ক্ষুদ্র মগজে এত টাকার হিসাব কল্পনাও করতে পারে না

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২০, ১৪:৫১

পাভেল ইসলাম

গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত ৪ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এ সংবাদে আরো জানা যাচ্ছে, এ হিসাবটি আংশিক, প্রকৃত অংকটি নাকি আরো বড়। গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফই) এর অনুমান সাপেক্ষে এ টাকার অংকটির কথা বলা হচ্ছে। সঠিক অংক বলা কঠিন, কারণ ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ এ সংস্থাকে কোনো তথ্য দেয়নি। তারা পূর্ববতী তথ্য উপাত্ত থেকে এ সংখ্যাটি অনুমান করেছেন।

এখন আপনি আমি কি অনুমান করতে পারবো, সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা মানে কতো টাকা? সাড়ে চার কোটি নয়, সাড়ে চল্লিশ কোটি, সাড়ে চারশ কিংবা সাড়ে চার হাজার কোটিও নয়, সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা!? আমার ক্ষুদ্র মগজে এ পরিমাণ টাকার কথা কল্পনাও করতে পারি না। এ পরিমাণ টাকা দিয়ে কী কী করা যায়? এ পরিমাণ টাকা কতো জন মিলে পাচার করেছে? যারা এ টাকাটা পাচার করেছে তারা আদতে কতো টাকার মালিক?

The answer is my friend is blowing in the wind.

কিন্তু প্রশ্নটা হলো আমার মতো ফুঁটো পয়সার চৌকিদার হঠাৎ এমন আকাশচুম্বি টাকা পয়সার খোঁজ নিতে আসলো কেন? কারণটা অবশ্য এই জিদ্দি করোনাকাল। এই অতিব ক্ষুদ্র ভাইরাস নামের জিনিসটি দেখিয়ে দিলো আমাদের বড়লোকরা কতো গরীব।

করোনার কারণে, লকডাউনের কারণে দেশে নাকি অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আর এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বড় বড় কোম্পানিরা, দেশের নামকরা সব ব্যবসায়ী আর ঋণ খেলাপিরা। তারা প্রথম সুযোগেই জানিয়ে দিয়েছেন, বেতন দিতে পারবেন না, কেউ কেউ অবশ্য আংশিক বেতন দেয়ার মতো সামর্থ দেখিয়েছেন, কারো আবার ঈদ বোনাস দেয়ার সামর্থ নেই।

আমি নিজে চাকরি টাকরি করি না অনেক দিন। কিন্তু চারপাশে সবাই চাকরি বা ব্যবসা করেন। ব্যবসায়ীরা সবাই গলা শুকিয়ে কাঠ, দমবন্ধ অবস্থা, টাকা নেই। করোনা এটাকের দু'মাসের মাথাতেই তারা ফতুর। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক নিঃস্ব, শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছেন না। প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক এই দুঃসময়ে নার্স, ডাক্তারকে বেতন বোনাস তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামও দিতে পারছেন না। দেশের সবচেয়ে বড় খাত নাকি গার্মেন্টস।

এই বিপদের কালে তারা কর্মীদের নিয়ে কুতকুত খেললেন। আসো-যাও-আসো'র খেলায় দুচারপাঁচ হাজার টাকা কামানো কর্মীদের নাভিশ্বাস অবস্থা। কিন্তু বিদেশি টাকা কামানো মালিকরা সবার আগেই জানিয়ে দিলেন বসিয়ে বসিয়ে কর্মীদের বেতন দিতে পারবেন না তারা। কারণ এইসব প্রতিষ্ঠান মালিকদের টাকা নেই। তো যুগ যুগ ধরে কী এমন ব্যবসা তারা করেছেন যে বিপদে তার কর্মীদের দুতিনমাসের অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে পারেন না। যে প্রতিষ্ঠান চরম সংকটকালে তার কর্মীকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে পারে না সে প্রতিষ্ঠান টিকলেই কি না টিকলেই কি!

একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরও তো একটা রিক্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান থাকার কথা। যদি তিন মাস, ছয়মাস আয় না হয়, তবে প্রতিষ্ঠানটি কি বন্ধ করে দিতে হবে! এমন প্রতিষ্ঠানের মালিক কারা। বাংলাদেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের দারিদ্র্য চোখে পড়ার মতো। অথচ তাদের সবারই সম্পদের পাহাড় আছে, আছে বিদেশি নাগরিকত্ব, বিদেশে ইনভেস্টমেন্ট। কথায় কথায় এ দেশের ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা ইংল্যান্ড, আমেরিকা যায়, কিন্তু তাদের দারিদ্র্য যায় না। আমি এক জীবনে খুব কম ব্যবসায়ী দেখেছি যে তার আয় রুজি নিয়ে খুশি। অথচ তার প্রতিষ্ঠান ছোট থেকে বড় হচ্ছে।

আমি একটা ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে কাজ করেছি। তার ট্রাস্ট্রি হিসাবে এমন ব্যক্তিরা ছিলেন যাদের নাম শুনলেও সমীহ জাগে। এরা একেকজন স্বীকৃত বিলিয়নিয়ার। থ্রিস্টার হোটেল ছাড়া তারা চা-কফিও খান না। অথচ তারা প্রায় প্রত্যেক মাসেই বেতন দিতে গরিমসি করতেন। আমার এক কোটিপতি বন্ধুকে দেখেছি অফিসের পিয়নের বেতন (৮ হাজার টাকা) তিনবারে দিচ্ছেন। পিয়নকে কাচুমুচু করে বলছেন, বুঝলি এ মাসে একটু টানাটানি। আমি নিজে তার সৌজন্যে এক বসায় ১০ হাজার টাকার পানাহার করেছি। আমি সর্বশেষ যে চাকরিটি করতাম তা এ দেশের বিরাট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের পিতার নামে চলতো। নিজের বাবার নামে চালানো প্রতিষ্ঠানের আয়-রোজগার নিয়ে তাদের আফসোসের অন্ত ছিলো না। আমি তাদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, আজও তিন মাসের বেতন পাই। অথচ দুচার কোটি টাকা তাদের হাতের ময়লা।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পয়সাওয়ালা দুচারজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। বিশ্বাস করুন, এদের অধিকাংশ কর্মচারীর বেতন দেয়াকে ভিক্ষা দেয়া মনে করেন। ইচ্ছে হলে দিবেন, নইলে বলবেন মাপ করো। এরা আবার একদিন কামাই করলে বাসার গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে ড্রাইভার, আয়া, বুয়ার বেতন কাটেন। এ সবই আমার নিজের চোখে দেখা।

দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে এ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়াই ভালো। তাদের দখল করা জায়গায় লাউ চাষ হতে পারে, আমরা পেট ভরে লাউ শাক খেলাম, সাধের লাউ খেলাম। আর প্রতিষ্ঠান মালিকদের উচিত তাদের কিনে রাখা পাসপোর্টের দেশগুলোতে চলে যাওয়া।

এ দেশটা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের টাকা কামাইয়ের ফ্যাক্টরি নয়। আপনারা টাকা কামাবেন আর বিদেশে পাচার করবেন আর নূন্যতম জোরালো বাতাস দেখলেই বলবেন, খাইছে রে ব্যবসা অবস্থা খুব খারাপ, মাপ করো ভাই, তোমাদের এ মাসের বেতন দিতে পারবো না।

খুব জানতে ইচ্ছে করে, মানসিক এই ভিক্ষুকগুলো কি রোগে, শোকে টাকা খেয়ে বাঁচবে? আর পাচার হওয়া টাকাগুলোর মালিক কারা? নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গার্মেন্টস কর্মী, ডাক্তার, নার্সরা এসব টাকা পাচার করেনি।

ভাইয়েরা, বোনেরা, আমার কথায় যদি আতে ঘা লাগে আমারে দুটা জুতার বাড়ি দিয়েন। তার আগে আল্লার ওয়াস্তে খেটে খাওয়া মানুষগুলোরে বেতন আর ঈদ বোনাসটা দিয়েন। না হয় জমানো টাকা থেকেই দিলেন। কর্মী বাঁচলেই আপনার প্রতিষ্ঠান বাঁচবে। কর্মী না-খেয়ে মরে গেলে আপনার প্রতিষ্ঠান এবং আপনারেও কোনো দরকার নাই এ দেশের মানুষের।

বলছেন, আমি এতো বড় বড় কথা বলছি কেন? আমি যে এ দেশের একজন ছোটলোক গোত্রের লোক, আমার যে আপনাদের পাতানো দারিদ্র্য দেখলে গা জ্বলে। আমার কথা অবশ্য আপনাদের কিছুই জ্বলে না। জানি, ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারীর চামড়া খুব মজবুত হয়।

ও ভালো কথা, সব ব্যবসায়ী খারাপ নয়, এটুকু জ্ঞান আমাদের আছে। আসলে ব্যাপার হলো কি, আমি, আমার চাচা, মামু, খালা, দোস্ত, গার্লফ্রেন্ডরা ভালো। ওরা খারাপ। তাই এই কথাগুলো ওদের বলছি। আপনি আমি এ সবের বাইরে। অতএব নো চিন্তা ডু ফূ্র্তি। ঈদ এগিয়ে এলো। অনলাইন শপিং সেরে ফেলুন। হ্যাপি মার্কেটিং, হ্যাপি কেনাকাটা।

লেখক: গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী

ঢাকাটাইমস/২৩মে/এসকেএস