ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম সবোর্চ্চ প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে এক পাও রাখব না। ভাবতে ভাল লাগে-এখন পর্যন্ত নিজের মনের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবে পরিনত করতে পেরেছি এই ভেবে। এ ছুটি যে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াবার নয়। এ যে একরকম নিজ ঘরে নির্বাসন যাপন। 

আমার সংসার মানেই হল আমার মা ও ছেলে। মায়ের বয়স হয়েছে। তার বাইরে যাবার কোন তাড়া নেই, কিন্তু সে যে অসুস্থ। হঠাৎ করে যদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তাকে কোন হসপিটালে নিয়ে যাব এ নিয়ে  আমার প্রবল দুশ্চিন্তা (জানি সব বাসায়ই বয়স্কদের নিয়ে সবারই একই চিন্তা)। আমার এ চিন্তা বুঝতে পেরেই ডাক্তার নির্দেশিত পথ্যগুলো মা নিজেই নিয়ম করে খেয়ে চলেছেন। ছেলেকে বুঝিয়েছি খুব একটা খারাপ অসুখ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়াতো যাবেই না, খেয়ালখুশি মত কোন জিনিস কেনারও ( অনলাইনে) বায়না করা যাবে না। পরিস্থিতি ভাল নয়, তাই এ অবস্থায় ইচ্ছেমত খরচ করা ঠিক নয়। আজকালকার বাচ্চা। ইন্টারনেটে নিয়ে ফেলেছে করোনার সব খবর। উল্টো আমাকে শুনিয়ে দিল -‘মা তুমি স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চ । বাসার কাজ যেমন নিজের হাতে করছো, অফিসের কাজেও অফিস সহায়কের আর সাহায্য নিও না। অফিস বাসায় নিজের সব কাজ নিজে করলেই মা তোমার অসুস্থ হবার সম্ভাবনা কম।’
 
ভাল বলেছে তো। আগে তো অফিসের কথা এমন ভাবে চিন্তা করিনি। আমরা যারা সরকারি-বেসরকারি অফিসে চাকরি করি তারা অধিকাংশই কিন্ত অফিস সহায়কের ওপর ডিপেন্ড করি (অফিসে  রুম/টেবিল পরিষ্কারে বা তাদের দিয়ে চা তৈরি করি ইত্যাদি) ভাবছি অফিস খোলার পর এই ডিপেন্ডেসিটা কমাতে হবে। ছেলে আমার ভালো পরামর্শদাতা। আমাকে আরো বলল - ‘মা তোমার আর ক্যান্টিনে খাওয়া চলবে না।’ তাই তো! এতো চিন্তা করিনি। এখন থেকে ঘরে তৈরি খাবার না খেয়ে তো উপায় নেই। 

ছেলে আমার অনলাইনে পড়ছে-লিখছে-ছবি আঁকছে। কিন্তু আমি তো বুঝি করোনা যে কত মূল্যবান সময় শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে। সব কী ঘরে বসে হয়রে! আমাদের দেশের সব বাচ্চাদেরই সাঁতার শেখা উচিত। রমজানের এ ছুটিতে বাচ্চারা সাঁতার শিখতে পারতো। কিন্তু করোনা এ সময়টা নষ্ট করলো।

এবার বলি তবে আমার কথা! যেহেতু ঘরে এখন কোন হেল্পিং হ্যান্ড নেই, তাই ঘর পরিষ্কারের কাজটি নিজ হাতেই করছি। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট লেগেছে। বলা যায়, অনভ্যাস। কিন্তু বাদ দেইনি, যেহেতু করোনায় ঘরবাড়ি জীবাণুমুক্ত রাখা খুবই জরুরি। কাজ করতে করতে উপলব্ধি করছি আমাদের বাসায় যারা এতদিন কাজ করেছেন তারা কতোটা শ্রমই না দিয়েছেন। জানি না, বাসায় কাজ করতো যে মেয়েটি, দুধ দিয়ে যেতেন যে মহিলা, পত্রিকার সেই হকার ছেলেটি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর তারা এখন কে কোথায় আছে? বুঝতে পারি খুব বেশি ভাল থাকার কথা নয় তাদের। অবশ্য করোনার এই দিনগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেইবা ভাল আছি? প্রত্যেকেই তো প্রত্যেকের উপর নির্ভরশীল ছিলাম, তাই না? 

ঘর পরিষ্কার করার পাশাপাশি করছি রান্না। ইউটিউব পুরোই রাঁধুনি বানিয়ে ছেড়েছে। পটলের দোলমা, মিষ্টি কুমড়ার বড়া আর জিলাপি বানানো যত সহজই হোক না কেন, লকডাউনে বন্দি না থাকলে কোনদিন তৈরি করতাম কিনা সন্দেহ!

রান্নার ফাঁকে পড়ে চলছি বেশ কয়েকটি বই। কবিগুরুর বই অবসরে কে না পড়ে বলুন!  বহুবার পড়া গল্প  ‘দৃষ্টিদান’ এ লকডাউনে দুইবার পড়লাম। একেকবার পড়ি একেকবার গল্পটিকে একেকভাবে চিন্তা করি। এবারের বইমেলায় বাবার অপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলো এক করে একটি বই বের হয়েছে। নাম ‘অগ্রন্থিত হুমায়ুন আজাদ । সে বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ‘কবি হওয়ার গল্প ’ এ প্রবন্ধে এমনভাবে আটকে গেছি যে বারবার কয়েকটি লাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছি ‘আমি লোক কবি হতে চাইনি বলে প্রতিদিন কবিতা বাঁধিনি, পাগলামোকে কবিতা মনে করিনি, আমি কারো স্তব করিনি কবিতায়, না মহাপুরুষের না কোন তন্ত্রের। 

শিগগির কবিতার বই বের করতে হবে, এটাও আমি ভাবিনি....কবিকে কি লিখতে হবে হাজার হাজার কবিতা? আমার মনে হয় না। আমি ভেতরে ভেতরে কবিতা লিখে চলেছি, বাইরে বেরোবে সেগুলো, আমি লিখছি, যখন অন্যরা অতীত কীর্তির ধ্বংসস্তুপের ওপর বসে উপভোগ করেছেন নিজেদের গৌরব’।

যেকোন ছুটি পেলেই আমি চিরনমস্য প্রিয় লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বই নিয়ে বসে যাই। তার লেখার মূল আকর্ষণ উপন্যাসের মূল চরিত্রের মনস্তত্ব । আবারো পড়ছি ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস। যে উপন্যাসে জন্ম ও মৃত্যু একাকার হয়ে আছে। গ্রামের সবাই একে একে কান্না শুনতে পায়, নদীর দিক থেকে কান্নাটি আসে। এতে তারা এতোই ভীত হয় যে, একে একটি  অমঙ্গলের পূর্বাভাস বলেই ধরে নেয়।‘কাঁদো নদী কাঁদো ’ পড়তে গিয়ে বারবার করোনা মহামারির কথা মনে হয়, জীবন নিয়ে সংশয় জাগে। মন বলে বাঁচব তো এ যাত্রায় আমি/আমরা। আর তাই নিজে কিছু লিখি না। 
বলবেন-ইতোপূর্বে মহামারির সময় বহু বিখ্যাত লেখাই রচিত হয়েছে। জানি। কিন্তু আমার মাথা ভার হয়ে আছে যেন, জীবন যেন বড় হয়ে উঠেছে এখন আমার কাছে। 

লকডাউনের এ সময়ে চলে এসেছে মাহে রমজান। এ যাবত রমজান মাস মানেই ছিল আমার কাছে অতি আনন্দের মাস। এ বয়সেও ছোটবেলার মতই ঈদের জন্য অপেক্ষা করি। বিভিন্ন নামকরা রেস্টুরেন্টের ইফতার কেনা, উপহার বিনিময়, ঈদে রান্নার প্রস্তুতি এবং প্রার্থনায় কেটে যেতো আমার রমজান মাস।

এবার সব আয়োজন বাদ। প্রার্থনায় কাটাচ্ছি সময়, প্রার্থনা ছাড়া এ মহাবিপদ থেকে মুক্তির পথই বা কী? কারো কাছে যে নেই কোন সমাধান। জায়নামাজে বসেই শুনতে পাই নিচ থেকে ভেসে আসা ভিখাড়ির করুণ কান্নার সুর ‘মাগো একটু সাহায্য করেন ’(গত ১০ বছরে এরকম কাউকে বলতে শুনিনি)। ভয় লাগতে থাকে। মনে হয়, করোনার সঙ্গে বুঝি ধেয়ে আসছে  দুর্ভিক্ষও । সঙ্গে যোগ হয়েছে আম্পান।

আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। টিভিতে করোনা আক্রান্ত/মৃত্যুর পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতে পারি না ভাবি শুধু পারবো তো আমরা এতসব দুর্যোগকে শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে? কার কাছ থেকে পাবো সামান্য আশার আলো? দিশেহারা হই যেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিশাল ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজি...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক