আরাফাতের ময়দানে হাজি মকবুলের সঙ্গে একই তাঁবুতে যখন...

প্রকাশ | ২৫ মে ২০২০, ০১:৩৬ | আপডেট: ২৫ মে ২০২০, ১৮:৪৭

আরিফুর রহমান দোলন

একসঙ্গে হজ করেছি আমরা। হাজি মকবুল হোসেন ও আমি একসঙ্গে আরাফাত ময়দানে একই তাঁবুর নিচে থেকেছি ২০১১ সালে, ঠিক পাশাপাশি বিছানায়। অসম্ভব প্রাণবন্ত একজন মানুষ। পুরো তাঁবু ঘুরে ঘুরে সবার খোঁজ নিচ্ছেন নিয়ম করে। কে খেয়েছেন আর কে খাননি, কার কি পছন্দ সব নজর দিচ্ছেন এককভাবে।

তখনই খুব কাছ থেকে আবিষ্কার করি বিশাল হৃদয়ের মানুষটিকে। আবিষ্কার করি তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতাকে। মুহুর্তে সবার সঙ্গে দ্রুত মিশে যাওয়ার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধও হই। বিন্দুমাত্র অহংবোধ দেখিনি। বরং ছোট-বড় সবার সেবা করার তাঁর যে মানসিকতা তা কাছ থেকে দেখে সত্যিই ভালো লেগেছে। মনে দাগও কেটেছে।

সেই হাজি মকবুল হোসেন আর নেই। হঠাৎ খবরটি শুনে থমকে গেছি। তরতাজা শক্ত সামর্থ বলিষ্ট ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ আকষ্মিকভাবে এভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন! নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর। ভয়ংকর করোনা কেড়ে নিলো রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সাংসদ এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হাজী মকবুলের প্রাণ।

মনটা ভারী হয়ে উঠছে। কারণ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন, সতর্ক আছেন সর্বদা, এমনকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব কোভিড-১৯ আক্রান্ত এখন। খবর যখন পাচ্ছি তখন মন অস্থির চঞ্চল হয়ে উঠছে। শুভ কামনা সবার জন্য। আবার দেশের কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করুন, কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা।

হাজি মকবুল হোসেন তো আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া ভালো কাজগুলো, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতের তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলো ও ব্যবসা, সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো সবসময় তাঁর কথা আমাদের মনে করাবে। শমরিতা এম এইচ মেডিকেল কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি এবং ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রমাণ করেছেন তিনি কত বড় শিক্ষানুরাগী। বস্ত্র, ওষুধ, নির্মাণখাতসহ বিভিন্ন খাতের অত্যন্ত সফল এই ব্যবসায়ী একাধিক সফল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির উদ্যোক্তাও।

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে বুক চিতিয়ে সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় রেখেছেন। ’৯৬ সালে অবিভক্ত ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর কারণে অকারণে তাঁকে নিয়ে বিতর্কও হয়েছে।

২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের রোষানলে পড়েছেন। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রক্তচক্ষু সহ্য করে কার্যত বাধ্য হয়ে রাজনীতির ফ্রন্টলাইন থেকে খানিকটা অন্তরালে চলে যান। অভিমানে পুরোদস্তুর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে মেতে থেকেছেন আর শিক্ষা বিস্তারে আরও বেশি ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য নিঃশব্দে কাজ করে গেছেন।

আজকের যে শক্তিশালী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, হাজি মকবুল হোসেন কিন্তু এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক। সংগঠনটিকে শক্তিশালী ভিত দিতে তাঁর প্রাণান্ত চেষ্টা, সাংহঠনিক দক্ষতার যে প্রয়াস ছিল, জীবদ্দশায় সেই মর্যাদা তাঁকে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে তার অভিমান ছিল। যা ছিল খুবই যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক। তবে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে তাকে খানিকটা হলেও মর্যাদার আসনে বসান দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয় তাঁকে।

আওয়ামী লীগে এখন সামর্থবান বিত্তবান নেতার ছড়াছড়ি। কিন্তু যে সময়ে সামর্থের সবটুকু দিয়ে সংগঠনের পাশে হাজি মকবুল দাঁড়িয়েছিলেন সে সময়টা ছিল যথেষ্টই সংকটময় এবং গুরুত্বপূর্ণ। দুঃসময়ের এই দলীয় যোদ্ধাকে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সেই ভাবে মনে রাখবে।

ব্যক্তিগতভাবে আরাফাতের ময়দানে তাঁকে যেভাবে দেখেছি এবং পরবর্তীতে টুকটাক যোগাযোগে তাঁকে যেভাবে পেয়েছি তাতে নিঃসন্দেহে এটুকু বলতে পারি- একজন নিরহংকার মানুষকে হারালাম আমরা।

২০১১ সালে হাজি মকবুলের একটি কথা মনে খুব গেঁথে গিয়েছিল- ছোট ভাই জীবনটা খুব ছোট, যত পারো কাজ করে যাও।

সত্যিই মকবুল ভাই, জীবনটা খুবই ছোট। নইলে এভাবে আপনি কেন বিদায় নেবেন! পরকালে খুব ভালো থাকবেন। সবসময় এই কামনা।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।