ঈদ-আনন্দ, ঈদ-বেদনা

পিয়াস মজিদ
| আপডেট : ২৪ মে ২০২০, ১৭:৪০ | প্রকাশিত : ২৪ মে ২০২০, ১৬:০৮

ছোটবেলা থেকে ঈদ বলতে আমাদের কাছে প্রিয় ছিল রোজার ঈদ। কারণ ঈদের আগে এক মাস রোজা, রোজার পনের দিন আগে শবেবরাত- সবই ছিল আনন্দের উপচারে ভরা। মনে পড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে কাটানো শৈশবের রোজাতেও এখনকার মতো ভীষণ গরম পড়তো, তখন ফ্রিজও ছিলো না এতো, ফল জাতীয় খাবার ঠাণ্ডা করতে বাড়ির চৌবাচ্চার পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো- একবার ইফতারের আগে চৌবাচ্চায় ডুবানো তরমুজ উঠাতে গিয়ে আমি নিজেই পড়ে গিয়েছিলাম চৌবাচ্চায়, পরে আমার বোন রূপা এসে উদ্ধার করেছিল ছোট্ট আমাকে। রোজার দিনের এমন সব কষ্টই সহনীয় মনে হতো আসন্ন ঈদের রঙিন সব স্বপ্নে। মহল্লায় শবে-বরাত পালন কমিটি গঠন করতাম আমরা যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে শবে-বরাতের মিলাদের নামে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো। চাঁদা তুলে, মিষ্টান্ন কিনে, আতশবাজি ফাটিয়ে, কোন হুজুরের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেরাই মিলাদ পড়তাম। আজো কানে বাজে নিজেদেরই হারানো কণ্ঠ ‘বালাগাল উলা বিকামালিহি....’, ‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা, ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা’ বাসায় রোজা রাখতো হয়তো আব্বু ও আম্মু কিন্তু সেহরি ও ইফতারের আনন্দ ছিল আমাদের সবার। রোজার প্রায় পুরোটা সময় স্কুল বন্ধ থাকতো- আমি ছোটবেলা থেকেই সকালবেলার পাখি, যত রাতেই ঘুমাই না কেন ঘুম ভেঙে যায় অতি ভোর ভোর। রোজার দিনে যেহেতু স্কুলে যাওয়া নেই, সকাল সকাল আম্মুর নাস্তা বানানোর তাগাদা নেই, তাই বাসার সবাই ঘুম থেকে উঠতো একটু দেরিতে। আমার তখন খুব কষ্টে সময় কাটতো, শুয়ে শুয়ে বই পড়ার চেষ্টা করতাম আর বাসার বাইরে গিয়ে দেখতাম খেলার সাথীরা কেউ মাঠে এসেছে কিনা।

কুমিল্লা শহরের মোগলটুলিতে ঐতিহাসিক শাহ সুজা মসজিদের পেছনে ছিল আমাদের প্রথম আবাস। ঐ মসজিদের সামনে বিশাল উঁচু মিনারে দাঁড়িয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব ঘোষণা দিতেন চাঁদ দেখার কথা আর আমরা ছোটরা নিচে দাঁড়িয়ে হিসেব করতাম কত দূরত্বে বাস করে ঈদের চাঁদ আর কোনো অলৌকিক মই বেয়ে ঈদের চাঁদের বাড়ি যাওয়া যায় কিনা সেই স্বপ্নও দেখতাম। মনে আছে একবার চাঁদ দেখতে গিয়ে আমাদের বন্ধু পিংকির উপর নির্মাণকাজের জন্য জড়ো করা এক সারি ইট ধবসে পড়ে। মুহূর্তেই ঈদের আনন্দ উবে গেল আমাদের। পিংকি অবশ্য সেরে উঠল দীর্ঘ চিকিৎসার পর।

ঈদ মানে ঈদের কেনাকাটাও। আমাদের বাসায় ছিল দফায় দফায় ঈদের শপিং-এর কালচার। কোনোদিন আমার বোনের, কোনোদিন ভাইদের আর কোনদিন ঘর সাজানোর শপিং- এই শপিং নিয়ে কত মজার ঘটনা। একবার কুমিল্লার ঈদের মার্কেটে এক নতুন ধরনের লেহেঙ্গা এলো। আমার বোনের শপিং ততোদিনে শেষ হয়ে গেছে। কয়েকটি জামা কেনা হয়ে গেছে তার । কিন্তু দোকানে গিয়ে বায়না ধরলো লেহাঙ্গাটি তার চাই। ওদিকে আম্মু সাথে নিয়ে গেছে শুধু আমাদের ভাইদের জামাকাপড় কেনার টাকা। পরে দ্রুত আমাদের তিনভাই চম্পা বোন রূপার জন্য বিশেষ বিবেচনায় আমাদের ভাইদের বরাদ্দ থেকে ভাগ করে লেহাঙ্গাটি কিনে দেয়া হলো। ঈদের আনন্দ মানে তো এমন ভাগ করে নেয়ারই আনন্দ। ঈদের আগের রাত অর্থাৎ চাঁদ রাতে শপিং-এর মজাই ছিল আলাদা। একবার তো চাঁদ দেখার বিভ্রাটে পড়ে শপিং শেষ হচ্ছিল না কুমিল্লা শহরের কারোরই। পরে অনেক রাতে ঈদের ঘোষণা এলে তড়িঘড়ি পুরো শহরের মানুষ শপিং শেষ করে সকালে ঈদের প্রস্তুতি নিলো। ঈদের আগের রাতে ভিড় জমাতাম পাড়ার সেলুনে। ছেলেবুড়ো সবাই নিজেকে শেষ মুহূর্তের সাজিয়ে নেয়ায় যেভাবে লাইন দিতো সেলুনের মামাদের কাছে -সেটা এক দেখার দৃশ্য ছিল বটে।

কুমিল্লা শহর থেকে ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে কদাচিৎ- গেলেও ঈদ-উল আজহায়। রোজার ঈদ বলতে কুমিল্লা শহরের ঈদ-ই বুঝেছি। ঈদে সব প্রতিবেশী বন্ধুরা যখন গ্রামে চলে যেতো আর যাওয়ার আগে সদলবলে আসতো আম্মুকে বিদায়ী সালাম করতে, তখন আমার খুব কান্না পেত। আমার শবে-বরাত ও ইফতার- আনন্দের সাথীরা চলে গেলে শূন্য হয়ে যেতাম খুব। ঈদের দিন সকালে আব্বু যখন নামাজের জন্য ডাক দিতেন তখন আবার নতুন বেগে ঈদ আনন্দের জোয়ার আসতো। গোসল শেষে আতর-সুগন্ধি গায়ে মেখে এতদিন বন্ধুদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা ঈদের নতুন পোশাকে যখন ঈদগাহে যেতাম তখন মনে হতো ঈদের আগের দিনও শহরটা ছিল বর্ণহীন, ঈদের সকাল আসতে শহরে লেগে গেছে অদৃশ্য আনন্দের রং। আর নব্বই দশকে দুপুর না গড়াতে গড়াতেই পাড়ার মোড়ে বাজতে থাকতো তখনকার সব হালফ্যাশনের গান- 'আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি তাই তোমার কাছে ছুটে আসি', 'ছেলে আমার বড় হবে'।

ঈদের দিন মানেই সেমাই- জর্দা। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের একটা ফ্যাশন ছিল আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে বলতাম ‘আন্টি, মিষ্টি না। ঝাল আইটেম দিবেন।’ ঝাল বলতে চটপটি, নুডুলস ও হালিম। ঈদের দিনে কুমিল্লা পার্ক, ধর্মসাগর আর চিড়িয়াখানায় ঘোরাঘুরি ছিল বাঁধা সিডিউল। আর ছিল ছোট চাচার কাছ থেকে পাওয়া বড় রকমের সালামির টাকা।

(ছবিতে, এক যুগ আগে ২০০৭-এর ঈদ আড্ডায়, স্কুলবন্ধুরা কুমিল্লায় এক বন্ধুর বাসায়)

যখন একটু একটু করে বড় হতে লাগলাম তখন বাসা থেকে একটু দূরে যাওয়ার অনুমতি মিলল। ঈদের দিন বা পরদিন মানিক, সৌরভ, হিমেল, আশিক, রাজু, হাসান মিলে ঘুরে আসতাম কোটবাড়ি, ময়নামতি, সীতাকুণ্ডু,ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর। একবার জমানো টাকায় কিনেছিলাম 'বেগম' পত্রিকার পঞ্চাশ বছর পূর্তি বিশেষ ঈদসংখ্যা। সেই পুরনো দিনের স্মৃতিগন্ধমাখা পত্রিকাটা আমার অনেক দিনের পাঠ-সুখসঙ্গী ছিল। ঈদসংখ্যা পরে যখন ভালো করে চেনা হলো, লেখাও হলো অনেক ঈদসংখ্যায়, নিজেও যুক্ত থেকেছি একাধিক ঈদসংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে, তখন মনের মাঝে ভেসে উঠে কুমিল্লা পত্রিকার দোকানগুলোর সামনে ঘুরে বেড়ানো আমারই ছবি। যে ছেলেটি দোকানে আসা সবগুলো ঈদসংখ্যা উল্টে-পাল্টে দেখে হিসেব করতো কোন ঈদসংখ্যাটা কিনতে টাকাও কম লাগবে, প্রিয় লেখাও পড়া যাবে অনেক।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলে অনেক বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করেছি একা একা জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে থেকে ঈদ করার কিন্তু ঈদের কয়েকদিন আগে যখন আব্বু বাসা থেকে ফোন করে বলতো ‘পিয়াস, কবে আসবা?’ তখন সব পরিকল্পনা উড়ে গিয়ে গন্তব্য নির্ধারণ হতো সোজা ঢাকার সায়েদাবাদ টু কুমিল্লার শাসনগাছা। ঢাকা থেকে ঈদের ছুটিতে কুমিল্লায় যেতে যেতে কখনো সঙ্গী পেতাম মাইনুল শাহিদ, ওপেল আহমেদ কিংবা আরো কাউকে কাউকে। প্রচণ্ড যানজট ঠেলে যখন কুমিল্লা ফিরছি তখন শহরের আদালতপাড়ায় আমার অপেক্ষায় হয়তো বসে থাকতো বন্ধু তুহিন, শাহরিয়ার, আখতার, আপেল, আলমগীর, সজীব, মাহবুব এবং আরো অনেকে আর আমার কানে সেই বিজ্ঞাপনের গানটি বাজতে থাকতো ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি এবার’।

ঈদের আনন্দ ফিকে হতে শুরু করলো যখন আমাদের একমাত্র বোনটি প্রবাসী হলো। তবু ঈদের সকালের আবারও আনন্দ ফিরে আসতো আব্বুর ডাকে ‘আর কতো ঘুমাবা, ঈদের নামাজের সময়তো পার হয়ে গেল’। ওদিকে ঈদের দিন সকালে মিষ্টি কিছু মুখে দিয়ে বের হতে হয় বলে আম্মু দ্রুত কিছু একটা রান্না করে সবাইকে খাওয়াতে ব্যতিব্যস্ত থাকতো।

আব্বু চলে যাওয়ার পর থেকে ঈদে সবই হয় কিন্তু এই ডাক আর কখনো শোনা যায় না। ঈদের সকালের এই পারিবারিক আনন্দটুকু জীবন থেকে এভাবেই বিনা নোটিশে চলে যাবে তা কোন দিন কল্পনায়ও আনিনি।

এবারের ঈদের মতো এমন বিধুর-স্তব্ধ ঈদ মনে হয় জহির রায়হানের সিনেমার শিরোনামের মতোই 'কখনো আসে নি'।

প্রতি ঈদে আমরা বেদনাকে বন্দী করতাম আনন্দ দিয়ে আর এবার করোনা বন্দী করছে আমাদের ঈদ-আনন্দকে।

ঈদের বহু আগ থেকে পাওয়া দীর্ঘ অবকাশে অলস বসে বসে ভাবছি- শত বেদনার বাস্তবেও আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঈদেরা এভাবে স্মৃতির সমুদ্রে চিরদিন জোয়ার তুলে যাবে, অনাগত ঈদের আনন্দ-উজানে।

আর এখনও চোখে ভেসে আসে পুরনো পত্রিকার ঈদ-সংবাদ 'ঈদ উপলক্ষে নাড়ির টানে ঘরে ফিরছে মানুষ' কিংবা 'আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ'।

লেখকঃ কবি ও গদ্যকার। জনসংযোগ কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :